কথায় কথায় বলা হয়, চণ্ডালের রাগ বা রেগে গেলে চণ্ডাল! অপভ্রংশে “চাঁড়াল।” ঋষি বিশ্বামিত্রের কারণে রাজা হরিশ্চন্দ্র পর্যন্ত রাজ্যপাট হারিয়ে চণ্ডাল হয়ে শ্মশানে মড়া পোড়াতেন।
তবে চণ্ডালদের রাগ যদি বেশি, তবে তাঁরাও রাগ ছেড়ে বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলেন। কিন্তু অহিংসার ধর্মে আশ্রয় নিলেও রাগ নিয়ে তাঁদের সম্পর্কে প্রবাদ তৈরি হয়েছে। সৌজন্যে অবশ্যই ব্রাহ্মণ সমাজ। বৌদ্ধযুগে চণ্ডালরা বৌদ্ধ হলেও পরবর্তী সময়ে সেনযুগ এবং আরও পরে যখন তাঁরা ব্রাহ্মণ্যধর্মের আওতায় এলেন, তখন তাঁদের স্থান দেওয়া হলো সমাজের একদম নিচের দিকে। তাই বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণ্যধর্মে এসেও চণ্ডালদের সম্পর্কে রাগের কথাটা থেকেই গেল।
গবেষকদের মতে, চণ্ডাল জাতির মধ্যে প্রায় ২২ শতাংশ হচ্ছেন দ্রাবিড় রক্ত মিশ্রিত মানুষ। চণ্ডাল যে বাংলার প্রাচীন একটি জাতি, তার প্রমাণ চর্যাপদের ৪৯ সংখ্যক পদে তার উল্লেখ রয়েছে, যেমন—
“বাজনাব পাড়ী পঁউআ থাঁলে বাহিউ
অদয় বঙ্গালে ক্লেশ লুড়িউ
আজি ভুসুক বঙ্গালী ভইলী
নিজ ঘরিণী চণ্ডালী লেলী। ।”
অর্থাৎ, পদ্মখালে বাইলাম বজ্রনৌকো, দয়াহীন বঙ্গালে লুটে নিল ক্লেশ। ভুসুক আজ বাঙ্গালী হলো, নিজ গৃহিণী নিলো চণ্ডালী।
বৌদ্ধতন্ত্রে এক দেবী রয়েছেন, নাম—চণ্ডালী। বৌদ্ধ ধর্মের বজ্রযান সাধকপন্থীদের সাধনমালা ও নিষ্পন্ন যোগাবলী তন্ত্রের পু়ঁথিগুলির মধ্যে বেশ কয়েকবার উল্লেখ আছে দেবী চণ্ডালীর। গৌরীদেবী বিভাগের সপ্তম দেবী এই চণ্ডালী। তিনি নীল বর্ণা, ডান হাতে অগ্নিকুণ্ড, বাম হাতের তর্জনী স্পর্শ করে আছে নিজের বুক।
রাঢ়-বাংলার চণ্ডালরা নিজেদের সঙ্গে রামায়ণের রামচন্দ্রের মিতা বা বন্ধু গুহক চণ্ডালের সম্পর্কের কথা বলেন। তাঁদের কথায়, যখন রাম, লক্ষ্মণ ও সীতা গুহক চণ্ডালের বাড়িতে আতিথ্য নিলেন, তখন তাঁদের উড়কি ধানের মুড়কি এবং পানিফলের পায়েস খেতে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু আনন্দের আতিশয্যে পানীয় জল দিতে বেমালুম ভুল হয়ে গেল। তখন থেকে নাকি উচ্চ বর্ণের হিন্দুদের কাছে তাঁদের ছোঁয়া জল অশুচি বলে গণ্য হয়ে গেল। তবে যেহেতু শ্রীরামচন্দ্র চণ্ডাল বাড়িতে তাঁদের দেওয়া উড়কি ধানের মুড়কি ও পানিফলের পায়েস খেয়েছিলেন, সেহেতু শারদীয়া দুর্গাপুজোয় চণ্ডালদের দেওয়া মুড়কি ও পানিফল নিবেদিত হয়ে থাকে।
চণ্ডাল বাড়িতে রাম এসেছেন শুনে গোটা পাড়ায় কি রকম হৈ-হৈ পড়ে গিয়েছিল, নিচের প্রবাদটি তার সাক্ষী:
“রাম এসেছে, রাম এসেছে, পড়ে গেল সাড়া।
ধা গুড় গুড় বাদ্যি বাজে, নাচে চণ্ডাল পাড়া। ।”
রাঢ়-বাংলার চণ্ডালদের মধ্যে চারটি ভাগ রয়েছে—কেশর, নুনে, পানফলে ও কোটাল। বৃত্তি অনুয়ায়ী এই ভাগ। যেমন, কেশরের কারবারীরা কেশর, নুন তৈরি করতেন যাঁরা, তাঁরা নুনে, পানফলের কারবারীরা পানফলে এবং যাঁরা পাহারাদারের কাজ করতেন, তাঁরা কোটাল।
চণ্ডালদের মধ্যে প্রচলিত গোত্রগুলি হলো—
কাশ্যপ, শাণ্ডিল্য, সিঁদ ঋষি প্রভৃতি। সগোত্রে এঁদের বিয়ে হয় না। চণ্ডালদের মধ্যে কেউ কেউ পৈতে পরেন।
চণ্ডালদের মধ্যে মৃতদেহ দাহ করার প্রথা আছে। অশৌচ হয় দশদিন। আর কালীপুজো ও চৈত্র সংক্রান্তির দিন পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যে শ্রাদ্ধ করা হয়। তবে বর্তমানে সব জাতির মধ্যেই বৃত্তির বদল ঘটছে। চণ্ডাল জাতি এখন আলোর বৃত্তে আসছেন।
তথ্যসূত্র:
১) রাঢ়ের জাতি ও কৃষ্টি, প্রথম খণ্ড: ড: মানিকলাল সিংহ।
২) বাঙালি জাতি পরিচয়: শৌরীন্দ্র কুমার ঘোষ।