বড়োপর্দায় ফেলুদার ৫০ বছর : সৌমিত্রের পর ফেলু মিত্তির হতে পারতেন অমিতাভ বচ্চন

নাম প্রদোষ চন্দ্র মিত্র। ধাম, ২১ রজনী সেন রোড। এই দুটি বাক্যই যথেষ্ট বাঙালি পাঠকের মনে আলোড়ন সৃষ্টি করার। ১৯৬৫ সালে প্রথম আবির্ভাব হয় চরিত্রটির। কিন্তু সৃষ্টির এত বছর পরেও এই ব্যাচেলার গোয়েন্দা চরিত্রটির জনপ্রিয়তা কিন্তু মোটেই কমেনি। সত্যজিৎ রায়ের সৃষ্ট এক চরিত্র থেকে ধীরে ধীরে কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছে প্রদোষ চন্দ্র মিত্র, বাঙালির প্রিয় ফেলুদা। সাহিত্য মহলে ফেলুদার প্রথম আত্মপ্রকাশ হয় ১৯৬৫ সালে। ‘সন্দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ফেলুদার প্রথম গল্প ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি। ফেলুদার দ্বিতীয় গল্প বাদশাহী আংটি প্রকাশিত হয় ১৯৬৬ সালে। এই গল্পটি খুব অল্প সময়ের মধ্যেই জায়গা করে নেয় পাঠকদের মনে। পাঠকমহলে অত্যন্ত জনপ্রিয়তা পায় ফেলুদা।

তবে সত্যজিৎ রায় বুঝেছিলেন ফেলু মিত্তির-কে আরো বৃহৎ পরিসরে মানুষের সামনে তুলে ধরতে হলে সর্বোত্তম মাধ্যম হবে সিনেমা। হলও তাই। ফেলুদাকে খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছে দেয় ফেলুদা সিরিজের প্রথম সিনেমা সোনার কেল্লা। ১৯৭৪ সালে মুক্তি পায় ছবিটি। ছবিতে ফেলুদার ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। তারপর আর ফেলুদাকে ঘুরে তাকাতে হয়নি। আপামর বাঙালি ফেলুদার সেই মগজাস্ত্রের ধারের সামনে সঁপে দিয়েছিল নিজেদের মন প্রাণ। ফেলুদা, তোপসে, লালমোহন গাঙ্গুলি, ডক্টর হাজরা, মুকুল- সবাই আজীবনের জন্য বন্দি হয়ে যায় দর্শকের মনে। শোনা যায়, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে দেখেই ফেলুদার প্রচ্ছদ এঁকেছিলেন সত্যজিৎ রায়। ১৯৭৪-এর পাঁচ বছর পর অর্থাৎ, ১৯৭৯ সালে ফের একবার বড়োপর্দায় ফেলুদাকে নিয়ে আসেন সত্যজিৎ রায়। আগে একবার গন্তব্য ছিল জয়সলমীর, এবার গন্তব্য বেনারস। তৈরি হল জয় বাবা ফেলুনাথ। এই জয় বাবা ফেলুনাথের দৌলতে বাঙালি পেল তার অন্যতম আইকনিক ভিলেন মগনলাল মেঘরাজ-কে। চরিত্রায়নের দিক থেকে বরাবরই প্রচণ্ড সংবেদনশীল ছিলেন সত্যজিৎ রায়। ফেলুদা হোক কিংবা জটায়ু, মগনলাল মেঘরাজ হোক কিংবা মছলি বাবা- সবকিছুই একদম ‘ছবি’র মতো। সেই কারণেই সন্তোষ দত্তের মৃত্যুর পর আর ফেলুদা বানাতে চাননি সত্যজিৎ রায়। জটায়ু চরিত্রে সন্তোষ দত্ত ছাড়া কাউকেই কল্পনা করতে পারছিলেন না তিনি।

পরবর্তীকালে অবশ্য ফেলুদা নিয়ে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে। অনেকেই ফেলুদার ভূমিকায় অভিনয় করেছেন। কখনও দর্শক সেটা মেনে নিয়েছে, কখনও মেনে নেয়নি। তবে এসবের মাঝে চিরন্তন থেকে গিয়েছে বাঙালির আবেগ। ফেলুদা পাল্টেছে প্রতিনিয়ত, বিগত কয়েক বছরে একটু বেশিই। কিন্তু যা পাল্টায়নি, তা হল ফেলুদার প্রতি বাঙালির ভালোবাসা। বাংলার সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে গিয়েছে ফেলুদা, তোপসে, লালমোহনবাবু-রা। সেই ১৯৭৪ সালের ‘সোনার কেল্লা’ থেকে আজকের ‘সাব্বাশ ফেলুদা’। ১৯৭৪ থেকে আজ ২০২৩।

তবে সত্যজিৎ রায় নিজে আর ফেলুদা বানাতে না চাইলেও, চেয়েছিলেন ফেলুদাকে গোটা দেশের দর্শকের সামনে তুলে ধরতে। এই কারণেই ১৯৮৫-৮৬ সালে যখন দূরদর্শন একটি টিভি সিরিজের জন্য সত্যজিৎ রায়কে ফেলুদা বানানোর অনুরোধ করলেন, মানিকবাবু চেয়েছিলেন ফেলুদার ভূমিকায় অমিতাভ বচ্চন যেন অভিনয় করেন। আশির দশকে অমিতাভের ক্যারিয়ার গ্রাফ তখন তুঙ্গে। স্বভাবতই তিনি ফেলুদার ভূমিকায় অভিনয় করলে আরও বেশি দর্শকের কাছে পৌঁছে যেত ফেলুদা। কিন্তু সেটি আর বাস্তবায়িত হয়নি। এই প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে সন্দীপ রায় বলেছিলেন, “আমরা যত কাণ্ড কাঠমান্ডুতে-কেই হিন্দিতে নিয়ে আসার পরিকল্পনা করেছিলাম। নাম দেওয়া হয়েছিল, ‘কিসসা কাঠমান্ডু মে’। বাবা চেয়েছিলেন অমিতাভ বচ্চন এই চরিত্রে অভিনয় করুন। ওঁকে এই চরিত্রে দেখার প্রবল ইচ্ছে ছিল বাবার। ওঁর সঙ্গে কথাবার্তাও শুরু হয়েছিল। তবে এই সিরিজের শ্যুটিংয়ের জন্য অনেকটা সময়ের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু, উনি সেই সময় ভীষণ ব্যস্ত। ওঁর হাতে পরপর কাজ থাকায় ফেলুদার চরিত্রে অভিনয় করতে পারেননি।”

পরবর্তীকালে অবশ্য দূরদর্শনের সৃষ্টিতে ফেলুদার ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন শশী কাপুর। তোপসের ভূমিকায় দেখা গিয়েছিল অলংকার শাহকে, জটায়ুর চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন জনপ্রিয় মারাঠি অভিনেতা মোহন আগাসে। দূরদর্শনের জন্য সিরিজটি পরিচালনা করেছিলেন সত্যজিৎ রায়ের পুত্র সন্দীপ রায়। তবে সত্যজিৎ রায় নিজের জীবদ্দশায় আর কোনো ফেলুদা বানিয়ে কিংবা দেখে যেতে পারেননি। সত্যজিৎ রায়ের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র সন্দীপ রায় ফেলুদার সিনেমা তৈরি করতে লাগলেন একে একে। বাংলায় টেলিসিরিজে ‘ফেলুদা ৩০’ সিরিজের জন্য পাঁচটি কাহিনি নির্বাচিত হয়। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, ফেলুদার ভূমিকায় অভিনয় করবেন কে? ততদিনে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের যথেষ্ট বয়স হয়ে গিয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই তাকে আর ফেলুদার চরিত্রে মানাতো না। এহেন অবস্থায় বাঙালি পেল তার দ্বিতীয় ফেলুদাকে। ফেলুদার ভূমিকায় অভিনয় করার জন্য এগিয়ে এলেন সব্যসাচী চক্রবর্তী।

১৯৯৬ সালে ‘বাক্স রহস্য’ দিয়ে ফেলুদার ভূমিকায় আত্মপ্রকাশ করেন সব্যসাচী চক্রবর্তী। এরপর ছোটোপর্দায় একের পর এক ফেলুদার চরিত্রে অভিনয় করে দর্শকের মন জয় করে নেন তিনি। অল্প সময়ের মধ্যেই সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মতোই ফেলুদা হিসেবে আইকনিক হয়ে গেলেন সব্যসাচীও। ‘ফেলুদা ৩০’ ছাড়াও ‘সত্যজিতের গপ্পো’-র জন্য চারটি ফেলুদাকাহিনি চলচ্চিত্রায়িত হয়, এছাড়াও ই-টিভি বাংলার ‘সত্যজিতের প্রিয় গপ্পো’-তে হয় ‘ডা. মুনসীর ডায়রি’। ছোটোপর্দায় ফেলুদা হিসেবে এসেই প্রথমেই ছক্কা হাঁকালেন সব্যসাচী চট্টোপাধ্যায়। তোপসের ভূমিকায় অভিনয় করলেন শাশ্বত চ্যাটার্জি। তবে জটায়ুর চরিত্রে কে অভিনয় করবেন এটি নিয়েও বেশ ভাবনায় ছিলেন নির্মাতারা। অবশেষে এই কিংবদন্তি চরিত্রটিতে অভিনয় করলেন আরেক কিংবদন্তি অভিনেতা, রবি ঘোষ।

রবি ঘোষ প্রয়াত হওয়ার পর লালমোহন গাঙ্গুলির জুতোয় পা গলান অনুপ কুমার ও বিভু ভট্টাচার্য। দুই অভিনেতাই নিজেদের মতো করে সুন্দর ফুটিয়ে তুলেছিলেন এই আইকনিক চরিত্রটি। দীর্ঘ সময়ের বিরতির পর ছোটোপর্দা ছেড়ে ফের একবার বড়োপর্দায় প্রত্যাবর্তন হল প্রদোষ চন্দ্র মিত্রের। ২০০৩ সালে সন্দীপ রায়ের পরিচালনায় বড়োপর্দায় মুক্তি পেল ‘বোম্বাইয়ের বোম্বেটে’। তারপর ‘কৈলাসে কেলেঙ্কারি’ (২০০৭), ‘টিনটোরেটোর যীশু’ (২০০৮), ‘গোরস্থানে সাবধান’ (২০১০)-সহ তালিকা বেশ লম্বা। এই ছবিগুলিতে তোপসের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন পরমব্রত চট্টোপাধ্যায় এবং সাহেব ভট্টাচার্য। লালমোহন গাঙ্গুলির ভূমিকায় বিভু ভট্টাচার্য। ২০১২ সালে মুক্তি পায় ফেলুদা সিরিজের অন্যতম জনপ্রিয় ছবি ‘রয়েল বেঙ্গল রহস্য’। সেখানে শেষবারের মতো জটায়ুর ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন বিভু ভট্টাচার্য। বিভু ভট্টাচার্যের মৃত্যুর পর এই চরিত্রের চরিত্রায়ন নিয়ে তৈরি হয়েছে এক শূন্যস্থান। তারপর অনেক অভিনেতাই অভিনয় করেছেন জটায়ুর চরিত্রে, তবে কেউই সেরকম দাগ কাটতে পারেননি।

পরবর্তীকালে অবশ্য ফেলুদা নিয়ে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে। অনেকেই ফেলুদার ভূমিকায় অভিনয় করেছেন। কখনও দর্শক সেটা মেনে নিয়েছে, কখনও মেনে নেয়নি। তবে এসবের মাঝে চিরন্তন থেকে গিয়েছে বাঙালির আবেগ। ফেলুদা পাল্টেছে প্রতিনিয়ত, বিগত কয়েক বছরে একটু বেশিই। কিন্তু যা পাল্টায়নি, তা হল ফেলুদার প্রতি বাঙালির ভালোবাসা। বাংলার সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে গিয়েছে ফেলুদা, তোপসে, লালমোহনবাবু-রা। সেই ১৯৭৪ সালের ‘সোনার কেল্লা’ থেকে আজকের ‘সাব্বাশ ফেলুদা’। ১৯৭৪ থেকে আজ ২০২৩। ক্যালেন্ডারের হিসেবে অতিবাহিত হয়েছে প্রায় পাঁচ দশক। বড়োপর্দায় ফেলুদার ৫০ বছর-এর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে রয়েছি আমরা। ফেলুদা রূপে বাঙালি প্রত্যক্ষ করেছে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, সব্যসাচী চট্টোপাধ্যায় থেকে আজকের আবির চ্যাটার্জি, টোটা রায়চৌধুরী, পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়দের। ফেলুদা আজও আমাদের জীবনে সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। ফেলুদাকে নিয়ে যিনিই ছবি বানান না কেন, যিনিই অভিনয় করুন না কেন, বাঙালি টিকিট কেটে হল ভরাবেই। এখানেই ফেলুদার সার্থকতা, এখানেই প্রদোষ চন্দ্র মিত্রের অমরত্ব।

অরুণাভ নাগ রায়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.