ইংরেজি ও ফরাসি অনুবাদে ‘পথের পাঁচালী’ অসম্পূর্ণ। “অক্রুর সংবাদ অংশটি পরিত্যক্ত হয়েছে। রুশ ও জার্মান ভাষায় অনুবাদ হয়েছে কেবল ‘আম আঁটির ভেঁপু’অংশ।‘বল্লালী বালাই নেই— নেই ‘অক্রুর সংবাদ’।মার্কিন ও ইউরােপীয় মন ‘পথের পাঁচালী’কে ঠিকমতাে বুঝেছে কিনা ভাবা দরকার। আর্নেস্ট বেন্ডার লিখেছেন, এই উপন্যাস শিশুর চোখে দেখা ভারতীয় পল্লীজীবন। আমেরিকার চয়েস’ পত্রিকা এখানে পেয়েছে ভারতীয় পল্লী জীবনের নিষ্ঠুর যন্ত্রণার। নিরাবরণ বিবরণ। বস্তুত পশ্চিম পৃথিবী পথের পাঁচালী’র ভিতরের কথাটি বুঝতে পারেননি। পারার কথাও নয়। একই কথা আধুনিক মুদ্রিত মাধ্যমে প্রচলিত বাংলা সাহিত্যের দিকপাল গবেষক পণ্ডিতদের সম্পর্কেও। তারা জানেন না, দেশের প্রাচীন উপনিবেশপূর্ণ ভারতীয় জনসত্তার যাত্রাপথ, জানেন না, আমাদের সংস্কৃতির। হাতে লেখা পথের পাঁচালী। ইউনেস্কো’ না জানতে পারেন, কিন্তু লােকনাথ ভট্টাচার্যের সহধর্মিণী ফ্রান্স ভট্টাচার্য জানলেন না। জানলেন না সাহিত্য। আকাদেমি’-র বিশেষজ্ঞরাও! অবশ্য, এই স্ববিরােধ ও বিভ্রান্তির ক্ষেত্রে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় (১২.৯.১৮৯৪ -১.৯.১৯৫০)-ও কিছুটা দায়ী। “স্মৃতির রেখা’য় যখন তিনি লেখেন, “নভেলে… শৈশব কালের স্মৃতিরই পুনরাবৃত্তি করেছি মাত্র কিংবা ১০.৯.১৯৪০-এ লেখা পত্রে স্ত্রী রমাদেবীকে লেখেন, ভাগলপুরের ‘বড়বাসায় থাকাকালীন জন্মগ্রাম ও আনুষঙ্গিক বিষয়ে মন খারাপ’ থেকেই ‘পথের পাঁচালী’র সৃষ্টি তখন আর্নেস্ট বেন্ডারের বা শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখনীকে উত্তেজিত না করবে কেন! ‘পথের পাঁচালী’ উপহার দেবার সময় বিভূতিভূষণ স্বাক্ষর করেন ‘অপু’। উপহারের প্রাপক ছিলেন। সজনীকান্ত দাস (১৫.৮.১৯০০-১১.২.১৯৬২)। আবার ‘তৃণাঙ্কুরে’ বিভূতিভূষণই লিখেছেন তাঁর উপন্যাসটি নিছক আত্মজৈবনিক নয়— ‘জীবনের সংযােগ এখানে ‘ভাসা ভাসা ধরনে’র। বস্তুত ‘পথের পাঁচালী’-তেও আত্মজৈবনিক উপাদান কম নেই। আমরা সেই ক্ষেত্রে এই প্রবন্ধে বিস্তারে যাচ্ছি না। আমাদের লক্ষ্য পথ ও পাঁচালী। | পথ বলতে দেশ কাল পাত্রের মাত্রা। পথ দেশে দেশে ছড়িয়ে থাকে। কাল প্রবাহ খুবই জটিল। কিছুদিন আগে বিশ্বভারতী পত্রিকায় (বৈশাখ ১৪২৫) একটি প্রবন্ধে (নিমেষ ও মহাকাল’) মুসলিম ও ব্রিটিশ শাসনপূর্ব ভারতীয় সময়-চেতনা নিয়ে বিস্তৃত তথ্য সমাবেশ করেছি। বিভূতিভূষণ এই কালচেতনার সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। তাঁর ‘দেবযান’ বা ‘আরণ্যক’ উপন্যাসে এর দুটি প্রসঙ্গ দেখা গেছে— “ইছামতী’ উপন্যাসে আছে এর আধ্যাত্মিক ভাষ্য। সাহিত্যকৃতিতে কালের মাত্রা বিচার মিখাইল মিখাইলােভিচ বাখতিন (১৬.১১.১৮৯৫ – ৭.৬.১৯৭৫) এবং নর্থপ ফ্রাই (১৯১২-১৯৯১) গভীরভাবে বিচার করেছেন। বাখতিন রুশী তাত্ত্বিক। ফ্রাই কানাডার অধ্যাপক। বাখতিন দেখিয়েছেন, টলেমির কাল চেতনা (Ptolemic) ছিল মধ্যযুগীয় অন্যপক্ষে গ্যালিলিওর দৃষ্টিতে (to the Galilean view) হলাে আধুনিকতার দিকে উন্মুখ। টলেমির ভাবনা ছিল পৃথিবী-কেন্দ্রিক। গ্যালিলিওর সময় ভাবনা সূর্যকেন্দ্রিক। বাখতিন দেখিয়েছেন, এই দুই ভাবনার মধ্য দিয়ে বিশ্ব-দৃষ্টির মৌলিক প্রভেদ ঘটে যায়। এভাবে গড়ে উঠেছে তাঁর ‘কালক্রম চিহ্ন (Chronotope) -এর তত্ত্ব। তাঁর ভাষা থেকে উদ্ধৃত করি- ‘Without such temporal spatial expression, even abstract thought is impossible. Consequently, every entry into sphere of meaning is accomplished only. Through the gates of chronotope’। এভাবে চলার পথ আর কাল মিশে যায়।
নর্থপ ফ্রাই ১৯৫৭ সালে তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘Anatomy of Criticism’ -এ সময়কে ঋতুচক্র, দিন-রাত্রির সাময়িক চক্র; বর্ষচক্রের সঙ্গে মিশিয়ে নায়কের নায়িকার মনস্তত্ত্ব আর সাহিত্য সংরূপের সূক্ষ্ম বিচার করেছেন। এভাবে ফ্রাই দেখাতে থাকেন 1. ‘yearly cycle of the season’; 2. ‘the daily cycle of the sun’; 3. ‘the nightly Cycle of dreaming and awakening” উপন্যাসে স্থান কালের সঙ্গে সঙ্গে যুক্ত থাকে মুখ্য চরিত্রের (pro| tagonist) যাত্রা। এভাবে দেখলে বলতেই হয় ‘পথের পাঁচালী’কে আমরা এতদিন ধরে অপূর্ব রায় বা শ্রীমান অপুর যাত্রা বলে ধরে নিয়ে সামান্য ভুলই করেছি। পাশ্চাত্য সমালােচকরা একে দারিদ্র-লাঞ্ছিত পরিবারের উৎসন্ন হবার কাহিনি ভেবেছেন। কোনাে কোনাে অনুবাদক ‘ইন্দির ঠাকরুণের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে নিশ্চিন্দিপুর গ্রামে সেকালের অবসান হইয়া গেল’* –এই বাক্য থেকে ধরে নিলেন এপর্যন্ত অপুর ভূমিকা তাে নগণ্য। অতএব এটুকু বাদ দেওয়া যাক। তাঁরা ধরে নিলেন, “বল্লালী বালাই’ বােঝানাের দরকার নেই— ও হলাে ভারতীয় সমাজের একটি অননুবাদ্য অংশ। প্রত্যেক জাতি ও সমাজের কিছু চলন থাকে। তাতে মানুষ পীড়িত হয়— সেই পীড়ার মধ্যে মনুষ্যত্বের পরাভব, সম্পর্কের টানাপােড়েন থাকে। আমাদের সমাজে কৌলীন্যপ্রথা, বহুবিবাহ, সতীদাহপ্রথা (কিংবা ছিপছিপে বালিকা বধূটির সংসারহীন, একলা পরিতাজ্য হয়ে নিত্য পুড়ে মরা) ছিল। তা আড়াল করলে এই পথটি কি স্পষ্ট হয়? যে পথ চলে যায়, ‘ঠাঙাড়ে বীরু রায়ের বটতলায়’থামে না—‘ধল চিতার খেয়াঘাটের সীমানায়’ বাঁক নেয়— থামে না। দিন রাত্রি পার হয়ে, জন্ম মরণ পার হয়ে, মাস, বর্ষ, মন্বন্তর, মহাযুগ পার হয়ে’— এই পথ চলে যায়। চলেই যায়।
পদাতিক অপু। পথচারী তার পিতা হরিহরও। অপুদু’পাশ দেখে। হঠাৎনজরে পড়ে পথপ্রান্তে কী যেন চলে গেল। হরিহরের মনে হয় যাত্রাশেষে কোথাও পৌঁছতে হবে। হঠাৎ উঁচু উঁচু কানের কী যেন চলে গেল, ফাঁকা মাঠে টেলিগ্রাফের খুঁটিতে কান দিয়ে দূর দেশের রহস্য রােমাঞ্চে তার আগ্রহ জন্মালে চলে না। পথের পাঁচালী উপন্যাসে এক বিচিত্র দ্বিরালাপ লক্ষিত হয়। কিছুতেই যেন স্থির হয়। না উপন্যাসের আসল মুখ্য চরিত্র (protagonist) কে? বাংলা ভাষার নােট মুখস্থ করা ছাত্রছাত্রীরা বলবে— এটা অবান্তর প্রশ্ন। মুখ্য চরিত্র অবশ্যই অপু। তার বড় হওয়াই তাে উপন্যাসের মর্মবস্তু। আমরা ভিন্ন মত পােষণ করছি। দুই খণ্ড ‘অপরাজিত’ আর চলচিত্রায়িত ‘পথের পাঁচালী’, ‘অপুর সংসার’ দেখে আমাদের মনে এই বিচিত্র ধারণা বদ্ধমূল হয়েছে বটে। আমাদের মনে হয়েছে, অপুই এই কাহিনির মুখ্য। আমাদের বিহ্বল করে বিভূতিভূষণের বর্ণনার অপরূপতা। দেখাই :
১. ‘অনেক দূরের কথায় তাহার শিশুমনে একটা বিস্ময় মাখানাে আনন্দের ভাবের সৃষ্টি করিত।১১
২. ‘জীবন-পথের যে দিক মানুষের চোখের জলে, দীনতায়, মৃত্যুতে আশাহত, ব্যর্থতায় বেদনায় করুণ— পুরােনাে বইখানার ছেড়া পাতায় ভরপুর গন্ধে, মায়ের মুখের মিষ্টি সুরে, রৌদ্রভরা দুপুরের মায়া-অঙ্গুলি নির্দেশে, তাহার শিশু দৃষ্টি অস্পষ্টভাবে সে। পথের সন্ধান পাইত।১২
অপুর এই বহুদূরের সংবাদ শুধু কল্পনা থেকে আসেনি। এর ভিত্তি আমাদের কথনরীতি, আর পুঁথিপত্রের মাধ্যমে যা কতকাংশে মৌখিক। দ্বিতীয় উল্লেখটিতে স্পষ্ট যে সর্বজয়া মুখে পান পুরে জীর্ণ মহাভারত শােনাচ্ছিল— অপু তাে এভাবেই পাচ্ছিল তার দুর একটি আশ্চর্য উৎস পথের সন্ধান। উপন্যাস জুড়ে এই উৎসপথের ভালাে মন্দ রহস্য রােমাঞ্চের রাজপথ আর অভিসন্ধির পরিচয়। আমরা ভালাে করে খেয়াল করলে ইন্দির ঠাকরুণের ছড়ায়, দুগার ব্রত গীতে, সর্বজয়ার মহাভারতপাঠে, গ্রাম্য যাত্রাগানের অদ্ভুত সংলাপ ও টিনের তরবারির বিষম যুদ্ধে এর পরিচয় পাবাে। অপু যে মহাবীর কর্ণের ছবি দেখতে পায় সূর্যাস্তের দিকচক্রবালে তার প্রত্ন প্রতিমা ব্যাখ্যায় বিভূতিভূষণের সিদ্ধির চমৎকারটুকু দেখলে একে সবটা দেখা হয় কী? দেখাই,
‘কর্ণ যেন ওই অশ্বত্থ গাছটার ওপারে আকাশের তলে, অনেক দূরে কোথায় এখনও মাটি হইতে রথের চাকা দুই হাতে প্রাণপণে টানিয়া তুলিতেছে– রােজই তােলে— রােজই তােলে মহাবীর, কিন্তু চিরদিনের কৃপার পাত্র কর্ণ।”১৩। সূর্যপুত্র কর্ণ, সূর্যাস্তের সঙ্গে তার এই আশ্চর্য আবর্তন আপতন মহাকবি কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাসই কি নির্দিষ্ট করে দেননি? এই ধারাবাহিকতাই ভারতবর্ষের জীবনপথের পাঁচালী।
অপুর সৃজনশীল কল্পনা হরিহরের উত্তরাধিকার। হরিহরের বাক্সটিতে অপু কিছু আশ্চর্য বস্তুর ইশারা পেয়েছিল। আধুনিক উত্তর উপনিবেশিক পরিস্থিতি দিয়ে একে বুঝতে চাওয়া বিভ্রান্তিকর। হরিহরের বিদ্যাগ্রহ, পাণ্ডিত্য, কল্পনাচারিতা, শিল্পবােধ সবই নিতান্ত ‘দেশী। তাকে বুঝতে না পারলে পথের পাঁচালী নিছক এক শিশু মনের আশ্চর্য ভেবে রােমাঞ্চ হতে পারে, কিন্তু পথের পাঁচালী তাে হরিহরেরও জীবনের পাঁচালী—তা না বুঝলে উপন্যাসের পাঠ অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। পশ্চিমী অনুবাদকরা ‘অক্রুর সংবাদ’কে। পরিশিষ্ট বা বর্জনীয় বিবেচনা করেছেন কিন্তু ওখানেই আছে। ইছামতী থেকে বারাণসীর গঙ্গা পর্যন্ত এক অভিনব পথের ইঙ্গিত। আঞ্চলিক কেমন করে মহাভারতীয় জাতীয়, আধ্যাত্মিক আর বৈশ্বিক হচ্ছে, আর ঠিক কোথায় নিমেষ ও ক্ষণকাল হয়ে উঠছে মহাকাল বা চিরকাল – তা বােঝার সঙ্গে আমাদের বুঝে নিতে হবে দুই প্রজন্মের দ্বান্দ্বিকতার পরিণতি।
পিতা খেয়ালী মানুষ, বিষয়বুদ্ধি নেই। তবে তার পুঁজিটি নেহাৎ কম ছিল না। অপু তা সবার আড়ালে পড়ত। পেয়েছিল ‘সর্বদর্শন-সংগ্রহ’, সেই বই খুলতেই ‘কাগজ-কাটা পােকা বেরিয়ে পালাল। অপু বইখানা নাকের কাছে লইয়া গিয়া ঘ্রাণ লইল, কেমন। পুরনাে গন্ধ। শুধু কী তাই— ‘গন্ধটায় কেবলই বাবার কথা মনে করাইয়া দেয়। যখনই এ গন্ধ সে পায় তখনই কী জানি কেন তাহার বাবার কথা মনে পড়ে। সেখানে ছিল শকুনির ডিম আর পারদের মাধ্যমে শূন্যমার্গে ভ্রমণের বিচিত্র ভেল্কিবাজির সংবাদ। শেষ অবধি দিদি দুগার ভাষায় ‘হাঁ-করা ছেলে’অপুর কাছ থেকে রাখাল এসে চার পয়সায় বিক্রি করে গেল শকুনের ডিম! সর্বজয়া বুঝল, ‘রাখাল ছোঁড়াটা, বদমায়েশের ধাড়ি। আর অপু ‘ছেলেটা যে কী বােকা’ তা বলে বােঝানাে যাবে না। সর্বজয়ার জানার কথা নয়— ‘সকলেই তাে কিছু সর্ব-দর্শন-সংগ্রহ পড়ে নাই, বা সকলেই কিছু পারদের গুণও জানে ।১৫
গ্রামের একলা বৃদ্ধ নরােত্তম দাস, তাঁর কাছে ‘প্রেম ভক্তিচন্দ্রিকা’-র পদাবলী আর পুরাণ সাহিত্য আকণ্ঠ পান করত অপু। নরােত্তমের ছিল শিল্পবােধ। এক শিষ্যের বাঁধা পদ তার ভালাে লাগত না। তার আদর্শ ‘বিদ্যাপতি চণ্ডীদাস’। রসিক বালক অপুকে তার ‘গৌর’ মনে হত। বলেছিল, ‘আমি মরবার সময়ে এই বইখানা তােমাকে দিয়ে যাবাে দাদু, তােমার হাতে বইয়ের অপমান হবে না।
হরিহরের কাছে অপু চেয়েছিল পদ্মপুরাণের একটি খণ্ড।যুগীপাড়া থেকে সেই বইখানা বটতলায় ছাপা, পড়ার জন্য এনেছিল হরিহর। সেটি পড়ত অপু। “কুচুনী পাতায় শিব ঠাকুরের মাছ ধরিতে যাওয়ার কথাটা পড়িয়া তাহার ভারী আমােদ।১৭ নরােত্তম দাস এই বটতলার পদ্মপুরাণ— এক অনিন্দ্য শিল্পপথের সন্ধান দেয় অপুর শিশু মনের কল্পনাচারিতাকে। পিতার টিনের বাক্সে অপু খুঁজে পায়— ‘নিত্য কর্মপদ্ধতি’, ‘প্রাকৃতিক ভূগােল’, ‘শুভঙ্করী’, আর ‘পাতা-ছেড়া বীরাঙ্গনা। আর আছে মায়ের সেই মহাভারত। হরিহরের পথ— উদাসীন জ্ঞান সন্ধানীর শুধু নয়, তার ছিল সৃজনশীল ক্ষমতা, মৌখিকভাবে চলে আসা যা কিছু দেশী—সবই তার আগ্রহ অনুধ্যানের বিষয় ছিল। খােড়ে নদীর ধারে কাঠগােলার অধিকারী তার গলায় ‘শ্যামা বিষয়ক’ গান শুনে খুশি হয়ে এক টাকা প্রণামী দিয়েছিল।১৯। এক ভাগ্য বিড়ম্বিত বিদ্যানুরাগী শিল্পী মনের হরিহরের এই জ্ঞান-পথের সঙ্গে সংযােগ না থাকলে অপু অপু হতাে না। | বারাণসীর দশাশ্বমেধ ঘাটের ষষ্ঠী মন্দিরের নিচে ‘কাশী খণ্ডের পুঁথি নিয়ে বসার পিছনে সর্বজয়ার উৎসাহ পরামর্শও ছিল। এমনিতে ‘কয়েক স্থানে হাঁটাহাঁটি করে কয়েকটি মন্দিরে নিত্য পুরাণ পাঠের কাজ জোগাড় হলাে। সর্বজয়া বলল, দশাশ্বমেধ ঘাটে রােজ বিকেলে পুঁথি নিয়ে বােসাে না কেন? কত ফিকিরে লােক পয়সা আনে, তােমার কেবল বসে বসে পরামর্শ আঁটা।২° সর্বজয়ার কি হরিহরের মতাে মন আছে! হরিহরের আজন্ম স্বপ্ন ছিল, ‘ঝাড় লণ্ঠনের আলাে ঝােলানাে বড় আসরে সে দেখিতে পায়, দেশে দেশে গ্রামে গ্রামে তার ‘ছড়া, গান, শ্যামা সংগীত, পদ, রাত্রির পর রাত্রি’ ধরে ‘গাওনা হচ্ছে— ‘কত দূর দূরান্তর থেকে মাঠঘাট ভেঙ্গে লােক খাবারের পুটুলি বেঁধে এনে বসে থাকবে শােনার আগ্রহে।‘দলের অধিকারী তার বাড়িতে এসে পালা চেয়ে নিয়ে যাবে। লােক জানতে চাইছে— বাঃ! ভারী চমৎকার তাে! কার বাঁধা ছড়া?- ‘কবির গুরু ঠাকুর হর’— হরু ঠাকুরের ? — না। নিশ্চিন্দপুরের হরিহর রায় মহাশয়ের।২১ তবে জীবনের সংঘাত সংঘর্ষের উত্তাপে সেই স্বপ্নাচ্ছন্নতা কপূরের মতাে উড়ে গেল। যৌবনের স্বপ্নজাল জীবন-মধ্যাহ্নে কুয়াসার মতাে দিগন্তে মিলাইয়া গেল।২২ আজ এই প্রৌঢ়ত্বের সীমানায় ধর্মসঙ্গিনী সর্বজয়ার তির্যক-বাণী তাকে স্বপ্নলােকে ফিরিয়ে দিল। পুরাণ পাঠ করা তার পরিচিত, অভ্যস্ত বিষয়। শিষ্য বাড়িতে এরকম করতেই হতাে।তীর্থস্থানে যাত্রীদের মধ্যে ভারতবর্ষের সাংস্কৃতিক রাজধানীতে, অনিয়ন্ত্রিত জনতার মাঝখানে এই নতুন পটভূমিতে প্রাথমিকভাবে উৎরে গেল হরিহর।‘ভিড় মন্দ হয় না।২৩
কিছুদিনের মধ্যেই পেশায় এল প্রতিযােগিতা। দেবনাগরী বর্ণ জানা‘বাঙাল’কথক ঠাকুর অন্য উপায়ে লােক জড়াে করে। হরিহর বােঝে নতুন সময়ে পুরনাে ধ্রুপদী পুরাণ-নিষ্ঠানয়—‘বাঙাল’কথক ‘শুধু ছড়া কেটে মেয়ে ভুলিয়ে পয়সা নেয়।তাই ‘গােটাকতক পালা’ লিখবে হরিহর—‘গান থাকবে, কথকতার মতও থাকবে। শুরু হলাে নতুন সাধনা। কয়েকদিন ধরে তার কথকতা শুনতে বেশ ভিড়’ হচ্ছে। উৎসাহ পেয়ে ‘হরিহর পুরাতন খাতাপত্রের তাড়া আবার বের করে। সর্বজয়া বলে, ধ্রুব চরিত্র শুনতে শুনতে লােকের কান যে ঝালাপালা হলাে, নতুন একটা কিছু ধরাে না!’২৪ সৃজনশীল মানুষকে উৎসাহ দেবার মানুষ চাই— সেই মানুষ যদি সহধর্মিণী হয়, তার তুলনাই হয় না। কখনাে শুনতে যাবার ইচ্ছা প্রকাশ, কখনাে নতুন পালা রচনার অনুরােধ— হরিহরের পথের পাঁচালী এগিয়ে চলে। জড় ভরতের উপাখ্যান’লিখে ফেলল হরিহর। বাইশ বছর আগে এই বারাণসীতেই হরিহর গীত গােবিন্দের পদ্যানুবাদ করেছিল। পরে নিশ্চিন্দিপুরে গিয়ে বুঝতে পারে সময় বদলে গেছে। চারিদিকে ‘দাশুরায়ের গান, দেওয়ানজীর গান, গােবিন্দ অধিকারীর শুকসারীর দ্বন্দ্ব, লােকা ধােপার দলের মতি জুড়ির গানের বিস্তৃত প্রচলন ও পসার তাহার মনে একটা নতুন ধরনের প্রভাব বিস্তার করিল।২৫ হরিহর ভেবেছিল এই ভাঙ্গাগড়ার মধ্য দিয়েই নতুন শিল্পসম্ভার গড়ে উঠবে। তবে তা ছিল ইতিহাসের ধারার স্বাভাবিক গতিকে অস্বীকার করা, মােড় ফেরানাের ব্যর্থ চেষ্টা।
ইতিমধ্যে বদলে গেছে সময়। মধুসুদনের ‘বীরাঙ্গনা’র ছেড়া বইটি মন দিয়ে পড়লেই হরিহর ঠিক বুঝতে পারত। হরিহর কতটা অনুধাবন করেছিল জানিনা। অপূর্বরায়কে আকর্ষণ করেছিল এই নতুন কবিত্বের আকর্ষণ। সেই সঙ্গে তার মনে এসেছিল নতুন এক বিশ্বগ্রাসী ক্ষুধা। সে ক্ষুধা জ্ঞানের, তথ্যের বিস্ময়ের আর অজানাকে জানার ক্ষুধা। যাত্রাপালার অনুকরণে পালা লেখার আকর্ষণ তার উপরেও। বর্তেছিল— “বিচিত্র কেতুর যুদ্ধে’র আকর্ষণ তাকেও বিনিদ্র করে রাখত। সে দেখেছে নতুন সংযােগ ব্যবস্থা— ডাক ব্যবস্থা, চিঠি আদান-প্রদান, বাবার পাঠানাে খরচ কীভাবে পিওনের মাধ্যমে আসে— জেনেছে দারিদ্র অনিশ্চয়তার মধ্যে। | নতুন একটি মাধ্যমের ইশারা দুর্গাকে আশ্চর্য করেছিল তার নাম জানত না দুগা। সিনেমা বাক্স’, সেই একবারই এসেছিল গ্রামে। তবে তার অভিঘাত ছিল দূর সঞ্চারী। বুড়াে মুসলমান তার পয়সা নেই দেখেও ডেকে দেখিয়েছিল— ‘তাজ বিবিকা রােজা দেখাে, হাতী বাঘকা লড়াই দেখাে। সেই দশ মিনিটের কথার কোনাে বর্ণনা করতে পারে না দুগা। তখন তার নিয়মিত জ্বর আসে। ঠিকমতাে বলতেই পারেনি কী আশ্চর্য ছিল তার অভিজ্ঞতা। সত্যিকারের মানুষ ছবিতে কি করিয়া দেখা যায় ?২৬ অপু আভাস পেয়েছিল।
অপুর মন বদলে গেল শহর থেকে আসা ইংরেজি মাধ্যমে পড়া সুরেশের কথাবার্তা চালচলনে। নীলমণি রায়ের বড় ছেলেটি পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ে। অপু তখনও স্কুলেই যায় না— পাঠশালার পরে পাঠ অগ্রসর হয়নি। দোলের ছুটিতে এসে গ্রামের ছেলেদের ‘দিগ্বিজয়ী নৈয়ায়িক পণ্ডিতের মতাে প্রশ্ন করে করে নিজের প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠা করেছিল। অপুকে জিজ্ঞাসা করল– ‘ইন্ডিয়ার বাউন্ডারি কী? জিওগ্রাফী জানাে?’অপু এসব জানে না, শুধু কী তাই—‘যখন সুরেশ উপেক্ষার ভঙ্গিতে জানতে চাইল, অঙ্ক কিকষেছ?’ডেসিমফ্রাকশান করতে পারাে?।২৭ অপুর জানার সীমা ছিল ছেড়া ছেড়া—‘বঙ্গবাসী পত্রিকার বান্ডিল পড়ে সে জেনেছে বহু রহস্যময় অভিযাত্রার কথা। কিন্তু মােটে ভাগ পর্যন্ত অঙ্ক জানে, ইতিহাস নয়, ব্যাকরণ নয়, জ্যামিত পরিমিতির নামও শােনে নাই, ইংরাজির দৌড় ফাস্ট বুকের গােড়ার পাতা।২
বাবার দপ্তরে ছিল বিদ্যাসাগরের লেখা ‘চরিতমালা। সেখানে অপু পড়েছিল আলু বিক্রি করা কৃষকের ছেলে রাস্কো-র বীজগণিতে বিশেষজ্ঞ হওয়ার কথা, মেষপালক ডুবালের ভূচিত্র-বিদ হয়ে ওঠার আশ্চর্য কথা। ক্রমে ক্রমে সীমিত স্বশিক্ষা তার মনে জাগিয়ে তুলল এক নতুন আকাঙ্ক্ষা তার মনে এই নতুন আকাঙ্ক্ষা তাকে পিতার পথের পাঁচালী অতিক্রম করার দুঃসাহস জোগাল।‘সে এই হাতের লেখা শিখিতে চায় না, ধারাপাত কী শুভঙ্করী এসব তাহার ভালাে লাগে না। সে চায় পশ্চিমী শিক্ষা তার এই নতুনের আকাঙ্ক্ষা অবশ্যই বিদ্রোহের মতাে। এই গ্রাম্য চিরাচরিত শিক্ষায় তার তীব্র আকাঙ্ক্ষা তৃপ্ত হচ্ছিল না। এই কড়ি কষার আর্যা’, ‘এই নামতায় তার ক্ষুধা মিটছে না। মা বকিলে কী হইবে, যাহা সে পড়িতে চায়, তাহা এখানে কই?’।২৯ একে মনে হয় গ্রাম বাংলায় নবজাগরণের বিলম্বিত অভ্যুদয়।
১৮৩৪ নাগাদ সংস্কৃত কলেজের শিক্ষার্থীরা Committee of Public Instruction-এর উদ্দেশ্যে একটি আবেদন করে। তাদের দাবি, ইংরেজি শিখতে চায়। পুরনাে টোল চতুষ্পঠীর বিদ্যা এখন আর কর্মমুখী থাকছে না। এই চিঠি গেল লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক-এর কাছে। উইলিয়াম অ্যাডামস হলেন শিক্ষা কমিশনের দায়িত্ব পেলেন। সেই শিক্ষা কমিশনের প্রতিবেদন পর্যালােচনা করে লর্ড মেকলে ১৮৩৫ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে forocoa ‘To sum up what I have said… that English is better worth knowing than Sanskrit or Arabic; that the natives are desirous to be taught English and are not desirous to be taught Sanskrit or Arabic’৩০। মেকলের শিক্ষানীতি ভারতের চিরাচরিত বিদ্যাশিক্ষার পক্ষে বিপজ্জনক হয়েছিল ভারততত্ত্ব বিদ্যার মৃত্যুর চিহ্নও স্পষ্টহয়েছিল। ডেভিড কফের গবেষণায় এ বিষয়টি দেখেছি। এই গবেষণা গ্রন্থের একটি পরিচ্ছেদের শিরোনাম ‘Macaulayism and the Defeat of the Orientalist। উৎসাহী পাঠক এই পরিচ্ছেদ পড়লে বুঝবেন নতুন শিক্ষানীতি কেমন করে হরিহরদের পথ ও পাঁচালীর জগৎকে পরাভূত করল আর অপুদের পথের পাঁচালী নতুন পথের দেবতার ডাক শুনতে পেল।
কৌলীন্য প্রথা বল্লালী আমলের বালাই। বাংলার সমাজ ব্যবস্থায় এই গ্লানি দুমাের্চ। এই ব্যবস্থার দুটি নিষ্ঠুর পরিণতির ইঙ্গিত আছে উপন্যাসে। ঠ্যাঙাড়ে বীরু রায়কে ঘিরে যে লােক প্রচলিত কাহিনিকে বলব পথের পাঁচালীকে সাগা (Saga) তথা বংশ পরম্পরার স্মৃতিচিহ্নিত সংরূপের ইঙ্গিত দিয়েছে। তখনকার কালে অনেক সমৃদ্ধিশালী গৃহস্থও ডাকাতি করত, বিষ্ণুরাম রায়ের পুত্র মূখ বীরু রায় ছিল ঠ্যাঙাড়ে দলের সরদার। নিষ্ঠুর ভাবে এক ব্রাহ্মণ পথিককে। সপুত্র হত্যা করে সে। মূখ বীরু রায়ের একমাত্র পুত্র হলুদবেড়ে গ্রাম থেকে ফেরার পথে ইছামতী নদীতে কুমিরের গ্রাসে পড়ে। একে হয়ত Poetic justice বলা যায়। বিভূতিভূষণের ভাষায় ‘অদৃশ্য ধর্মাধিকরণের দণ্ড’ – আর তাই ‘বংশের জ্যেষ্ঠ সন্তান কখনাে বাঁচিত। ।৩২ | এই নিষ্ঠুরতার পাশে ছিল অন্য এক গােপন নিষ্ঠুরতা। কুলীন কন্যাদের পক্ষে তা কেমন ছিল—ইন্দির ঠাকরুণের মাধ্যমে তা স্পষ্ট হয়েছে। সারা জীবন এই ভাগ্য বিড়ম্বিত মহিলাদের হয় চিতায় যেতে হতাে না হয় সারা জীবন দগ্ধে মরতে হতাে। বল্লাল সেনের নির্দেশে এই কৌলীন্য প্রথার বালাই– যা মূখ খুনি ঠ্যাঙাড়ে আর অবলা কুলীন কামিনীদের হাহাকারের মাঝখানে হরিহর ব্যতিক্রম। তারকেশ্বরের মাদুলির গুণ হােক, ব্রহ্মশাপের তেজ‘কপূরের মতাে উবে যাওয়ার কারণেই হােক হরিহর বেঁচে থাকল। সমাজে পরিবারে কৌলীন্যের আভিজাত্য ক্ষয় পেল। সর্বজয়া আর হরিহরের দাম্পত্য জীবন তাে বিবাহ ব্যবসায়ী কুলীন পুরুষ আর ইন্দির ঠাকরুণের মতাে অতৃপ্ত দীর্ঘশ্বাসে পূর্ণ ছিল না। | স্বপ্ন আর স্বপ্নভঙ্গের মধ্য দিয়ে হরিহর-সর্বজয়ার দাম্পত্য জীবন ঢেউ ভেঙ্গে ভেঙ্গে এগিয়েছে। পানফল সংগ্রহের দিন অপু মাটি খুঁড়ে মজুমদারদের পরিত্যক্ত ভিটেতে‘গােলমতাে একদিক ছুঁচোলাে পল কাটা কাটা চকচকে’ যে জিনিসটা পায় তা বােধহয় হীরে। দুগা ভেবেছিল। অপুরও ‘রূপকথার রাজপুত্র ও রাজকন্যার হীরামুক্তার’ কথা মনে পড়েছিল। ‘সর্বজয়ারও হীরক সম্বন্ধে ধারণা ছিল না। ছিল না হরিহরেরও। তবে দুগা মনে করায় ‘মজুমদারেরা বড়লােক ছিল তাে মা? ওদের ভিটের জঙ্গলে কারা নাকি মােহর কুড়িয়ে পেয়েছিল—পিসি গল্প করতাে। যে কুলীন ব্রাহ্মণরা লুণ্ঠন করেছিল অন্য পথচারীর সর্বস্ব, স্বজাতি নারীদের জীবন-যৌবন, তাদের পরের প্রজন্ম ‘অদৃশ্য ধর্মাধিকরণের’কাছে এমন স্বপ্ন-দর্শী ভিক্ষুক হয়ে গেল! বাংলার সমাজ জীবনে, চিরাচরিত মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবী বর্গ গঠনে (traditional middleclass formation) এই স্বপ্নভঙ্গের অভিঘাতটি চমৎকার, নির্মোহ, অনিবার্য মনে হয়। হরিহর ফিরলে সর্বজয়ার স্বপ্ন তার মধ্যেও সঞ্চারিত হলাে। যা ছিল সর্বজয়ার ‘সমস্ত গা দিয়া যেন কিসের স্রোত বহিয়া গেল, … নানা সংশয়ের বাধা ঠেলিয়া একটা গাঢ় দুরাশা ভয়ে ভয়ে একটু উঁকি মারিল– সত্যিই যদি হীরে হয়, তা হলে।”৩৪ হরিহর বলল, “ঠিক বুঝতে পারচি নে। তবে তারও মনে স্বপ্ন সঞ্চারিত হলাে—মনে হল, “কথায় বলে,কপালে না থাকিলে গুপ্তধন হাতে পড়িলেও চেনা যায় না— শেষে কী দরিদ্র ব্রাহ্মণের গল্পের মতাে ঘটিবে!৩৫ গাঙ্গুলী মশাইয়ের জামাই সত্যবাবু জানিয়ে দিল ‘এ একরকম বেলােয়ারী কাঁচ– ঝাড় লণ্ঠনে ঝুলানাে থাকে। রূপকথার গুপ্তধন নতুন বৈভবের প্রতিনিধি ঝাড়লণ্ঠনের কাঁচে পরিণত হওয়াটা স্বপ্ন আর স্বপ্নভঙ্গের মরমী এক জীবনকথার টুকরােই বলতে হবে। | ‘ঝােপ জঙ্গলের অন্ধকারে ঝিঙের বিচির মতাে কালাে হয়ে এলে গ্রামের বিস্মৃতা অধিষ্ঠাত্রী দেবী বিশালক্ষ্মী’কে অনুভব করে অপু। খেলতে খেলতে গিয়ে দুগ-অপু হঠাৎ হাজির হয় ‘আতুরী বুড়ি’র ভিটেয়। এসবই ঠিক যেন আজকের বিখ্যাত জাদু বাস্তবতা (inagic realism)। এসবই অপুর মতাে এক অন্তদৃষ্টিসম্পন্ন শিশু পর্যটকের ভাবনা। পুলিন শালিনী ইছামতীর ডালিমের রােয়ার মতাে স্বচ্ছ জলের ধারে’ সেই পরিত্যক্ত দেবী ‘এ গ্রামকে এখনাে ভােলেন নাই। কবে কোন জনশ্রুতির ‘স্বরূপ চক্রবর্তীর পর তাকে কেউ দেখেনি, তবে অপু অনুভব করে ‘বাসক ফুলের মাথা’, ‘ছাতিম ফুলের দল’, ‘নীল পাপড়ি কলমী ফুলের দল ভিড়’ পাকিয়ে থাকে আর এই সবের মধ্যেই দেবী বিশালাক্ষ্মী ‘রূপের স্নিগ্ধ আলােয় বন’ভরে দিয়ে যান। দিনের আলাে ফোটার আগেই বনলক্ষ্মী হারিয়ে যায়।৬ এসব জায়গায় মনেই হয় পথের পাঁচালী’বিভূতিভূষণের ‘আরণ্যক উপন্যাসেরও ভূমিকা তৈরি করে হয়তাে। এসব বর্ণনা পড়ে পাশ্চাত্য সাহিত্যাদর্শ প্রভাবিত ‘আধুনিক সাহিত্য সমালােচকবর্গ ঠিক পশ্চিমা অনুবাদকদের মতােই পথের পাঁচালী’কে খণ্ড করে পড়তে চান। যে মৌখিক সাহিত্য ধারা প্রাচীন ধ্রুপদী সাহিত্য থেকে রস গ্রহণ করে কথকতা পালাগান শ্যামা বিষয়ক হতে হতে পাঁচালীতে পরিণত হয়— তা ঠিক মতাে খেয়াল করলে তারা নিশ্চয় স্বীকার করবেন, ‘পথের পাঁচালী’ অপুর পথের পাঁচালী নয়— এ উপন্যাসের প্রকৃত নায়ক হরিহরের পথ ও তার পাঁচালী অবলম্বনে বেঁচে থাকার স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গের আখ্যান।
বনগাঁ-আষাঢ়-দুর্গাপুর-টাকী থেকে কলকাতা তাে খুব দূর নয়। তবু অপুকে এত দীর্ঘপথ পর্যটন করতে হলাে কেন? নিশ্চিন্দপুর থেকে মাঝেরহাট রানাঘাট হয়ে সর্বজয়ার আড়ংঘাটার মেলায় যাওয়া সেই রেলযাত্রার পথ ছাড়িয়ে যেতে হলাে রানাঘাট। সেখান থেকে কাশী। তারপর ‘অপরাজিত থেকে দৃশ্যাহরণ করলেন মহান শিল্পী সত্যজিৎ রায়। হরিহরের হাতের ঘটি ঠং ঠং করে পড়ে গেল দশাশ্বমেধ ঘাটের রক্তবর্ণের বড় বড় ধাপ ধাপ সিঁড়ি ধরে—- ‘ইছামতী’র আঞ্চলিক মিশে গেল সর্বভারতীয় পতিতােদ্ধারিণী গঙ্গার জাতীয়তার (national) বৃহৎ ঐতিহ্যে (greater tradidion)। কবে এতাে ‘অপরাজিতের’দৃশ্য। সত্যজিও বিভূতিভূষণের শাসন মেনে পথের পাঁচালী শেষ করেন হরিহরের ভিটের একটি সাপের ধীর অনুপ্রবেশের মাধ্যমে। ঠিক যেন দাঁড়াশ— বাস্তু সাপ। বিভূতিভূষণ লিখেছিলেন, ‘কতদিনের পৈতৃক ভিটা’, ‘পিতা রামচাঁদ তর্কবাগীশ’-এর ভিটের ‘মাটির প্রদীপ টিমটিম করিতে ছিল’–‘আজ সন্ধ্যা হইতে চিরদিনের জন্য নিবিয়া গেল।৩৭ | অপুর পথ অপুর মতাে তীর্থ শহর কাশীতে থামতে পারে না। সে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের অভিঘাতে গড়ে ওঠা দক্ষিণ এশিয়ার মহানগর কলকাতার নায়ক। তাকে তাই কলকাতায় ফিরতে হয়। মাঝেরপাড়া থেকে রাণাঘাট, ব্যান্ডেল হয়ে সেই যে পথ, যা ছিল পারিবারিক তা হলাে একান্ত ব্যক্তিগত। মনসা পােতা’র জীবনের ছক ভেঙ্গে সর্বজয়াকে একা রেখে সেই পথ কলকাতার অন্ধকার ছাপাখানায়, গােলদীঘির বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় স্বপ্নের নতুন এক যাত্রার দিকে অগ্রসর হলাে। জীবন প্রস্তুতির সময় পিতা হরিহরও বারাণসীতে এমন স্বপ্নাচ্ছন্ন ছিল নাকি ! যদি প্রশ্ন করি আজকের ‘ইছামতী-এক্সপ্রেস’ বা ‘বনগাঁ লােকাল ধরে কয়েক ঘণ্টার যাত্রাপথের পাঁচালী এত ঘুরপাক খেল কেন? উত্তর হলাে ঠ্যাঙাড়ে বীরু রায়ের দিন এত সহজে কী দিনান্তের প্রদীপ হয়ে জ্বলে ? | বারাণসীর সেই বাঙাল অল্প শিক্ষিত লােভী কথকের চিত্র মনে পড়ছে। ভদ্রলােক শ্রোত্রীয়। তাদের কন্যাপণ জোগাড় করতে হয়। শ্রোত্রীয় আর কুলীন ব্রাহ্মণ সমাজের এই বল্লালী প্রথা হরিহরের কালে হারিয়ে গেছে, কিন্তু ওই দরিদ্র কথক ঠাকুরের পথ ও পাঁচালী তখনও শেষ হয়নি। হরিহরের পথ ও পাঁচালী দশাশ্বমেধ ঘাটে শেষ হয়— অপুর পথ ও পদাতিক জীবন শুরু হয় ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক মহানগরে। সে তাে ভিন্ন আখ্যান।
অনুষঙ্গ
১। ইংরেজি অনুবাদক টি. ডব্লিউ. ক্লার্ক এবং অধ্যাপক তারাপদ মুখােপাধ্যায়; ফরাসি অনুবাদক শ্রীমতী ফ্রান্স ভট্টাচার্য। সাহিত্য আকাদেমি ও UNESCO -র উদ্যোগে এই অনুবাদ দুটি যথাক্রমে ১৯৬৮ ও ১৯৬৯ সালে প্রকাশিত হয়।
২। সূত্র : পথের পাঁচালী’: রচনা ও প্রকাশন— জিতেন্দ্র নাথ চক্রবর্তী, ভাদ্র ১৩৭৯; ‘পথের পাঁচালী’, মিত্র ও ঘােষ পেপারব্যাক ক্লাসিস্; ষােড়শ মুদ্রণ, অগ্রহায়ণ, ১৪০৫ বঙ্গাব্দ। ৫ পৃঃ।
৩। তদেব, ৯ পৃঃ।
৪। তদেব।
৫। দেখুন : অচিন্ত্য বিশ্বাস : ‘মিখাইল বাখতিন উপন্যাস তত্ত্ব; বিদ্যা, জানুয়ারি ২০১৪, ১০৯ পৃঃ।
৬। Mikhail Bakhtin : “Forms of Time and Chronotope in the Novel” শীর্ষক প্রবন্ধ, ‘The Dialogic Imagination’, ২৫৪ পৃঃ।
৭। দেখুন ‘Anatomy of Criticism’ প্রিন্সটন, নিউ জার্সি প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়; মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র; ১৮৫৭।
৮। দেখুন : অচিন্ত্য বিশ্বাস :‘পুরাকথা, সাহিত্যতত্ত্ব ও সাহিত্য ভাবনা’ – শীর্ষক প্রবন্ধ; নবেন্দু সেন সম্পাদিত ‘পাশ্চাত্য সাহিত্য তত্ত্ব ও সাহিত্য ভাবনা’, রত্নাবলী; কলকাতা; জুন ২০০৯; ৩৩২ পৃঃ।
৯। পথের পাঁচালী’ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ, শেষ বাক্য। উক্ত ২০ পৃঃ।
১০। ওই; ‘অক্রুর সংবাদ’ – পঞ্চবিংশ পরিচ্ছেদ; ১৮০ পৃঃ।
১১। ওই; ‘আম আঁটির ভেঁপু’– পঞ্চম পরিচ্ছেদ, ২৮ পৃঃ।
১২। তদেব; ২৯ পৃঃ।
১৩। ওই।
১৪। তবেদ; ঊনবিংশ পরিচ্ছেদ; ৮৯ পৃঃ।
১৫৷ তবেদ; ৯১ পৃঃ।
১৬। তদেব; বিংশ পরিচ্ছেদ, ৯২ পৃঃ।
১৭। তদেব; ষড়বিংশ পরিচ্ছেদ, ১১৭ পৃঃ।
১৮। তদেব; সপ্তবিংশ পরিচ্ছেদ, ১২১ পৃঃ।
১৯। তদেব; ষড়বিংশ পরিচ্ছেদ, ১১৭ পৃঃ।
২০। তদেব; ‘অক্রুর সংবাদ’; ত্রিংশ পরিচ্ছেদ; ১৪৮ পৃঃ।
২১। তদেব; ১৪০ পৃঃ।
২২। তদেব।
২৩। তদেব; ১৪৮ পৃঃ।
২৪। তদেব; ১৪৯ পৃঃ।
২৫। তদেব।
২৬। তদেব; চতুর্বিংশ পরিচ্ছেদ, ১০৯ পৃঃ।
২৭। সপ্তবিংশ পরিচ্ছেদ, ১১৯ পৃঃ।
২৭। তদেব।
২৮। চতুর্বিংশ পরিচ্ছেদ, ১১০ পৃঃ।
২৯। শিবনাথ শাস্ত্রী :রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ; নিউ এজ পাবলিশার্স প্রা: লি:, কলকাতা; তৃতীয় সংস্করণ, ১৩৮৪ ব., ৬১-৬২ পৃঃ। উইলিয়াম অ্যাডাম ছিলেন রাজা রাধাকান্দ দেব ও রাজা রামমােহন রায়-সহ বহু বিশিষ্ট কলকাতাবাসী নাগরিকের পরিচিত।
৩০। Macauley, Thomas B: ‘Minutes on Education’; আমরা উল্লেখ করছি, শিবনাথ শাস্ত্রী :রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ’; উক্ত; ১৪১ পৃঃ থেকে।
৩১। David Kopf: ‘British Orientalism and the Bengal Renaissance (The Dynamics of Indian Modernization 1773-1835)’ ফার্মা কে এল মুখােপাধ্যায়; কলকাতা, ১৯৬৯; XIV – Chapter. ২৩৬-২৫২ পৃঃ।
৩২। ‘পথের পাঁচালী’; উক্ত; দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ, ৮ পৃঃ।
৩৩। তদেব; উক্ত; একাদশ পরিচ্ছেদ; ৩৯ পৃঃ।
৩৪। তদেব; ৪০ পৃঃ।
৩৫। তদেব।
৩৬। তদেব; ষােড়শ পরিচ্ছেদ, ৭৬ পৃঃ।
৩৭। তদেব; ঊনবিংশ পরিচ্ছেদ, ১৪০ পৃঃ।
অচিন্ত্য বিশ্বাস
2019-10-07