রেলগেটকে ঢাল করেই সোনার দোকানে ডাকাতির ছক! ব্যারাকপুরে ‘ধুম’ কায়দায় পালায় দুষ্কৃতীরা

সামনেই পুলিশের ডেরা। গোয়েন্দাদের নাকের ডগায় চুরি করে চোখের সামনে দিয়ে নিমেষে উধাও যাচ্ছে বাইক বাহিনী! অভিষেক বচ্চন এবং জন আব্রাহাম অভিনীত সেই ‘ধুম’ সিনেমার কায়দাতেই ব্যারাকপুরের সোনার দোকানে ডাকাতি ও খুন করে চম্পট দিয়েছিল ডাকাতের দল। প্রাথমিক তদন্তের প্রেক্ষিতে এমনটাই মনে করছেন গোয়েন্দাদের একাংশ। তাঁদের অনুমান, পুলিশের চোখে ধুলো দিতে এ ক্ষেত্রে ১৪ নম্বর রেলগেটকে ঢাল হিসাবে কাজে লাগিয়েছে দুষ্কৃতীরা।

বুধবার সন্ধ্যায় উত্তর ২৪ পরগনার ব্যারাকপুর স্টেশনের কাছেই আনন্দপুরীর একটি সোনার দোকানে ডাকাতি হয়। দুষ্কৃতীদের ছোড়া গুলিতে ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় দোকানমালিক নীলরতন সিংহের পুত্র নীলাদ্রি সিংহের (২৯)। গুলিবিদ্ধ হন নীলরতন এবং দোকানের নিরাপত্তারক্ষী শঙ্কর চক্রবর্তী। তাঁরা ব্যারাকপুরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে এখনও চিকিৎসাধীন। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, দুষ্কৃতীরা দু’টি মোটরবাইকে চেপে দোকানের সামনে আসে। দু’জন ভিতরে ঢোকে। বাকি দু’জন বাইরে ‘পাহারা’য় ছিল। দুই দুষ্কৃতীর মধ্যে এক জনের মাথায় হেলমেট, অন্য জনের টুপি। গয়না দেখার নাম করে লুটপাট শুরু করে তারা। বাইরে থাকা দুই দুষ্কৃতী বাইক চালু রেখেছিল। দোকান থেকে দু’জন বেরিয়ে আসতেই গুলি ছুড়তে ছুড়তে তারা বড়পোলের দিকে পালিয়ে যায়।

ব্যারাকপুরের ওল্ড ক্যালকাটা রোডের উপর যে সোনার দোকানটিতে ডাকাতি হয়েছে, সেটি ব্যারাকপুর রেলগেট এবং সেন্ট্রাল রোডের মাঝামাঝি জায়গায়। দোকানটি থেকে কয়েক মিনিটের দূরত্বেই লাটবাগান পুলিশ ব্যারাক এবং টিটাগর থানা। এলাকায় পুলিশি ব্যবস্থা জোরদার হওয়া সত্ত্বেও কী ভাবে ডাকাতি এবং খুনের ঘটনা ঘটে গেল, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন সকলে। দুষ্কৃতীরা কেন পুলিশের ডেরার এত কাছের দোকানকে ডাকাতির জায়গা হিসাবে বাছল, সেই প্রশ্নেও প্রথমে ধন্দে পড়ে গিয়েছিলেন গোয়েন্দারা। তবে তদন্তকারীদের একাংশের অনুমান, এ ক্ষেত্রে দুষ্কৃতীরা ব্যারাকপুর ১৪ নম্বর রেলগেটকেই ঢাল করেছে। কারণ, লাটবাগান থেকে বাহিনীই আসুক বা টিটানগর থানার পুলিশ— সকলকেই ওই দোকানে পৌঁছতে গেলে ১৪ নম্বর রেলগেট পেরোতে হবে। সন্ধ্যার সময় যখন একের পর এক আপ-ডাউন ট্রেন যায়, তখন একটা দীর্ঘ সময় ওই রেলগেট বন্ধ থাকে। ফলে এক বার যদি রেলগেটে কেউ ওই সময় আটকে যায়, বেরোতে অনেকটাই সময় লাগে। তদন্তকারীদের যুক্তি, টিটাগর থানা থেকে বিটি রোড থেকে ওল্ড ক্যালকাটা রোড ধরে মিনিট কুড়ি মতো লাগে সোনার দোকানের ঠিকানায় পৌঁছতে। রেলগেট বন্ধ থাকলে, লাগে আরও বেশি সময়। যার জেরে ২০ মিনিটের রাস্তা হয়ে যায় অন্তত আধ ঘণ্টার! ফলে পুলিশ যত ক্ষণে ঘটনাস্থলে পৌঁছবে, দুষ্কৃতীরা তত ক্ষণে ভিড়ের মধ্যে মিশে গিয়ে সহজেই কল্যাণী এক্সপ্রেসওয়েতে পৌঁছে যাবে। এক্সপ্রেসওয়েতে এক বার পৌঁছতে পারলে পিছু ধাওয়া কার্যত বৃথা!

গ্রাফিক— শৌভিক দেবনাথ।

এ ছাড়াও টিটাগর থানাটি বাজার এলাকার মধ্যে। সন্ধ্যার সময় সেই বাজার ভিড়ে গমগম করে। সেই ভিড় ঠেলে বেরোতে পারলেও বিটি রোড দিয়ে বাঁ দিকে ঘুরে ওল্ড ক্যালকাটা রোডে ওঠা যায় না। চিড়িয়া মোড়ের দিকে কিছুটা এগিয়ে গিয়ে ‘ইউ-টার্ন’ নিয়ে বাঁ দিকে ওল্ড ক্যালকাটা রোডে ঢুকতে হয়। তার পর রেলগেট। এক তদন্তকারীর কথায়, ‘‘ডাকাতির ছক কষার সময় শুধু এগ্‌জিট রুট বা কোন পথে পালানো হবে, তার পরিকল্পনা করে না ডাকাতেরা। পুলিশের ঘটনাস্থলে আসতে কত ক্ষণ সময় লাগতে পারে, কোন পথে পুলিশ তাদের ধাওয়া করতে পারে— এই সব দিক তারা ভাবনাচিন্তা করে। পুলিশ চটজলদি ঘটনাস্থলে পৌঁছে গেলে যে পালিয়ে লাভ হবে না, এটা তারাও খুব ভাল করে জানে।’’

কিন্তু দুষ্কৃতীদের গোটা পরিকল্পনায় জল ঢেলে দিয়েছে এলাকার সিসি ক্যামেরা। সোনার দোকানে ডাকাতি ও খুনের ঘটনার দেড় দিনের মাথায় দু’জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। ধৃতদের নাম সফি খান ও জামশেদ আনসারি। এই ঘটনায় জড়িত থাকার সন্দেহে আরও দু’জনকে আটক করা হয়েছে। তদন্তকারীদের সূত্রে জানা গিয়েছে, ঘটনার দিন দোকানে একটি ব্যাগ ফেলে গিয়েছিল দুষ্কৃতীরা। সেই ব্যাগ ও সিসি ক্যামেরার ফুটেজের সূত্র ধরেই বৃহস্পতিবার রাতে রহড়া থানা এলাকায় লুকিয়ে থাকা সফির খোঁজ মেলে। আটক করা হয় এই ঘটনায় ব্যবহৃত একটি মোটরবাইক। সোনার দোকানটির পাশেই দু’টি ব্যাঙ্কের এটিএম আছে। সেগুলির সিসি ক্যামেরার ফুটেজ এবং ওল্ড ক্যালকাটা রোডের বেশ কয়েকটি আবাসনের সিসি ক্যামেরার ফুটেজের সূত্রে বাইক দু’টিকে চিহ্নিত করেন তদন্তকারীরা। সফির সূত্রে খোঁজ মেলে জামশেদেরও। তত ক্ষণে অবশ্য জামশেদ বীরভূম হয়ে ঝাড়খণ্ডে পালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করে ফেলেছিল। এক তদন্তকারী বলেন, ‘‘শুক্রবার সকালে মুরারই হয়ে ঝাড়খণ্ডের সাহেবগঞ্জে পালানোর চেষ্টা করছিল জামশেদ। তাকে সেখান থেকেই ধরা হয়।’’

ধৃতদের জিজ্ঞাসাবাদের পর তদন্তকারীদের একাংশ জানাচ্ছেন, ওল্ড ক্যালকাটা রোড থেকে ডান দিক এবং বাঁ দিক, দু’দিক দিয়েই কল্যাণী এক্সপ্রেসওয়েতে ওঠা যায়। বাঁ দিকে গেলে গলিঘুঁজি দিয়ে ৪-৫ কিলোমিটার লাগে। সেটা মিনিট দশেকের পথ। ডান দিকে গেলে ৮-৯ কিলোমিটার। রহড়া সেই রাস্তাতেই পড়ে। গোয়েন্দাদের অনুমান, পুলিশকে বিভ্রান্ত করতে ওল্ড ক্যালকাটা রোড থেকে দু’ভাগে ভাগ হয়ে যায় দুষ্কৃতীরা। একটি বাইক চলে যায় বাঁ দিকে, অন্যটি ডান দিকে। পালানোর পথ হিসাবে কল্যাণী এক্সপ্রেসওয়েকে বেছে নেওয়ার কারণ, ২ নম্বর জাতীয় সড়ক ধরতে পারলে দেশের যে কোনও প্রান্তে পৌঁছে যাওয়া যাবে। তা ছাড়া, কল্যাণী এক্সপ্রেসওয়ে এমনিতেই ফাঁকা থাকে এবং বাড়তি সুবিধা হল, কোনও সিসি ক্যামেরাও নেই।

তদন্তকারীদের অনুমান, পুলিশ ঘাঁটির এত কাছে ডাকাতি এবং এলাকায় প্রচুর সিসি ক্যামেরা থাকায় গোটা পরিকল্পনা নিয়ে দুষ্কৃতীরাও সন্দিহান ছিল। ধৃতদের জিজ্ঞাসাবাদ করেই তদন্তকারীরা জানতে পেরেছেন, ব্যারাকপুরের সোনার দোকানটি তাদের প্রথম নিশানা ছিলই না। তারা প্রথমে হাওড়ার ব্যাঁটরা থানা এলাকার কদমতলার একটি সোনার দোকান বেছে নিয়েছিল। গত ১৮ মে কদমতলার এইআইটি রোডের পাশের ওই সোনার দোকানে ঢুঁ মেরে সব দেখেও এসেছিল চার জনের দলটি। দোকানের সিসি ক্যামেরাতেও তা ধরা পড়েছে। এর পর পরিকল্পনা মতো ২৪ তারিখ, অর্থাৎ বুধবার সকাল সাড়ে ৯টা নাগাদ দোকানটি খোলার আগেই বাইরে থেকে ঘাপটি মেরে অপেক্ষা করছিল তারা। কিন্তু দোকান খোলার সঙ্গে সঙ্গে কিছু ক্রেতা চলে আসায় সেই পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়। এর পর সেই দিনই ব্যারাকপুরের দোকানটি লুট করার সিদ্ধান্ত নেয় তারা।

হেলমেট, টুপি ও মাস্ক পরে থাকা তিন দুষ্কৃতীর ছবি দেখে ঘটনার দিনই পুলিশ জানায়, তারা ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলের ‘চেনা মুখ’ নয়। যত এগিয়েছে, এই ঘটনায় ততই ঝাড়খণ্ড-যোগ স্পষ্ট হয়েছে। তবে, এক জনের মুখের খোলা অংশ এবং হাঁটাচলা ও কথা বলার ধরনের সঙ্গে পুরনো একটি ঘটনায় অভিযুক্ত এক দুষ্কৃতীর সামান্য মিল পান গোয়েন্দারা। পুলিশ জানিয়েছে, সেই সূত্র ধরেই পুরনো রেকর্ড ঘেঁটে দেখা যায়, গত দুর্গাপুজোর আগে একটি ডাকাতির ঘটনায় ধরা পড়ে জেল খেটেছিল কামারহাটির বাসিন্দা সফি। জেরায় সে জানায়, জামশেদ সম্পর্কে তাঁর মামা। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে ঝাড়খণ্ডের সাহেবগঞ্জে মামার বাড়িতে চলে যায় সে। পুলিশের দাবি, জেরায় সফি জানিয়েছে, ব্যারাকপুরের দু’টি সোনার দোকানে ‘রেইকি’ করেছিল সে। ডাকাতি করে পালানো সহজ হবে, এই যুক্তিতেই ওল্ড ক্যালকাটা রোডের দোকানটি বেছে নেওয়া হয়। সফিই ঝাড়খণ্ড থেকে বাকি সঙ্গীদের ডেকে এনেছিল। আগ্নেয়াস্ত্রও আসে পড়শি রাজ্য থেকে। ঘটনার পরে একই পথে পালানোর পরিকল্পনা করেছিল তারা। কিন্তু পুলিশের নাকাতল্লাশি এড়িয়ে নম্বর প্লেট লাগানো বাইক দু’টি কোথায় লুকোবে, তা নিয়ে সমস্যা তৈরি হয়।

পুলিশ সূত্রে খবর, আগের বার সফি যে দলের সঙ্গে ডাকাতি করেছিল ব্যারাকপুরের ঘটনায় সেই দলই ছিল, না কি কোনও নতুন দল এসেছিল, তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। ব্যারাকপুরের পুলিশ কমিশনার অলোক রাজোরিয়া বলেন, ‘‘অপরাধীদের ভিডিয়ো ফুটেজ দেখে প্রাথমিক ভাবে তাদের আনকোরা ও বহিরাগত বলেই মনে হয়েছিল। এই ঘটনায় ভারতীয় দণ্ডবিধির সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ ধারায় মামলা হয়েছে। বাকিরাও ধরা পড়বে।’’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.