২০১৭ সালের জুন মাসে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যখন নেদারল্যান্ড সফরে যান তখন ওই দেশের প্রধানমন্ত্রী মার্ক রুট্টি তাঁকে একটি সাইকেল উপহার দেন। কারণ তিনি নিজেও সাইকেল চড়েই অফিসে যাতাযাত করেন। সেই উপহার এ দেশের প্রধানমন্ত্রীর কোনও কাজে লেগেছিল কিনা, তা আমরা জানি না। কথাটা এই কারণেই বললাম যে ২০১৭ সাল ছিল দুই চাকার দুশো বছর। উনিশ শতকের গোড়ায় ১৮১৬ সালে গোটা ইউরোপে প্রবল খরা হয়। এই প্রাকৃতিক বিপর্যয় প্রবল খাদ্যাভাব ডেকে আনে। পেটের খিদে মেটাতে শুরু হয় ঘোড়া জবাই করা, যে প্রাণীটি তখন ছিল মানুষের একমাত্র বাহন। সেই পরিবহণ সংকট থেকে ত্রাণ পেতে জার্মানির কার্ল ড্রেইস এক চলমান দুই চাকা আবিষ্কার করেন। পরে তার নাম হয় ড্রেইসিন। অনেকে আদর করে তাকে ডাকে হবি হর্স।

তার পর থেকে বিগত দু’শতক ধরে এই সাইকেলের কত যে নমুনা বেরিয়েছে তার কোনও শেষ নেই। তিন চাকা থেকে চার চাকাও যেমন বেরিয়েছে তেমনি এই প্রযুক্তি পরে জন্ম দিয়েছে মোটরবাইক বা আটোমোবাইল শিল্পের। যন্ত্রটি জার্মানি তথা ইউরোপ পেরিয়ে আমেরিকা এবং অস্ট্রেলিয়া পর্যন্ত জনপ্রিয় হতে সময় নিয়েছে মাত্র কয়েক বছর। শুধু পাড়া বেড়ানো ছাড়াও, সাইকেল যে দূরগামী হরে পারে তার প্রমাণ পাওয়া গেল ১৮৯৩ সালে। পার্সী আর্মস্ট্রং অস্ট্রেলিয়ার কার্পেন্টারিয়া থেকে মেলবোর্ন এই চার হাজার কিলোমিটার সাইকেলে পাড়ি দিলেন ৫০ দিনে।

দু’চাকার এই বাহনটি নীরবে একটি সামাজিক বিপ্লব ঘটাল নারী স্বাধীনতার ক্ষেত্রে। মহিলা মহলে এই যন্ত্রটি সমানাধিকারে বার্তা বিয়ে আনে। সাইকেল চড়ার সুবিধার জন্য মেয়েদের পোশাকেও বিপ্লব আসে। এই যন্ত্রটিকে কেন্দ্র করে আমেরিকায় তৈরি হয় লিগ অব হুইলম্যান। তার প্রথমেই দাবি তোলে ভালো রাস্তাঘাটের। সেই অর্থে উন্নত যোগাযোগের পথিকৃৎ হল এই দ্বিচক্রযানটি। বিশ শতকের গোড়ায় সাইকেলের ব্যান্ড অ্যাম্বাসেডার হলেন বিজ্ঞানী আইনস্টাইন।

তিনি জানালেন সাইকেল চড়তে চড়তেই থিয়োরি অব রিলেটিভিটি তাঁর মাথায় আসে। দু’চাকা যে প্রয়োজনের বাইরে বিনোদনও দিতে পারে তার প্রমাণ হল রেসিং সাইকেল। তেমন মডেল হাতে আসার পরে দেখা গেল পৃথিবীর দেশে দেশে সার্কাসের দলে সাইকেল-খেলা অনিবার্য হয়ে উঠেছে।

বিশ শতকের মধ্যভাগে চিন বিপ্লবের পর সাইকেল নতুন গুরুত্ব পেল । মাও সে-তুং-এর সরকার ঘোষণা করল প্রতিটি পরিবারকে সাইকেল, সেলাই কল এবং দেয়াল ঘড়ি দেওয়া হবে। চীনে সাইকেলের নতুন নাম হল উড়ন্ত পায়রা। একুশ শতকে এসে কম্পিউটারের সাহায্যে এখন তৈরি হচ্ছে হাইব্রিড সাইকেল।

ভারতে সাইকেল আসে উনিশ শতাব্দীর শেষ দিকে। তার প্রথম আবির্ভাব কলকাতায়।। ১৯১০ সালে পঁয়ত্রিশ হাজার সাইকেল আমদানি করা হয় ব্রিটেন থেকে। ১৯৪০-য়ে বেড়ে হয় সত্তর হাজার। ভারতে বিড়লা-রা প্রথম সাইকেল উৎপাদন শুরু করে।১৯৩৯ সালে। বছরে সাড়ে পাঁচ লক্ষ সাইকেল তৈরি করা হবে এমন কথা দিলেও তা কাজে পরিণত হয়নি – কারণ তারা অনেক বেশি ঝুঁকে পড়েছিল অ্যাম্বাসেডার গাড়ি তৈরির দিকে।লোকসানের কারণে ১৯৭৪ সালে ভারত হয় সরকার সংস্থাটি অধিগ্রহণ করে। এখন সেটিও মৃত্যুপথযাত্রী।

বেসকারি উদ্যোগে আসানসোলের সাইকেল কারখানা সেন র‍্যালে যাত্রা শুরু করে ১৯৫২ সালে। তাদের সাইকেল বিদেশেও রপ্তানি হত। কিন্তু সেই সংস্থারও মৃত্যু হয়েছে অল্পকালের মধ্যে। রাজ্যে তৃণমূল সরকার ক্ষমতায় এসে স্কুলে সাইকেল বিতরণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় পশ্চিমবঙ্গে কোনও সাইকেল কারখানা নেই ।

অথচ সারা পৃথিবী জুড়ে চলেছে সাইকেলের জয়যাত্রা। কেবল নেদারল্যান্ডস বা চিন নয়, আমেরিকার মত সদাব্যস্ত দেশেও সাইকেলের কদর বাড়ছে। কারণ এই যানটি পরিবেশবন্ধু বলে। আজ ২০০ বছর পেরিয়ে এসে আমরা যদি সাইকেলের প্রয়োজনীয়তা সহানুভূতি দিয়ে বিচার করি তাহলে এই অবস্থাটা বদলাতে পারে। মনে রাখা দরকার, ভারতে সাইকেলের প্রথম আবির্ভাব কলকাতা শহরেই ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.