১৯৭৯ সালে মুক্তি পেয়েছিল সত্যজিৎ রায়ের ছবি ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’। তার প্রায় ১৭ বছর পরে টেলিভিশনের পর্দার জন্য তাঁরই পুত্র সন্দীপ রায় বানান ‘বাক্স রহস্য’ (১৯৯৬)। সত্যজিৎ পরবর্তী সময় বাংলা চলচ্চিত্র জগৎ ভুলেই গিয়েছিল ছবি নির্মাণের জন্য বাংলায় বিশাল ও বিপুল সাহিত্য সম্ভার আছে। এখনকার বাঙালি সমাজ বুঝি তার মাসুল দিতে গিয়ে বারবার ফেলুদা ও ব্যোমকেশকে খোঁচা মেরে প্রায় ‘মৃত বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি’-কে চাঙ্গা করতে উদ্যোগী হচ্ছে। প্রশ্ন ওঠে শুধু সেটাই কি কারণ, বারংবার এই ব্যোমকেশ আর ফেলুদাকে নিয়ে এই পরিমাণে টানাটানি করার?
এর উত্তরটা বোধহয় সহজে দেওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু একটা প্রচেষ্টা করা যেতে পারে সেই উত্তরের দিকে পৌঁছাবার। রহস্য-রোমাঞ্চ গপ্পের ওপর ভিত্তি করে ছবি বানাবার ও ক্রমাগত তাকে বৃহত্তর ব্যবসার ফর্মুলা হিসেবে চিহ্নিত করার নজির পৃথিবীতে নতুন কিছু নয়। ১৯১৪-১৫ সালে যখন জার্মানি দেশ হিসেবে ইউরোপে সাংঘাতিক ভাবে কোন ঠাসা হয়ে পড়েছে, তখন তারা একেবারেই দেশীয় এক শিল্প ধারার জন্ম দেয়, যার নাম পরে আমরা জেনেছি, ‘জার্মান এক্সপ্রেশনিজম’। এই এক্সপ্রেশনিস্ট মুভমেন্টকেই বলা যেতে পারে বিশ্বে প্রথম ভৌতিক বা থ্রিলার ধর্মী ছবি বানাবার পথিকৃৎ। ফ্রিৎস ল্যাং থেকে শুরু করে এফ ডাব্লিউ মুরনাউদের মতো পরিচালকেরা সস্তায় পুষ্টিকর ছবি বানিয়ে তাঁদের দেশীয় দর্শকদের মনোরঞ্জিত করে রেখেছিলেন। কিন্তু সেই মনোরঞ্জন শান্ত, গভীর, ছবির মাধ্যমে করা যায়নি। তৈরি হয়েছিল কিছু সেই সময়ের জন্য হাড়হিম করা ভয়ের ছবি, যার মধ্যে অন্যতম ছবি ছিল ‘নসফেরাতু’ (১৯২২)। ব্রাম স্ট্রোকারের ড্রাকুলার ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয় সেই ছবি। এই ছবিগুলির প্রযোজনা হত অত্যন্ত স্বল্প অর্থ লগ্নির মাধ্যমে। কিন্তু দেশের মানুষকে মজিয়ে রাখতেই হবে, তাই সেখানে শৈল্পিক কিছু ট্রিটমেন্ট করা হত যাতে ছবি দেখার ‘থ্রিল’ কোনোভাবে কমে না যায়। অতিরঞ্জিত সেট ডিজাইন থেকে শুরু করে বিকট মেকআপ ও সাজগোজ ছিল তাদের সামগ্রী। ঠিক একই রকমের অভ্যুত্থান দেখা যায় চল্লিশের দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে।
মাল্টিস ফালকন (১৯৪০)
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের এক অন্যতম প্রারম্ভিক কারণ ছিল বড়ো অর্থনৈতিক বিপর্যয়। তার আঁচ লেগেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গায়েও। এবং তা সমস্যার মুখে ফেলেছিল তৎকালীন হলিউড নির্মাতাদের। একটু ফিরে যাই সেই সাদাকালো যুগে, হামফ্রি বগার্ডের অভিনয় ‘মাল্টিস ফালকন’-এ (১৯৪০)। একজন পেশাদার গোয়েন্দা, তাঁর কাছে আসছে একজন রহস্যময়ী মহিলা এবং সঙ্গে আসছে রহস্যের ঢেউ। তৎপরবর্তী আমরা শার্লক হোমসের মতো একজন, মার্কিন ডিটেকটিভকে দেখতে পাচ্ছি রহস্য সমাধানে ঝাঁপিয়ে পড়তে। এই ছবি আমরা বহু গোয়েন্দা সমগ্রের প্রচ্ছদে সেই সুপরিচিত মার্কিং হ্যাট আর লং কোটের আধিপত্য দেখেছি। এভাবেই এক ধরনের রহস্য ঘন ফিল্মের যাত্রা শুরু হল এবং তা মজিয়ে রাখলো মার্কিন জনগণকে। আগলে রাখলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা থেকে।
নোয়ার ভুক্ত যত ছবি আছে তা সবই স্বল্প পুঁজির ব্যবহারে বানানো কাজ। যা রগরগে প্রেম, খুন রাহাজানি, বিভিন্ন ধরনের ক্রাইমের আবহে বোনা কাহিনির আধারে তৈরি। সেই সময়ের এই সব ছবি এক গভীর প্রভাব তৈরি করেছিল সত্যজিৎ রায়ের মধ্যে, যার ফলস্বরূপ আমরা পেয়েছি ‘সোনার কেল্লা’ ও ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’-এ বিখ্যাত সব ফ্রেম, যেখানে আলো আর আঁধারকে ব্যবহার করে সত্যজিৎ রায় রহস্যের আবহ ও আবেগ তৈরি করেছিলেন। তারও আগে সত্যজিতের মধ্যে নোয়ারের প্রগাঢ় প্রভাব লক্ষণীয় ‘চিড়িয়াখানা’ ছবিতে, যেখানে লাইটিং থেকে বিপণনের নকশা সমস্তটা নোয়ার চিত্রের ধাঁচে তৈরি করা হয়েছিল।
সত্যজিৎ রায়ের চিড়িয়াখানা
২০২৩-এর জানুয়ারি মাসে আমি গিয়েছিলাম কাশী ভ্রমণে। তিন দিনের ঝটিকা সফর বলা যেতে পারে। তাই ঘাটের বাইরে এদিক ওদিক খুব একটা ঘোরা হয়ে ওঠেনি। যদিও সঙ্গে ছিলেন মানিকবাবু ও তাঁর সৃষ্ট উপন্যাস ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’। সর্বপ্রথম যে ব্যাপারটা তাক লাগিয়ে দিচ্ছিল বারবার, তা হল সত্যজিতের পরিমাপ। যে ভাবে তিনি ও তাঁর টিম রিয়েল লোকেশন আর স্টুডিওতে তৈরি সেটকে যেভাবে একাত্ম করে দিয়েছিলেন তা এখনও বাংলা ইন্ডাস্ট্রিতে ফিরে পাওয়া যায়নি। দশাশ্বমেধ ঘাটে ফেলু-তোপসে-জটায়ু আর ‘ক্যালকাটা লজের’ মালিক হেঁটে এসে দাঁড়ালেন, সেই অবধি তো ছবি পরিষ্কার। কিন্তু সেই যে মছলিবাবা বসে প্রবচন দিচ্ছেন সেই স্থানটা কোথায়? সেটা কিন্তু শ্যুট হয়েছিল কলকাতায়। কৃত্রিম উপায় বংশী চন্দ্রগুপ্ত গড়ে তুললেন দশাশ্বমেধ ঘাটের একটি অংশ। যদিও তা এতটাই নিখুঁত যে দেখে বোঝার উপায় নেই সেটা আসল না নকল।
পড়তে গিয়ে পাঠকদের মনে হতেই পারে, যে বাংলা ছবি বা তার অবস্থা নিয়ে কথা বললেই কি মানিকবাবু নামটি সিলেবাসের জুজুর মতো ধরা দেন? সমস্যা হচ্ছে এই মানুষটি ছবি নির্মাণের ক্ষেত্রে যে এলিট বাঙালিয়ানার আবহ তৈরি করেছিলেন, তারই উত্তরাধিকারত্ব প্রমাণ ও অধিকার হরণের তাগিদই এই বালখিল্য ভাবাবেগের কারণ। তাছাড়া শতবর্ষ পালনের ঠ্যালা সামলানো দায়। এক সময় আমাদের বাংলার প্রযোজককূল এই সমস্ত সাহিত্যকে ব্রাত্য করে বহুল মাত্রায় ‘বি’ গ্রেড ছবির নির্মাণ করে গেছে। সেখানে টিমটিমে কিছু আলোর মতো ছবি নির্মাণের আসল ফ্লেয়ার জ্বালিয়ে রেখেছিলেন বিদগদ্ধ কিছু পরিচালক। তারই মাশুল যেন দিতে হচ্ছে দর্শককে ফেলু-ব্যোমকেশকে নিয়ে তৈরি হওয়া এই বীভৎস অম্লশূলের জ্বালা সহ্য করে।
তবে সমস্যা আদতে কোথায় তার হদিশ না দিলে এই লেখা শুধুমাত্র উদ্দেশ্যহীন ভর্ৎসনা ছাড়া কিছুই থাকবে না। ছবির একটা ব্যবসার দিক আছে, যা বেজায় আস্তিক। লগ্নি তখনই হয়, শিল্পের মাধ্যমে নিশ্চিত লক্ষ্মীলাভের সম্ভাবনা থাকে। ফেলু বা ব্যোমকেশের গায়ে যে মাখো মাখো নস্টাজিয়ার মশলা আছে, তা এই লক্ষ্মীলাভের প্রক্রিয়াকে আরও বেশি শক্তিশালী করে এবং সেই সুযোগের ফায়দা তোলা বাঙালি নির্মাতাদের (পরিচালক ও প্রযোজক) কাছে একটা জ্যাকপটের মতো, যা কেউ হাতছাড়া করতে চান না। কিন্তু সেই নির্মাণে সত্যজিৎ রায় যে শৈল্পিক মুন্সিয়ানার প্রয়োগ করেছিলেন তার নিদর্শন বর্তমানে বিরল হয়ে উঠেছে।
সত্যজিৎ রায়ের জয় বাবা ফেলুনাথ
শেষ করব একটা ছোট্ট ভ্রমণ কাহিনি দিয়ে। যেখানে আছে জয় বাবা ফেলুনাথের (উপন্যাস ও ছবি) স্মৃতি, কাশীর ঘাট ও কিছু উপলব্ধি। ২০২৩-এর জানুয়ারি মাসে আমি গিয়েছিলাম কাশী ভ্রমণে। তিন দিনের ঝটিকা সফর বলা যেতে পারে। তাই ঘাটের বাইরে এদিক ওদিক খুব একটা ঘোরা হয়ে ওঠেনি। যদিও সঙ্গে ছিলেন মানিকবাবু ও তাঁর সৃষ্ট উপন্যাস ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’। সর্বপ্রথম যে ব্যাপারটা তাক লাগিয়ে দিচ্ছিল বারবার, তা হল সত্যজিতের পরিমাপ। যে ভাবে তিনি ও তাঁর টিম রিয়েল লোকেশন আর স্টুডিওতে তৈরি সেটকে যেভাবে একাত্ম করে দিয়েছিলেন তা এখনও বাংলা ইন্ডাস্ট্রিতে ফিরে পাওয়া যায়নি। দশাশ্বমেধ ঘাটে ফেলু-তোপসে-জটায়ু আর ‘ক্যালকাটা লজের’ মালিক হেঁটে এসে দাঁড়ালেন, সেই অবধি তো ছবি পরিষ্কার। কিন্তু সেই যে মছলিবাবা বসে প্রবচন দিচ্ছেন সেই স্থানটা কোথায়? সেটা কিন্তু শ্যুট হয়েছিল কলকাতায়। কৃত্রিম উপায় বংশী চন্দ্রগুপ্ত গড়ে তুললেন দশাশ্বমেধ ঘাটের একটি অংশ। যদিও তা এতটাই নিখুঁত যে দেখে বোঝার উপায় নেই সেটা আসল না নকল।
ওয়েব সিরিজে ব্যোমকেশ বক্সী
এখনকার বাংলা ছবিতে বা সিরিজে যেটা সব থেকে বেশি করে অবর্তমান মনে হয় তা হল, সত্যজিতের মুন্সিয়ানা। মানিকবাবু গল্পকে স্ক্রিনে রূপান্তরিত করার ক্ষেত্রে সর্বদাই নিষ্ঠুর। তার নিদর্শন দেখা যায় আরও বেশি করে যখন তিনি নিজের গপ্পগুলোকেই ছবিতে রূপান্তরিত করেছেন।
কাশীতে গিয়েছি আর গঙ্গা ভ্রমণ করবো না, তা কি হয়? কিন্তু ভ্রমণ করার সময় একটাই কথা বারবার মনে হচ্ছিল, এত সুন্দর ছবি যেখানে উঠতে পারত সেখানে সত্যজিৎ রায় এই গঙ্গা ভ্রমণকে তাঁর ভিজ্যুয়াল ন্যারেটিভ থেকে বিরত রাখলেন কেন? উত্তরটা সহজেই পেলাম।
এক, বাজেট
দুই, সময়ানুবর্তিতা
তিন, স্টেডি শট নেওয়া যেত কিনা প্রশ্ন
চার, প্লট
সত্যজিৎ রায়ের কাছে প্লট ছিল সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সেখানে কোনোরকম ভাবে যেন বেনোজল না ঢোকে। সেই কারণেই হয়তো থ্রিলারধর্মী ছবি হিসেবে ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’-এর যে আবেদন, তা নতুন কোনো ফেলুদা বা ব্যোমকেশে নেই।
তংসু কর্মকার