আবার অন্ধকার নেমে এসেছে বাহানগায়। শুক্রবার সন্ধ্যার সেই দুর্ঘটনার পর উদ্ধারকাজের জন্য যে সব ফ্লাড লাইট লাগানো হয়েছিল, তার আলোগুলোও যেন থমকে যাচ্ছে একের পর এক ছিন্নভিন্ন কামরার জটলায় ধাক্কা খেয়ে। ভিতরের ঘন অন্ধকারে এখনও কোনও দেহ পড়ে নেই তো? এখনও কোনও প্রাণ উদ্ধারের আশায় ধুকপুক করছে না তো?
শুক্রবার রাত ১১টা নাগাদ যখন বাহানগায় পৌঁছই, তখন উদ্ধারকাজের জন্য আলো থাকলেও তা যথেষ্ট ছিল না। তবে কিছু ক্ষণের মধ্যেই আরও অনেক ফ্লাড লাইটের ব্যবস্থা করা হয়। শনিবার সন্ধ্যা নামার পর তিন ট্রেনের সেই সংঘর্ষস্থলে জ্বলজ্বলে আলোর মধ্যেও যেন বেশ কয়েক জোড়া চোখ খুঁজে বেড়াচ্ছে কাউকে। সকাল থেকেই দেখেছি— ঘটনাস্থল থেকে হাসপাতালে বা অস্থায়ী মর্গে ঘুরে ঘুরে খুঁজে চলেছেন অনেকেই। বিকেলের আলোতেও তাঁদের কাউকে কাউকে ঘটনাস্থলের কাছে দেখেছি। তখনও খোঁজ মেলেনি কারও ঘরফেরতা ছেলের, কারও ভগ্নিপতির।
শনিবার ভোর হতেই আসতে শুরু করেছিলেন করমণ্ডল এক্সপ্রেসের যাত্রীদের আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবেরা। ৫০০ থেকে ৬০০ মিটার ব্যাসের এলাকা জুড়ে পড়ে রয়েছে তালগোল পাকানো একের পর এক কামরা। ছোটাছুটি চলছে উদ্ধারকারীদের। দেহ তুলে আনা হচ্ছে একে একে। কখনও ভেসে আসছে উদ্ধার করা আহতের গোঙানির শব্দ। তার মধ্যেই অনেকে ঠায় দাঁড়িয়ে নজর রেখে চলেছেন উদ্ধার করা যাত্রীদের দিকে। চেনা মুখটা বা মুখগুলো খুঁজে পাওয়ার মরিয়া চেষ্টা।
দুর্ঘটনাস্থল জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে যাত্রীদের ব্যাগপত্র। ছড়িয়ে রয়েছে আম, কাঁঠাল, লিচুও। করমণ্ডল এক্সপ্রেসের প্যান্ট্রি কারের খাবার বিলি করে দেওয়া হচ্ছে নিখোঁজদের সন্ধানে আসা মানুষদের মধ্যে। প্রশাসনের তরফে বিলি করা হচ্ছে জলের পাউচ। কিন্তু প্রিয়জনের মুখটা জীবন্ত না-দেখা পর্যন্ত সেই তৃষ্ণা মিটছে না কারওরই। খুঁজছেন আর এক দল মানুষ। ঘটনাস্থল খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করছেন দুর্ঘটনার তদন্তকারীরা।
এ সবের মধ্যে, মাঝে মধ্যেই এসে পড়ছেন ভিভিআইপিরা। ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়েক আসেন সবার আগে। তার পর রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণব। বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পৌঁছন। সবার শেষে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। এঁদের ঘিরে রেলকর্তাদের ভিড়। এ সব সময় স্বাভাবিক ভাবেই নিরাপত্তার ঘেরাটোপ বাড়তে থাকে। সাধারণ মানুষের যাতায়াতে লাগাম।
একেবারে অন্য ছবি বাহানগা হাই স্কুলে। দুপুর পর্যন্ত দেখেছি বগি কেটে কেটে সরানোর কাজ চালাচ্ছিলেন রেলকর্মীরা। সেখান থেকে একে একে বার করা হচ্ছিল যাত্রীদের মৃতদেহ। নিয়ে গিয়ে রাখা হচ্ছিল ঘটনাস্থল থেকে ৫০০ থেকে ৭০০ মিটার দূরে বাহানগা হাই স্কুলে। ওটাই এখন অস্থায়ী মর্গ। ময়নাতদন্ত করে শনাক্ত করা দেহ তুলে দেওয়া হচ্ছিল আত্মীয়-বন্ধুদের হাতে। বেলা পৌনে ৩টে নাগাদ সেই মৃত্যুপুরীতে পৌঁছে অনুভব করলাম এক অসহনীয় শৃঙ্খলা। বাঁশের ব্যারিকেড এবং পুলিশি নিরাপত্তা ঠেলে ধীর পায়ে মৃতের আত্মীয়েরা পৌঁছচ্ছেন প্রশাসনিক আধিকারিকদের কাছে। সেখানে আইনি কাজকর্ম সেরে দেহ নিয়ে একে একে ফিরে যাচ্ছেন বাড়ির পথে। মাঝে মাঝে ডুকরে ওঠা কান্না ভেঙে দিচ্ছে সেই নিস্তব্ধতা। ওই স্কুলেই প্রশাসনের তরফে আলাদা তাঁবু করা হয়েছে বাংলা থেকে যাওয়া মানুষজনের জন্য। সেখান থেকে বার বার মাইকে ঘোষণা করা হচ্ছে, ‘‘পশ্চিমবঙ্গ থেকে কেউ এসে থাকলে দেহ নিয়ে যেতে যোগাযোগ করুন এই তাঁবুতে।’’
সেই মর্গেও বোনকে খুঁজে না পেয়ে আবার ঘটনাস্থলে ফিরছেন বছর তিরিশের যুবক। আগে হাসপাতালে গিয়েছিলেন। খুঁজে পাননি সেখানেও। তবে কি এখনও…? দুপুরে শেষ দেখেছিলাম। তার পর সন্ধ্যা পর্যন্ত আর দেখতে পাইনি তাঁকে। খুঁজে কি পেয়েছিলেন বোনকে? জানা হয়নি।