সঙ্গে ছিল পর্তুগিজ পাসপোর্ট। তাই নিয়েই ভারতে হাজির হয়েছিল জইশ-ই-মহম্মদ প্রধান মাসুদ আজহার। বিমানবন্দরে অবশ্য নিরাপত্তাকর্মীরা এক ঝলক দেখেই বলেছিল পর্তুগিজদের সঙ্গে চেহারায় কোনও মিল নেই তার। তবে মাসুদ তাদের বোঝাতে সক্ষম হয়েছিল যে জন্মগত ভাবে সে গুজরাটি। পাসপোর্টে স্ট্যাম্প মারতে আর দেরি করেননি বিমানবন্দরের কর্মীরা। সরকারি ভাবে ভারতে পা রেখেছিল মাসুদ আজহার। দিনটা ছিল ২৯ জানুয়ারি, ১৯৯৪।
বিমানবন্দর থেকে বেরিয়েই ট্যাক্সি ধরে মাসুদ। চালককে বলে, কোনও ভালো হোটেলে নিয়ে যেতে। সওয়ারির নির্দেশ মতো রাজধানী শহর দিল্লির চাণক্যপুরীতে হোটেল অশোকের সামনে দাঁড়ায় মাসুদ আজহারের ট্যাক্সি। মাথা গোঁজার ঠাঁই পাওয়ার পরে আর একটুও সময় নষ্ট করেনি মাসুদ। সেদিন রাতেই আশরাফ দার নামে এক কাশ্মীরিকে ফোন করে হোটেলে আসতে বলে। হরকত-উল-আনসার জঙ্গিগোষ্ঠীর সদস্য আবু মেহমুদকে সঙ্গে নিয়ে সেই রাতেই আশরাফ হাজির হয় অশোক হোটেলে। তারপরেই শুরু হয় মিশন। হাতের তালুর মতো ভারতের বেশ কিছু জায়গা চষে ফেলে মাসুদ। মাথায় গেঁথে নেয় ওইসব এলাকার ম্যাপ।
কুখ্যাত দুষ্কৃতী ভারতে এল। অবাধে গিয়ে থাকলো দিল্লির অন্যতম অভিজাত এলাকায়। এ দিকে কেউ টের পেল না? মাসুদ আজহারের দিল্লি সফরের খবর সম্প্রতি প্রকাশ্যে আসতেই আম জনতার মনে বারবার উঠছে এই একটাই প্রশ্ন। তবে এ দেশে কেউ তাকে ধরতে না পারলেও কাশ্মীর ফিরেই গ্রেফতার হয় মাসুদ। আর তখনই স্বীকারোক্তিতে মাসুদ জানায়, প্রথমে ঢাকা এসেছিল সে। দু’দিন ঢাকায় থাকার পর, বাংলাদেশের বিমানে করেই দিল্লি এসেছিল মাসুদ। সেখান থেকেই গিয়েছিল লখনৌয়েও।
আশরাফের মারুতি গাড়ি করে ২৯ জানুয়ারি দেওবন্দ যায় মাসুদ। সঙ্গে ছিল আবু মেহমুদ। সেখান দারুল-উলুম-দেওবন্দে রাত কাটায় এই তিনজন। পরদিন সকালে (৩০ জানুয়ারি) দেওবন্দিদের কবরে শ্রদ্ধা জানিয়ে উত্তরপ্রদেশের সাহারানপুরের উদ্দেশে রওনা দেয় মাসুদ ও তার দুই সঙ্গী। তাবলিক-উল-জামাত নামে একটি মসজিদে রাত কাটিয়ে ৩১ জানুয়ারি সাহারানপুর থেকে দিল্লি ফেরে মাসুদ আজহার। ফিরতি পথে পাঞ্জাবের জালালাবাদ হয়ে আসে এই কুখ্যাত জঙ্গি। সেখানে মৌলানা মাসির-উল-উল্লাহ খানের খান জি-তে গিয়েছিল আশরাখ-মাসুদ এবং আবু। ওইদিনই আশরাফের গাড়িতে দিল্লি ফেরে মাসুদ। পাল্টায় আস্তানা। এ বার ওঠে কনট প্লেসের জনপথ হোটেলে। সব জায়গাতেই নিজের পরিচয় গোপন রেখেছিল মাসুদ। হোটেলের খাতায় নিজের নাম রেজিস্টার করিয়েছিল পর্তুগিজ নাগরিক ভালি অ্যাডাম ইসা হিসেবে।
৯ ফেব্রুয়ারি শ্রীনগর ফেরার কথা ছিল মাসুদের। হাতে বেশ কিছুটা সময় থাকায় লখনৌয়ের একটি মাদ্রাসায় যায় মাসুদ। এই মাদ্রাসার মাথা ছিল আলি মিঞা। তবে এ বার আর গাড়ি নয়, বাসে চড়েই লখনৌয়ে গিয়েছিল আজহার। সম্ভবত ফেব্রুয়ারির ৬ বা ৭ তারিখে লখনৌ গিয়েছিল সে। তবে আলি মিঞার সঙ্গে দেখা হয়নি তার। ফের বাসে করেই দিল্লি ফেরে মাসুদ। কনট প্লেসের হোটেল পাল্টে এ বার ওঠে করোল বাগের কাছে শিসমহল নামে একটি হোটেলে। এই হোটেলেও নিজের পরিচিত দেয় ভালি অ্যাডাম ইসা হিসেবেই।
৮ ফেব্রুয়ারি, তাবলিক-উল-জামাত সেন্টারে যায় মাসুদ। তবে কারও সঙ্গেই দেখা হয়নি তার। কিন্তু ফেরার সময় জঙ্গিদের উপহার দেওয়ার জন্য ১২টি কম্পাস কিনেছিল আজহার। ৯ ফেব্রুয়ারি ফের আশরাফ দারের সঙ্গেই শ্রীনগরের পথে পাড়ি দেয় মাসুদ আজহার। ওইদিন সন্ধ্যায় হরকত-উল-জিহাদ-অল জঙ্গিগোষ্ঠীর সাজ্জাদ আফগানির সঙ্গে দেখা করে মাসুদ। ১০ ফেব্রুয়ারি সকালে আফগানির সঙ্গে মাটিগুন্দে যায় মাসুদ। সেখানেই জড়ো হয়েছিল পাক অধিকৃত কাশ্মীর এবং পাকিস্তানের সমস্ত জঙ্গি সংগঠনের মাথারা। পাকিস্তানে ফিরেও যাতে সবার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে পারে তার ব্যবস্থাও পাকা করেছিল মাসুদ।
তবে মাটিগুন্দ থেকে ফেরার সময়েই ঘটে বিপত্তি। কড়া নিরাপত্তায় মোড়া মাসুদের গাড়িতেই দেখা যায় গন্ডগোল। একটি অটোরিক্সায় করে শ্রীনগরের দিকে রওনা হয় মাসুদ আজহার। সঙ্গে ছিল হরকত-উল-জিহাদ-অল গোষ্ঠীর দুই সদস্য আফগানি এবং ফারুখ। এই সময়ে অনন্তনাগের কাছেই মাসুদের অটো দাঁড় করায় সেনাবাহিনী। শুরু হয় গুলির লড়াই। ফারুখ পালিয়ে গেলেও ধরা পড়ে মাসুদ আজহার এবং সাজ্জাদ আফগানি। ধরা পড়ার পরেই নিজের ভারত সফরের নানান তথ্য তদন্তকারীদের জানায় মাসুদ।
এরপর ১৯৯৯ সালে ভারতের হাত থেকে মাসুদকে মুক্ত করতে এয়ার ইন্ডিয়ার কাঠামান্ডু থেকে দিল্লিগামী বিমান ছিনতাই করে কান্দাহারে নামায় জইশ জঙ্গিরা। যাত্রীদের নিরাপত্তার খাতিরে একপ্রকার বাধ্য হয়েই মাসুদকে পাকিস্তানের হাতে তুলে দেয় ভারত। তারপর থেকে বিশ্বেব্যাপী সন্ত্রাসবাদের আঙিনায় খুঁটি আরও শক্ত করেছে মাসুদ এবং তার সংগঠন জইশ। ২০১৯ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি পুলওয়ামা সিআরপিএফ-এর কনভয়ে ফিদায়েঁ হামলা তারই নিদর্শন।
তবে ইতিমধ্যেই রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদে মাসুদকে আন্তর্জাতিক জঙ্গি হিসেবে চিহ্নিত করার প্রস্তাব এনেছে ফ্রান্স, ব্রিটেন, জার্মানি এবং আমেরিকা। কিন্তু চতুর্থবারের জন্য বেঁকে বসেছে চিন। তাদের ভেটো ফের বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে মাসুদ আজহারকে আন্তর্জাতিক জঙ্গি হিসেবে চিহ্নিতকরণের পথে। কিন্তু নাছোড়বান্দা ফ্রান্স। ইতিমধ্যেই প্যারিসের তরফে বিবৃতি দিয়ে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে মাসুদের সব সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হবে। সেই সঙ্গে তারা এও জানিয়েছে, সন্ত্রাসদমনে ভারতের পাশে সবসময় রয়েছে ফ্রান্স। এবং ইউরোপের বাকি দেশগুলোর কাছেও মাসুদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার প্রস্তাব রাখবে তারা।