“পুলিশি নিস্ক্রিয়তা এবং মুসলিমদের আক্রমণ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হিন্দুদের কোমরের জোর ক্রমে কমতে লাগল।”
“ছাত্রীটি চাপা মনের। আমি যতটা বুঝি, ও জানত ওকে সঙ্কট থেকে উদ্ধার করার মত শক্তিশালী স্বজন কেউ নেই। আমাকেও বলে লাভ নেই। আমিও এই সত্যটা অনুভব করেছিলাম। তাই মাথা নিচু করে সেদিন চলে গেলাম। ছাত্রীটিকে শান্তিতে বাঁচার পথ দেখাতে পারলাম না। সেই অপরাধবোধটা থেকেই গেল।
পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তবর্তী অঞ্চলের কত হিন্দু মেয়ে নানাভাবে প্রলোভিত হয়ে বা ভুল বুঝে এরকম মিশ্র ধর্মের বিয়ে করে সঙ্কটে পড়েছে, তার হিসেব কে রাখে?”
________________________________
(লেখক-গবেষক-শিক্ষাবিদ, ভারতীয় জাদুঘরের অছিপরিষদের সদস্য, প্রাক্তন উপাচার্য, বিশ্বভারতীর ‘কোর্ট’-এ প্রধানমন্ত্রীর প্রতিনিধি)
———————————————————————
অশোক সেনগুপ্ত
আমাদের ভারত, ৭ মে:
প্রশ্ন- ১ পরিবার বা জন্মসূত্রে আপনার সঙ্গে পূর্ববঙ্গের সম্পর্কটা ঠিক কীরকম?
উত্তর— আমার পূর্বপুরুষের দেশ ছিল যশোর জেলার নড়াইল মহকুমার কালিয়া থানার অন্তর্গত অমৃতখণ্ড ডাকঘরের অধীন গাছবাড়িয়া গ্রামে। ঠাকুর্দা চাষাবাদের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। কালিয়া গ্রামের অধিকাংশ বনেদি বৈদ্য, তাঁদের মধ্যে অন্যতম নৃত্য শিল্পী উদয়শঙ্কর, … রবিশঙ্কর। তিনের দশকের গোড়ার দিকে বাবা অনন্ত কুমার বিশ্বাস ও তাঁর ভাইয়েরা ভাগ্যান্বেষণে চলে আসেন আসানসোলের কুলটিতে। উনি হোমিওপ্যাথির চিকিৎসা করতেন। কিছু টাকা জমিয়ে আস্তে আস্তে যশোরেই কিছু জমি কেনেন। বাবা-কাকারা চাষ করতেন সেই জমিতে।
প্রশ্ন ২— সেখানকার পরিবেশ-পরিস্থিতির কীভাবে বদল হল, সে সম্পর্কে কতটা জানাতে পারবেন?
উত্তর— জোতদারের লক্ষ্মী জনার্দন মন্দির, সংলগ্ন লক্ষ্মী পাশা গ্রামে জাগ্রত মা কালী— সব মিলিয়ে হিন্দুরা সুখেই ছিলেন। চল্লিশের দশকের গোড়া থেকে মুসলিম লিগের প্রতিপত্তি বাড়তে শুরু করে। কাশিয়ানি গ্রামের কিছু লোক আমাদের গ্রামে আক্রমণ শুরু করে। গাছবাড়িয়া গ্রামের মালো, নমশূদ্র, মাহিষ্য, বৈশ্য কপালিরা তা রুখে দিত। কিন্তু পরিস্থিতির অবনতি হতে শুরু করে। বাড়তে থাকে অস্থিরতা।
এই অবস্থায় বাবাকে কেউ কেউ তাঁর জমি বিক্রি করে দেওয়ার পরামর্শ দেন। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কী যশোর, খুলনা, ফরিদপুর, বরিশাল, কুষ্ঠিয়া— এই তল্লাটে হিন্দুদের যথেষ্ট প্রতিপত্তি ছিল। তাই বাবা সেভাবে প্রমাদ গোনেননি। ১৯৪৩ নাগাদ ঠাকুর্দা মারা যান। ’৪৪-এ বাবার বিয়ে হল। আমার মায়ের পূর্বপুরুষরাও থাকতেন যশোরে। মাগুরা মহকুমায় স্বচ্ছল পরিবার। কাকারা তখনও সেভাবে দাঁড়াতে পারেননি। দেশ ভাগ হল। আস্তে আস্তে পূর্ব পাকিস্তানে হিন্দু নির্যাতন বাড়তে লাগল। আমি কুলটিতে জন্মাই ১৯৫৫-তে। সেসময়ে পাকিস্তান যেতে পাসপোর্ট-অনুমতির ব্যাপারটা চালু হয়েছে। বাবা সেটি পেয়ে দেশে গেলেন। দেখলেন পরিস্থিতি বেশ খারাপ।
প্রশ্ন ৩— কোন সময়, কীভাবে পূর্ববঙ্গের পারিবারিক ভিটে ছাড়তে হয় আপনাদের?
উত্তর— পুলিশি নিস্ক্রিয়তা এবং মুসলিমদের আক্রমণ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হিন্দুদের কোমরের জোর ক্রমে কমতে লাগল। কেউ কেউ সম্পত্তি বিনিময় বা বিক্রি করে চলে আসছেন এপারে। ইতিমধ্যে এক কাকা বিয়ে করেছেন। তাঁর দুটি বাচ্চাও হয়েছে। ঠাকুমার বয়স প্রায় ৭৫। ওঁরা এপারে এসে থাকবেন কোথায়? মাটি কামড়ে পড়ে থাকলেন ওঁরা। ১৯৬০ নাগাদ একটা বড় দাঙ্গা হল। কাকারা বুঝতে পারলেন আর থাকতে পারবেন না। প্রায় লুকিয়ে, সব ফেলে চলে এলেন। বাড়ির পোষা কুকুরটাও সঙ্গে অনেকটা পথ এসেছিল। আটকে গিয়েছিল মাঝপথে। বলাগড়ের কাছে একটা উদ্বাস্তু শিবিরে ঠাঁই হল ঠাকুমা-কাকাদের।
প্রশ্ন ৪— তার পরের সংগ্রামটা কিরকম ছিল ওঁদের?
উত্তর— বলাগড়ের শিবিরে চরম অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ। কাকার এক ছেলে অসুখে মারা গেল। বাবার মনে খুব আঘাত লাগল এতে। কিছু টাকা সংগ্রহ করে নদিয়া জেলায় বগুলার কাছে নতুনগ্রামে জমি কিনে কাকাদের চাষাবাদ ও থাকার জন্য দিলেন। আস্তে আস্তে ওঁরা নিজেদের গুছিয়ে নেওয়ার একটা অবকাশ পেলেন। নিজের এবং পারিবারিক জমি বিক্রির চেষ্টায় ১৯৬০-’৬১ নাগাদ বাবা একবার যশোরে গেলেন। কিন্তু হতাশ হয়ে ফিরলেন। গ্রামের হিন্দুরা অনেকেই দেশান্তরী হয়েছেন। যাঁরা আছেন, তাঁরাও যেন বদলে গিয়েছেন।
প্রশ্ন ৫— পূর্ববঙ্গে হিন্দুদের এই অবস্থা এবং দেশান্তরী হওয়ার ব্যাপারটা কোন সময়ে, কীভাবে আপনার মনে দাগ কেটেছিল?
উত্তর— সত্যি বলতে ১৯৭১-এর আগে সেভাবে এ ব্যাপারে বোধ হয়নি। ওই সময় কুলটিতে মুক্তিযুদ্ধের ওপর একটা প্রদর্শনী হল। আমি তখন ক্লাশ ইলেভেনে পড়ি। প্রদর্শনীর স্বেচ্ছাসেবক হয়ে আবেগের সঙ্গে কাজ করলাম। মনে হচ্ছিল বাংলাদেশ স্বাধীন হলে আমাদের, মানে হিন্দুদেরও উপকার হবে। কিন্তু পরে সেই স্বপ্ন একেবারে ভেঙে গিয়েছিল।
প্রশ্ন ৭— স্বপ্নভঙ্গের কারণটা কী?
উত্তর— কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় শুনতাম স্বাধীন বাংলাদেশের নানা কথা। শিক্ষকতায় ঢোকার পর ১৯৯০-এ ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ে এক আমন্ত্রণে যাই। সেখানে গিয়ে অনুভব করলাম এটা প্রকৃতই ইসলামি রাষ্ট্র। ধর্মনিরপেক্ষ হওয়ার কোনও ইচ্ছে নেই। তার পর বারআটেক গিয়েছি। ধারণা নেতিবাচক হয়েছে। ১৯৯৪-তে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে যাই। সেখান থেকেও কিছু খারাপ স্মৃতি নিয়ে ফিরি। অনুভব করলাম, একটা ভারত-বিরোধী মনোভাব অধিকাংশের মনে। কেউ কেউ খুব স্পষ্টভাবে ব্যক্ত করলেন আমার কাছে। সব মিলিয়ে বুঝেছি, হিন্দুদের প্রতি ওদেশের মুসলিমদের একটা চরম বিদ্বেষ রয়েছে।
প্রশ্ন ৮— আপনার এই নেতিবাচক ধারণার পক্ষে যদি দু’একটা প্রমাণ দেন।
উত্তর— হ্যাঁ। ঢাকায় একটা আলোচনাচক্রে মঞ্চেই আমাকে একজন বলেন, “আমাদের স্বাধীনতার জন্য আপনারা অনেক করেছেন, সেটা আমরা মানি। কিন্তু ভারতের স্বাধীনতাকামী কোনও জনজাতিকে যদি আমরা সাহায্য করি, আপনাদের তাতে আপত্তি কিসের?“ এরকম প্রশ্নে আমি স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম। অন্য আর একটা ঘটনা। একদিন ঢাকায় ঘটনাচক্রে বৃষ্টির সময়ে হঠাৎ এক অপরিচিতের বাড়িতে সাময়িক আশ্রয় নিতে হয়েছিল। বাড়িটিতে এক কিশোর আর ওর মায়ের সঙ্গে পরিচয় হল। ছেলেটি ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর পাঠ্যক্রমের পড়ুয়া। ওর বাবা বৈমানিক ছিলেন। কিন্তু হিন্দু হওয়ায় কীভাবে নায্য পদোন্নতি থেকে বার বার বঞ্চিত হয়েছেন, তা জানলাম। ওঁদের বেশ কিছু ভূসম্পত্তি ছিল। ওই মহিলা অনেক বাধা উপেক্ষা করে মনের জোরে ওই সম্পত্তি দখলে রাখছিলেন। সেই অভিজ্ঞতাও আমার মনকে বিষিয়ে দিয়েছিল।
হিন্দু মেয়েদের জোর করে মুসলিমদের বিয়ে করার আকর্ষণের কথা সর্বজনবিদিত। অনেকেই জানেন, এই বিয়ের জন্য মুসলিমরা অনেক দূর যেতে পারেন। একটা কাহিনী বলি। এক ছাত্রী আমার অধীনে পিএইচডি করছিল। বিষয় অদ্বৈত মল্লবর্মণ। থাকত টালিগঞ্জে। ওর বাবা ছিলেন একজন স্থানীয় বামপন্থী নেতা। আশির দশকে তিনি মারা যান। হিন্দু ধর্মমতে তাঁর দাহ করা হয়। ক’দিন বাদে হঠাৎ ফরিদপুর থেকে মৃত ব্যক্তির ভাই হিসাবে দাবি করে এক ব্যক্তি এসে ছাত্রীর মায়ের কাছে চেঁচামেচি শুরু করেন। বলেন, তাঁর দাদা ছিলেন মুসলিম। কেন হিন্দু মতে তাঁর পারলৌকিক কাজ হল? ওই মহিলা স্বামীর বিধর্মী পরিচয়টা জানতেন না। কখনও আশঙ্কা করেননি যে তাঁর প্রয়াত স্বামী পরিচয় গোপন করে বিয়ে করেছেন। পড়শিরা এসে কোনওক্রমে ওই আগন্তুককে বিদায় করেন।
১৯৯৮ সালের জানুয়ারি মাসে অদ্বৈত মল্লবর্মণের ওপরে একটা আলোচনাচক্রে অংশ নিতে আমন্ত্রণ পেলাম ব্রাহ্মণবেড়িয়া থেকে। ওই মহিলা এসে অনুরোধ করেন সেখানে মেয়েকে নিয়ে যেতে। তাতে মেয়ের গবেষণায় পূর্ণতা আসবে। আমি রাজি হলাম। বাংলাদেশে ওকে নিয়ে একটা অদ্ভুত পরিস্থিতির মধ্যে পড়লাম। আমাদের থাকার জায়গার খবর কোনওভাবে মেয়েটির সেই ‘কাকা’ পেয়েছিলেন। তিনি আরও দু’একজনকে নিয়ে হাজির। তাঁদের পরিবারের একজনের সঙ্গে মেয়েটির বিয়ে দেওয়ার দাবি করলেন ওঁরা। অভিভাবক হিসাবে আমার সম্মতি দাবি করলেন ওঁরা। নানাভাবে বোঝালেন। কিন্তু কীভাবে সেই দাবিকে আমি মান্যতা দিই? আমি তো ওর অভিভাবক নই! ওর মা আছেন! মেয়েটিও এরকম বিয়েতে রাজি নয়! এই পরিস্থিতিতে ছাত্রীর কাকা এবং সঙ্গীরা প্রায় ব্ল্যাকমেল শুরু করলেন। বললেন, এখানে বিয়ে না করলে ওর পিতৃপরিচয় নিয়ে নেতিবাচক পরিস্থিতি তৈরি হবে। তাতে মেয়েটি
ফাঁপরে পড়বে।
সভাশেষে ছাত্রীকে নিরাপদে ওর মায়ের হাতে সঁপে মহিলাকে বিষয়টি জানালাম। আমার ছাত্রী পিএইচডি শেষ করেছিল। বছর দেড় বাদে, ’৯৯-তে এক মুসম যুবককে বিয়ে করতে হল ছাত্রীকে। শ্বশুরবাড়ি ছিল মুর্শিদাবাদে। তারপর আমাদের যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে যায়। ক’বছর বাদে কলকাতায় একটা ব্যাঙ্কের সামনে হঠাৎ ওর সঙ্গে দেখা। কেমন আছ জানতে চাওয়ায় ও ভেঙে পড়ল। বলল, এতটাই দুঃখে আছে যে এই জীবনে ইতি টেনে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু সফল হয়নি। বেশ কিছুদিন পিয়ারলেস হাসপাতালে থেকে সুস্থ হয়ে ফিরতে হয়েছে।
ছাত্রীটি চাপা মনের। আমি যতটা বুঝি, ও জানত ওকে সঙ্কট থেকে উদ্ধার করার মত শক্তিশালী স্বজন কেউ নেই। আমাকেও বলে লাভ নেই। আমিও এই সত্যটা অনুভব করেছিলাম। তাই মাথা নিচু করে সেদিন চলে গেলাম। দুএকজন প্রভাবশালী মুসম সমাজকর্মী ওদের বিয়ের দৌত্য করেছিল। আমি বিষয়টা নিয়ে মাথা ঘামাতে গেলে হয়ত বিপদে পড়তাম। কিন্তু ছাত্রীকে শান্তিতে বাঁচার পথ দেখাতে পারলাম না। সেই অপরাধবোধটা থেকেই গেল।
এর পর ওর কোনও খোঁজ পাইনি। চেষ্টাও করিনি। বিষয়টা নিয়ে একটা উপন্যাস লিখেছি ‘আলোর পাখি’। পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তবর্তী অঞ্চলের কত হিন্দু মেয়ে নানাভাবে প্রলোভিত হয়ে বা ভুল বুঝে এরকম মিশ্র ধর্মের বিয়ে করে সঙ্কটে পড়েছে, তার হিসেব কে রাখে?
প্রশ্ন ৯— বাংলাদেশে হিন্দুদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আপনার অনুমান কী?
উত্তর— বাংলাদেশ প্রায় হিন্দুশূন্য হবে। কেবল সময়ের অপেক্ষা। যেখানে হিন্দুরাই ছিল সর্ব অর্থে উৎকৃষ্ট, সেই রাষ্ট্র থেকে তাঁদের সম্ভাব্য বিলুপ্তি খুব দুঃখের।