সারা বছর পশ্চিমবঙ্গের বাঙ্গালীর প্রকার বোঝা যাক না যাক ‚ কিন্তু পুজোতে বাঙ্গালী কেবলমাত্র চার প্রকার – প্রথম হলো ঐ বাঙ্গালী যে যে কলকাতাতে থাকবেই আর পুরো পুজোটা বাঙ্গালীর মতো কাটাবে। দ্বিতীয় হলো যে সারাবছর পশ্চিমবঙ্গে থাকে কিন্তু ঠিক পুজোর কটা দিন বাইরে ঘুরতে চলে যায় ‚ তৃতীয় হলো ‚ ওই বাঙ্গালী যে সারা বছর বাইরে আছে কিন্তু কিন্তু পুজোতে কলকাতায় না যাওয়ার দুঃখটা অতি চরম পর্যায়ে পৌঁছে যায় আর চতুর্থ শ্রেণী হলো বাঙ্গালী যে কলকাতার বাইরে থাকে আর সেই শহরের পুজোটাকে পুরোপুরি উপভোগ করে। আমি অনেক দিন কলকাতার বাইরে ‚ তাই কবে যে তৃতীয় শ্রেণী থেকে চতুর্থ শ্রেণী হয়ে উঠেছি ঠিক বলতে পারবোনা। তার মানে এটা নয় যে কলকাতার পুজোর কথা মনে পড়েনা ‚ কিন্তু বাঙ্গালী তো এমনিতেই আমুদে ‚ তাই আনন্দ না করতে পারলে মনটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগে। আমি পুনেতে থাকি। গনেশ চতুর্থীর ১০ দিন ধরে বেশ ঢোল আর তাশ বাজে কিন্তু তারপর মা আসার যে পরিচিত ছবি আমাদের মনে আঁকা আছে সেটার সাথে বাস্তবের মিল খুঁজে পাইনা।

ঢাকের কাঠির আওয়াজ ‚ প্রতিমা ধাঁচা ‚ মন্ডপের কাঠামো রাস্তার মাঝখানে ‚ এই ফেলে আসার আক্ষেপ টা একটু অন্যরকম ‚ কিরকম নিঃসহায় লাগে। যাই করি ঠিক মনে হবে যে দুধের সাধ ঘোলে মেটাচ্ছি।

তাই যখন পুজোর কয়েকটা বাঙ্গালী গ্রুপ থেকে প্রায় ৪০ টি পুজোর লিস্ট পেলাম ‚ তখন ঠিক যেন হরি লুটের বাতাসা হাতে পাওয়ার আনন্দ হলো। ৪০ টা মানে ৪ দিন পুরো কভার্। তাই গত বছর থেকে দুধের সাধ ঘোলে মেটানোর জন্যে বেরিয়ে গেলাম।

পুনেতে সবথেকে পুরনো বলতে গেলে কংগ্রেস ভবন বা গ্রেটার পুনা সার্বজনীন দুর্গোৎসব এর পুজো। শিবাজি নগরের এই পুজো এবারে ৭৯ বছর পুরো করবে। এটাকে আপনি বলতে পারবেন পুনের সবথেকে সাবেকী পুজো। মায়ের প্রতিমা আমাদের কলকাতার মতো মিষ্টি আর ঘরোয়া। খাওয়ার স্টল আর লোকজনের ভীড় ষষ্ঠী থেকেই লেগে থাকে। এইবারে সপ্তমী আর অষ্টমী ছুটির দিন ‚ তাই আশা করছি প্রচুর ভীড় হবে। ঢাকীর ঢাকও আছে আর ধুনুচি নাচও আছে। সব মিলিয়ে বেশ ভালোই লাগে।

এর পরে যে দুটো পুজো আমার ভালো লাগে সেটা হলো দুটো কালীবাড়ির পুজো। প্রথমটি হলো পুনেশ্বরী কালীবাড়ি ‚ হাদাপ্সার্। মন্দিরের প্রাঙ্গণে হয় এই পুজো ‚ ভীড় খুব বেশি কিন্তু পুরুতমশাই রা খুব হাসিমুখে অঞ্জলি দিতে ব্যস্ত বাঙ্গালী দের ঠেলাঠেলি টা সামলে নেয়। সকাল বেলা এইখানে অঞ্জলি দিয়ে দিন শুরু করলে বেশ মনে হয় এতো কলকাতার পুজোর মতোনই। আক্ষেপ টা একটু হলেও কমে যায়।

আর একটা কালীবাড়ি আছে ‚ সেটা হলো খড়কি কালীবাড়ি। এইখানে প্রচুর ভীড় হয় ‚ সাথে একটা ছোটোখাটো মেলা মতোন বসে। কাসুন্দি থেকে বাঁসুন্দি সব পাওয়া যায়। পুজোর প্রত্যেক দিন ভোগ দেওয়া হয়। ভোগ ‚ আরতি‚ মেলা‚ অনুষ্ঠান সব মিলিয়ে একটা ‘কমপ্লিট’ পুজো।

আর একটা নাম করা পুজো হলো রোহি ভীলা ‚ কোরেগাঁও পার্ক। নান্দনিক সংস্থার এই পুজো বেশ নাম করা। পুজোতে চার দিন পুজো আর তার সাথে জমাটি প্রোগ্রাম। খাওয়া দাওয়ার স্টল প্রচুর কিন্তু তার সঙ্গে তেমনি ভীড়। এই পুজো হলো ঠিক যেন কলকাতার বাবুবাগান। গলির মধ্যে ‚ প্রচুর ভীড় ‚ তাও ঠিক মিস করা যায়না।

যখন আমরা হয়তো ভাবি যে বাইরে থেকে বাঙ্গালীরা হয়তো বাঙ্গালী থাকতে চায়না ‚ তখন দুটো একদম নতুন পুজো আপনার এই ভুল টা ভাঙ্গিয়ে দেবে। প্রথম টা হলো আগমনী প্রবাসী সংঘ দ্বারা আয়োজিত বৃন্দাবন লন ‚ বানের এই পুজো ২০১৮ থেকে শুরু হয়েছে। এইবার দ্বিতীয় বছর। এই বছর এদের পুজো শুরু হয়েছে রক্তদান শিবির দিয়ে ‚ তারপর মা এসেছে প্যান্ডেলে। দিনের বেলায় প্রায় ১২০০০+ লোক জনের মধ্যে ভোগ বিতরণ করা হবে এই চার দিনে। এই পুজোতে শুধু বাঙ্গালী নয় ‚ অসমীয়া ‚ ওড়িয়া ‚ মারাঠি সবার ভীড় দেখা যায়। গতবারের পুজোর সাফল্য দেখে এবারের পুজোটা কিন্তু অনেক বড় করে করা হয়েছে। পুনের সবথেকে বড় প্রতিমা ‚ দুর্দান্ত লোকেশন ‚ আর সন্ধ্যের প্রোগ্রাম কি বলব “star-studded” ! অলকা য়াগ্নিক ‚ মির আর ব্যান্ডেজ ( কলকাতা ) ‚ দিক্সু আর রূপম ভুবন ( আসাম ) ‚ শাশ্বত যোশী ( ওড়িশা ) আর মালাং ( পুনে) আপনাকে মাতিয়ে দেবে সন্ধ্যে বেলায়। এই পুজোতে প্রায় ৫০০০০ লোকের ভীড় এই চার দিনে হবে সেটা বললে কিন্তু খুব বেশী বলা হবেনা।

গত বছর থেকে অগ্রদূত বঙ্গসমাজ নিজেদের পুজো শুরু করেছে খারাদি ‚ পুনেতে।
আইটি পার্কের কাছে এই পুজোতে ‚ পুনের প্রবাসী আইটি প্রফেশনালদের ভীড় হবে এইটা বললে ভুল হবেনা। পুজোর আয়োজন ছাড়াও এই পুজোর আয়োজকরা নিজেদের সমাজের প্রতি কর্তব্য চালিয়ে যেতে ইচ্ছুক তাই বিভিন্ন সয়ংসেবী সংস্থা অনাথালয় কে নিজেদের সাথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা রেখেছে।

এবারে এদের থিম হলো “গ্রাম বাংলা” ! তাই রক্তদান শিবির আর থ্যালাসেমিয়া সচেতনতা শিবিরও হয়েছে। এই পুজোতে প্রত্যেকদিন প্রায় ২০০০ লোকজন দের ভোগ দেওয়া হচ্ছে! তা ছাড়াও প্রত্যেক দিন প্রায় সাড়ে তিন হাজার লোকের ভীড় তো দেখতেই পাওয়া যাবে। এদের এবার একটা সারপ্রাইজ প্যাকেজ আছে “হ-য-ব-র-ল” ! এদের নিজেদের ব্যান্ড সন্ধ্যেবেলায় অনুষ্ঠান করছে।

তাই এইবছর আর কলকাতার মতো পুজো ‚ প্রতিমা ‚ থিম ‚ লাইটিং আর কারুকার্য খুঁজছিনা। এই বছর পুনের মতোন পুজো দেখবো ‚ পুজোর মন্ডপে ঘুরবো ‚ আনন্দ করবো আর সেই দশমীতে সবার সাথে চেঁচিয়ে বলব – ” আসছে বছর আবার হবে”।

বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.