হিপি, বিট-রা হল, জাঁ পল সার্ত্রর ‘নসিয়া’ (Nausea) গ্রন্থের সেই হতভাগ্য ‘হিউম্যানিস্ট’রা, যাঁদের প্রয়োজন আজকে ফুরিয়ে গেছে, যাঁরা চিরদিনের মতো নির্জনতার রাজ্যে প্রবেশ করেছে—হঠাৎই আজ তার সামনে সব ভেঙে পড়েছে, সংস্কৃতির সব স্বপ্ন, মানুষের সঙ্গে মানুষের পরিচয় ও প্রীতির সব স্বপ্ন (That poor humanist whom men don’t want any more…now he has entered into solitude—forever. Everything has collapsed at once, his dreams of culture, his dreams of an understanding with mankind.)। এরাই উদ্ভ্রান্ত, আলুথালু বেশে যাযাবরের মতো যন্ত্রযুগের সমাজ-সভ্যতার বিরুদ্ধে অনুচ্চার বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলো। যে বিদ্রোহের আগুন এখনও নেভেনি; জ্বলছে সারা বিশ্বে, আমাদের দেশে, আমাদের শহরে… কলকাতায়। সারা পৃথিবীতে, নিউইয়র্ক লন্ডন থেকে কলকাতা পর্যন্ত এসে পৌঁছেছিল হিপি-বিট’রা। কেন?
বেশিরভাগ মানুষ, যাঁরা সবসময় আওড়াতে চায় শেখানো বুলি এবং অসাড় হয়ে মুখ বন্ধ রাখে বিকট উদাসীনতায়, তাঁরা বাদে কিছু মানুষ এমনও থাকেন, প্রশ্নহীন প্রথাগত সবকিছু মেনে নেওয়াকে যাঁরা মেনে নিতে জানেন না, নতুন কিছু তৈরির পক্ষে; আমরা তাঁদের শিল্পী বলতে পারি, লেখক/কবি বলতে পারি, বিদ্রোহী বলতে পারি, ‘মানুষের মতো মানুষ’ বলতে পারি। ৫০, ৬০ -এর দশক, একনায়ক যুদ্ধবাজদের খুঁড়ে তোলা পৃথিবীকে তখন অভ্যস্ত করানো হচ্ছে বুলেটের সঙ্গে, বোঝানো হচ্ছে কাঁটাতারের গুরুত্ব – মানবিকতা মৃত! সেই সময় সারা পৃথিবী জুড়ে এক ঝাঁক মানুষ, বিশেষত যে তরুণদল এই গড্ডালিকা স্রোতে ভেসে যেতে চায়নি, তাঁরাই ‘হিপ-জেনারেশন’ বা ‘বিট-জেনারেশন’; ‘হিপি’, ‘বিটল’ নামেই তারা বেশি পরিচিত। হিপিদের একমাত্র চাহিদা ছিল অহিংসা, নির্জনতা, প্রেম-ভালোবাসা-আত্মীয়তা।
কলকাতার ফুটপাতে অ্যালেন গিনসবার্গ
১৯৫৫ সালে আমেরিকা আর ভিয়েতনাম যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে, তখন আমেরিকার রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মীরা এর বিরোধিতায় সোচ্চার হন। দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে ভিয়েতনাম যুদ্ধবিরোধী বিক্ষোভ, শুরু হয় ‘হিপি মুভমেন্ট’। সেইসময়ের আমেরিকান লেখক, কবি, গায়ক, বাদক, শিল্পী, ছাত্রছাত্রী সকলেই এই যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহন করেছিলেন। একেবারে সামনের সারিতে ছিলেন বিট প্রজন্মের আমেরিকান কবি অরউইন অ্যালেন গিনসবার্গ, যিনি ফুলকে হাতিয়ার বানিয়েছিলেন, যুদ্ধের বিপরীতে যাঁর শব্দবন্ধ ‘ফ্লাওয়ার পাওয়ার’ সারা বিশ্বকে নাড়িয়ে দিয়েছিল, যিনি তাঁর ভারতভ্রমনের অধিকাংশ সময়টাই কাটিয়েছিলেন তাঁর প্রিয় শহর কলকাতায়। সে সময় আমেরিকায় তিনি চরম বিতর্কের কেন্দ্রে। বিট সাহিত্য আন্দোলন, যুদ্ধবাজ মার্কিন প্রশাসনের তীব্র সমালোচনা, কিউবার পক্ষ সমর্থন, সমকামিতা, ভিয়েতনাম-যুদ্ধের বিরোধিতা এসব তো ছিলই, তার সঙ্গে ‘হাউল’ লেখার দায়ে পুলিশ তাঁর কবিতাও বাজেয়াপ্ত করে। গিনসবার্গ-কে কলকাতা আসার টাকা দিয়েছিলেন ব্রিটেনের জনপ্রিয় রক-ব্যান্ড ‘রোলিং স্টোনস’-এর কিথ রিচার্ডস। কলকাতায় এসে লেখকবন্ধু পিটার অরলোভস্কি, জন গিয়ার্নো-কে নিয়ে উঠেছিলেন চাঁদনীর আমজাদিয়া হোটেলে। থেকেছিলেন বুদ্ধদেব বসুর বাড়িতে, আবার কখনও হাংরি-কবি মলয় রায়চৌধুরি, সমীর রায়চৌধুরির পাটনার ‘চাইবাসা’য়।
গিনসবার্গ, কেরুয়াক, কর্সো, বব কফম্যান, ফালেৎগেত্তি মতো বিট কবিরা তখন খালি পায়ে হাঁটতেন, চুল-দাঁড়ি কামাতেন না, মানুষের কাছে কাপড়-জামা চেয়ে নিয়ে পরতেন। তাদের কবিতা, গানে উঠে আসতো প্রথা ভাঙবার সুর। তখন এত ‘ইমিগ্রেশন’, ‘ভিসা-পাসপোর্ট’ এসবের রমরমা শুরু হয়নি, তা-ই বিট জেনারেশনের প্রভাব সরাসরি ছড়িয়ে পড়েছিল পাশ্চাত্য থেকে প্রাচ্যে। ষাটের দশকে ব্রিটেনে অ্যাংরি জেনারেশন, ঢাকায় সাক্ষর, কণ্ঠস্বর গোষ্ঠী, ভারত তথা কলকাতায় হাংরি আন্দোলন গড়ে ওঠার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ অনুপ্রেরণা ছিল বিট জেনারেশনই। তবে, প্রতিটি আন্দোলনেরই নিজস্বতা ছিল।
চাঁদনির আমজাদিয়া হোটেলের ছাদে গিনসবার্গ এবং অরলোভস্কি
‘হিপি’ কারা এবং কেন, এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে সমাজ কখনই আগ্রহী ছিল না, বরং বরাবরই তাদের কৌতূহল হিপিদের নেশা আর বেশভূষা নিয়ে। ১৯৬৯ সালে, আমেরিকার মনোবিজ্ঞানী ডক্টর জন ইগান যখন কলকাতায় এসেছিলেন, তখন তাঁকে প্রশ্ন করা হয়, কেন হিপিরা সুদূর আমেরিকা থেকে, সেখানকার ভূরিসমাজের (অ্যাফ্লুয়েন্ট) ভোগবিলাস আর প্রলোভন ছেড়ে, ভারতের হিমালয় থেকে কলকাতা-হাওড়ায় এসে পৌঁছাচ্ছেন? উত্তরে ইগান বলেন, ভূরিসমাজের ভোগবিলাসিতা ও সুখোচ্ছাসের (ইউফোরিয়া) প্রতি অনাসক্তি থেকে যন্ত্রজর্জর, নীরেট আমলা-অধুষ্যিত সমাজের চালাকি ও কৃত্রিমতার বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ নির্জন বিদ্রোহই ছিল হিপিদের মূল বৈশিষ্ট্য।সমাজের মূলস্রোতের বাইরে শান্তির খোঁজে ব্রতী ছিল তারা, যে শান্তি তারা পেয়েছিল ভারতের অতীন্দ্রীয় জীবানানুভূতির ভিতর, ধ্যান-যোগসাধনার ভিতর, কলকাতার মিশ্রসংস্কৃতি-সাহিত্যপ্রেমের ভিতর। জৈন-বৌদ্ধধর্ম তাদের চেতনায় গভীরভাবে প্রভাব ফেলেছিল। হিপিরা বলতেন, গৌতম বুদ্ধ একজন আদি-অকৃত্রিম হিপি এবং যিশুখ্রীষ্টও একজন হিপিশ্রেষ্ঠ (Buddha was one of the original hippies…jesus was the first hippie you know)।
হিপি-বিদ্রোহ আর আমেরিকার তরুণ ছাত্র-বিদ্রোহের সামাজিক উৎস অনেকটাই এক। তবে, তখন সারা পৃথিবীজুড়ে ‘ইয়ুথ রিভোল্ট’ বা তরুণবিদ্রোহের দু’টি ভিন্ন ধারা তৈরি হয়েছিল, যে দু’টি ধারা এখনও সমাজে স্পষ্ট।একটি ধারা ‘ছাত্রবিদ্রোহ’—যার ভিতর দিয়ে নতুন ছাত্রশক্তির (স্টুডেন্ট পাওয়ার) উদ্ভব হবে, এটি ‘পজিটিভ’ ধারা। অন্য ধারাটি হল—হিপি-বিটনিকদের আত্মান্বেষী আন্দোলনের ধারা, যাকে জীবনবিদ্রোহ বলা যায়। এটি ‘নেগেটিভ’ ধারা। ‘নেগেটিভ’ কারণ সমাজে হিপিরা ছিল ‘রেড ওয়ার্নিং লাইটে’র মতো। মাঝে মাঝেই সমাজের যত নীতি-পুলিশ তেড়ে আসত তাদের দিকে, কারণ সমাজের আর পাঁচটা মানুষের কাছে যা ছিল না, হিপিদের কাছে তাই ছিল; মানবিকতা-মুক্তচিন্তা-ভালোবাসা-সাহস-স্বাধীনতা। একবার ক্যালিফোর্নিয়ায় হিপিদের একটা বিখ্যাত আড্ডায় একজন কৌতূহলী দর্শক প্রশ্ন করেছিলেন, ‘আমার জানতে ইচ্ছে করে, এইভাবে জীবনযাপন করার ও বেঁচে থাকার ব্রত আপনারা গ্রহন করেছেন কেন?’
একটুও সময় না নিয়ে সটান উত্তর দিয়েছিলেন এক হিপি তরুণীঃ
‘আপনার নিজের দিকে চেয়ে দেখেছেন? কে আপনি? বেশ ভালো করে চেয়ে দেখুন। কোনও মানুষের সঙ্গে সহজভাবে প্রাণ খুলে কথা বলতে পারেন না, বলতে গেলে দু-তিন পেগ সুরা চড়িয়ে নিজের মুখোশটা ফেলে দিতে হয়। কেন হয়? যে-কোনও নীতি, যেকোনও মানবিক গুণ, কড়ির মূল্যে আপনারা কিনতে পারেন, নারীর নারীত্ব, ব্যবসায়ীর সততা সবই কড়ির স্পর্শে উবে যায়। আপনারা শান্তির কথা, অহিংসার কথা, মানবতার কথা, মানবিক অধিকারের কথা, স্বাধীনতার কথা দিনরাত বেতারে সংবাদপত্রে এবং হাজার হাজার বইতে প্রচার করেন, অথচ নোংরা রাজনীতি-যুদ্ধে নিরীহ মানুষ হাজারে হাজারে হত্যা করতে আপনাদের সংকোচ হয় না। অহরহ বলছেন যে, যন্ত্র দিয়ে এ পৃথিবীকে স্বর্গ বানিয়ে ফেলবেন। কিন্তু তবু কেন আজও পৃথিবীর অধিকাংশ অসহায় মানুষ নরকযন্ত্রণা ভোগ করছে? লক্ষ লক্ষ আত্মহত্যা করছে? খুনোখুনি মারামারি করছে? মানুষের স্বাভাবিক অধিকার ও মর্যাদা আজও আপনারা ‘সাদা-কালো’র ভিত্তিতে বিচার করেন, অথচ আপনাদের বড় বড় আদর্শের বুলিতে কানের পর্দা ফাটার উপক্রম। বিজ্ঞান আর বিজ্ঞানী আজ আপনাদের টাকার গোলাম, আপনাদের মুনাফার বিকট হাড়িকাঠে উৎসর্গিত। সেই বিজ্ঞান দিয়ে আজ আপনারা সর্বসংহারক মারণাস্ত্রের পরীক্ষায় পৃথিবীর জল হাওয়া বাতাস বিপন্ন করে তুলেছেন। এই তো আপনাদের সমাজ ও সভ্যতা, এবং এই সভ্যতারই একজন প্রতিমূর্তি আপনি, যিনি আসল জায়গায় প্রশ্ন করতে শেখেননি। আপনাদের থেকে আমাদের শিখতে হবে, আমরা কীভাবে বাঁচবো?’
জ্যাক কেরুয়াক, যিনি ছিলেন বিটনিকদের ‘প্রিন্স’, তিনি তাঁর একটি লেখায় (ভিজনস অফ জিরার্ড অ্যান্ড ট্রিসটেস, ১৯৬৪) প্রশ্ন করেছেনঃ ‘মানুষকে এত দুঃখকষ্ট ভোগ করতে হয় কেন? কেন আমরা আশায় উদ্ভাসিত মানুষের প্রশস্ত ললাট লক্ষ্য করে তপ্ত লোহার শলাকা ছুঁড়ে মারি?’ উত্তরে একটি চরিত্রকে দিয়ে তিনি বলিয়েছেন, ‘জিরার্ড, তুমি ছেলেমানুষ, তাই এখনও জান না—জীবনটাই একটা জঙ্গল, যেখানে মানুষ খাচ্ছে মানুষকে,–হয় তুমি খাবে, না হয় তোমাকে খাবে, যেমন বেড়াল ইঁদুর খাচ্ছে, ইঁদুর পোকা খাচ্ছে…এবং আমাদের এই খাওয়া-খাওয়ি শেষ হলে অবশেষে পোকায় খাবে আমাদের।’ (There’s no explaining your way out of the evil of existence—‘in any case, eat or be eaten’—we eat now, later on the worms eat us.)
এপ্রসঙ্গে মনে পড়ছে রবীন্দ্রনাথের ‘শিশুতীর্থে’র সেই অমোঘ লাইন- ‘রাত কত হইল?’ যা পরে ঋত্বিকের ‘সুবর্ণরেখা’-তেও বিজন ভট্টাচার্য অভিনীত চরিত্রের কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছিল, ‘রাত কত হল, উত্তর মেলে না’। আজকের কলকাতার দিকে তাকালে, কলকাতার বিশ্ববিদ্যালয়গুলি তথা তরুণসমাজের দিকে তাকালে বোঝা যায়, ব্যারিকেড ভাঙা ‘পজিটিভ’ ছাত্র-আন্দোলনের সঙ্গে হিপি-বিটদের সেই সহজিয়া ‘নেগেটিভ’ বিদ্রোহও তাদেরকে অনুরণিত করে, প্রতিবাদ জানানোর অস্ত্র হিসেবে তারাও ব্যবহার করছে ‘ফ্লাওয়ার পাওয়ার’, স্লোগান, মুক্ত ভাবনা, গান, প্রবন্ধ, কবিতা। আর এভাবেই ৬০-এর কলকাতার হিপি-বিটনিক-‘নেগেটিভ’ বিদ্রোহ আজও বেঁচে আছে… এই সময়ে।
মৌনী মন্ডল