দোতলা বাড়ি, সরু সিঁড়ি, বাহারি জানালা, দোতলার বারান্দায় রেলিং– সব কিছুই নির্দেশ করে এটি সৌখিন কোনও একজনের বসত বাড়ি। দেওয়ালে গেটের উপর লিখে রেখেছে “শ্রী শ্রী দুর্গা মন্দির। ১৯৬৯ ইং”। এই লেখাও চুনকামের উপর লাল রং দিয়ে লেখা। এমনকি এই নির্মাণশৈলিও ১৯৬৯ এর বেশ আগের।
১৯৬৯ তো আমার নিজের চোখেই দেখা। এমন দুই পাল্লা ওয়ালা খড়খড়ি (আরেক নাম ঝিলমিলি) বাড়িতে খুব একটা পরিচিত ছিলো না। আবার একেবারে রাস্তার উপরে। মন্দির হিসাবে জায়গা বেশ কম। এক স্ন্যাপে নেওয়া পুরো বাড়ির ছবি। বোঝা যাচ্ছে, পরিত্যক্ত অথবা দান করে যাওয়া বাড়িটি-কে ১৯৬৯ সাল হতে ব্যবহার করা হচ্ছে মন্দির হিসাবে।
মন্দির বা বাসাবাড়ি যাই হোক, এলাকাটি মনে ধরেছে আমাদের। শুধু এই দালানটিই নয়, পুরো রস্তার দু-পাশ জুড়ে এমন টাইপেরই দোতলা দালান। যে কোনও কারণেই হোক, এরা এদের বাড়িগুলো ভাঙ্গেনি। মহল্লাটিও হিন্দুই মনে হলো, তার মানে দেশ ত্যাগ করেনি এই মহল্লাবাসীরা। না থাক আধূনিক বাড়িঘর, রাস্তাটি কিন্তু বেশ পরিচ্ছন্ন। এজন্যই ভালো করে খেয়াল করলাম নামটি। এর নাম পরিচয় সহসা ভোলা যাবে না।
গেন্ডারিয়া থানার মিলব্যারাক এলাকার ‘কালীচরণ সাহা রোড’। খুব একটা চওড়া নয় সড়কটি আবার এমাথা ওমাথাও খুব একটা দূর নয়। বলতে গেলে ছোটই কালীচরণ সাহা রোড। ছোট হলেও আমার নিজ মহল্লা ডলফিন গলির চাইতে দীর্ঘ। কিন্তু ডলফিন গলির দুপাশেতো সব ৮ তলা ১০ তলা দালান। কালীচরণ সাহা রোডে তলায় তলায় এপার্টমেন্ট ওয়ালা চার- পাঁচতলা বিল্ডিং একটাও চোখে পড়েনি। মনে ধরার এটিই বিশেষ কারণ। এই মহল্লায় আসার আগে যে পেরিয়ে আসলাম অন্য সব মহল্লা, সব কটাইতো দুপাশে ৮/১০ তলা দালানের মহল্লা।
যাক, শুধু চেহারা নয়, নামটাও পাল্টায়নি এখনও। নিজের নাম বসানোর জন্য ১৯২২ সালে সাড়ে তিন হাজার টাকা দিয়েছিলেন পৌরসভাকে। এই টাকা দিয়েই বিজলী এসেছিলো এই মহল্লাতে। সেই সাথে বিজলির আলোর ঝলকানিতে আগের ‘কাপুড়িয়া নগর’ নাম পাল্টে হয়ে যায় কালী চরণ সাহা স্ট্রীট।
মহল্লার এই নাম হওয়ার পরে বুকের জ্বালা জুড়ায় কালীচরণবাবুর। কারণ তাঁর ‘কম্পিটিশন’ ছিলো বঙ্কবিহারী সাহার পুত্রের সাথে (বিস্তারিত এখনো পাইনি, অনুমান করি একই মহল্লার ছিলেন দুজন।) এই ‘কম্পিটিশনের’ কারণেই নিজ নামে মহল্লা করাতে সাড়ে তিন হাজার টাকা খরচ করা। তবে এর আগের নামটি পাওয়াতে কিছুটা আভাস পাওয়া গেলো এই মহল্লার ‘খুব একটা সুপরিসর নয়’ বাড়ি ঘরের। আদতে এটি ছিলো কাপড় কেনা বেচার ‘পট্টি’। সম্ভবত এই মহল্লাতেই দোকানপাট ছিলো কালী চরণ সাহা, বঙ্কুবিহারী সাহা-দের। নামের পদবীও অনেকটা এই ইঙ্গিতই দেয়। ‘দীননাথ সেন রোডের’ দীননাথ সেনের মতো বিদ্যা, সমাজসংস্কারে অগ্রণী ছিলেন না ঠিক, কিন্তু ব্যবসাপাতি করে টাকা কামিয়েছিলেন ভালোই। এজন্যই টাকা দিয়েই ’কম্পিটিশন’ ছিলো মহল্লার একজনের সাথে আর একজনের।