একটা পুরোনো বাংলা গান ছিল কৃষ্ণ আছেন মথুরাতে ঢাকেশ্বরী ঢাকায়। গত বছর সুযোগ এসেছিল এক সময় অবিভক্ত বাংলার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শহর ঢাকা যাওয়ার। অবশ্য সরাসরি নয় জীবনানন্দের জন্ম ও মানস ভূমি বরিশাল বিভাগের ফিরোজপুর জেলার অন্তর্গত নাজিরপুর উপজেলার একটি আশ্রমের দুর্গা পুজোর অসামান্য কটি দিন কাটানোর পর। আমাদের যাওয়াটা কোনো আমন্ত্রিত বা ভ্রমণ সংস্থার সঙ্গে ছিল না, তাই অবিশ্বাসের যে চোরা স্রোত বহতা আছে সেটি বেগবানই ছিল।
আশ্রমের পরিচালক মুক্তিযুদ্ধের সময় অনেক আশা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন যদি হিন্দুর কোনো ভবিষ্যৎ কল্যাণ হয়। ঘুরে ঘুরে দর্শনীয় স্থান বর্ণনার ফিরিস্তি এটি নয়। তৎকালীন চিত্তরঞ্জন সুতার ও কলকাতা কেন্দ্রিক ডাক্তার ও হিন্দু বাঙালির চির শুভাকাঙ্ক্ষী শ্রী সুজিত ধর মহাশয়ের সবরকমের সহযোগিতা ছিল হিন্দুর অবস্থানটিকে নতুন দেশে যদি একটু মজবুত করা যায়। ষষ্ঠীর পুণ্য সন্ধ্যায় আশ্রমের আবাসিকরা আক্ষরিক অর্থে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। বহুদিনের কোনো আত্মীয় সঙ্গসুখের খুশিতে তাঁদের মুখ উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছিল। প্রয়াত ড. ধরের স্ত্রীকে তাঁরা মা জ্ঞান করেন। তাঁদের এ স্নেহ আকছার চোখে পড়বে না। ভারতের বাঙালি যে তাদের কতখানি ভরসার স্থল তা না দেখলে উপলব্ধি হবে না।
প্রতিমার ওখানে অনিয়ন্ত্রিত ঢাক ঢোল বাজানো বাঞ্ছনীয় নয়। যতোটা সঙ্কোচে হয় আরকি। আশ্রম পরিচালক সমগ্র পূজা মন্ত্রকে বাংলায় তর্জমা করে অসাধারণ কাজ করেছেন। গড়পরতা মানুষ সংস্কৃত মন্ত্রগুলি বুঝে পুজোয় অংশ নিচ্ছে। হারমোনিয়ামের সুরে মন্ত্রপাঠ চলছে। আড়ম্বর যে আন্তরিকতার প্রতিদ্বন্দ্বী নয় তা বোঝা যায়। সন্ধ্যা আরতিতেও স্বামীজি দেওয়াল ভেঙে দিলেন। পড়শি মেয়েরা প্রাণ খুলে দেবীর সামনে নাচল। সে আকুল নিবেদন অনেক অকথিত কষ্ট থেকে মুক্তির প্রার্থনায় ভরা, অশ্রুসজল। রাতে বাংলাদেশের স্পেশাল বৃষ্টি নামলো। টিনের চাল হওয়ায় ও সঙ্গে লোডশেডিং এর সহায়তায় শহরে দুষ্প্রাপ্য নিকষ কালো অন্ধকারে পৃথিবী রসাতলে যাওয়ার পর্যাপ্ত ইঙ্গিত ছিল। পরিবেশের কুহকেও হতে পারে। পুজোর একটি করে দিন আসছে যাচ্ছে।
গ্রামটি হিন্দুপ্রধান হলেও দর্শনার্থীর সংখ্যা কম। প্রতি সন্ধ্যায় বুকে রেজাউল বা সানাউল্লা নাম লেখা পুলিশ কর্তার আগমন ছিলো বাধ্যতামূলক। তাঁরা স্বামীজির আপ্যায়ন গ্রহণ করে কিছুটা ধন্য করে যেতেন। আমাদের কতদিন থাকা হবে কেনই বা এলাম কী কী ভাল লাগছে ইত্যাদি আপাত নিরীহ প্রশ্নাবলীরও উত্তর নিয়ে ফিরতেন। স্বামীজি বলতেন বুঝে নিন এদের কত উদ্বেগ। বিরক্তিতে তাঁর মুখমণ্ডল আচ্ছন্ন হয়ে যেত। বলতেন পুকুরপাড়ে চব্বিশ ঘণ্টা আপনাদের পুজোর কদিন নিরাপত্তা দিতে বসে থাকা আনসার বাহিনীকে দেখেছি কিনা। কাউকেই পূর্ণ বিশ্বাস করার সুযোগ তিনি পাননি। এমনি সব ঘটনার সাক্ষী হতে হয়েছে। রক্ষী বাহিনীর মধ্যেও তিনি দু’ এক জন হিন্দু লোক দেওয়ার অনুরোধ করতেন যাতে অন্তত ভারসাম্য থাকে।
আশ্রমকে ঘিরে রয়েছে তিন দিকে ঘর. কিছু বাংলার মাটিতেই তৈরি, কিছু টিনের ছাত সমেত পাকা। সান্ধ্য জলখাবারের পর একটু রাত নামতেই পাশ দিয়ে বয়ে চলা নদীর সদ্য ধরা মাছ দিয়ে হল নৈশভোজ। রাত পোহাতেই বোঝা গেল পদ্মা যমুনা আর কথকতা কীর্তন প্রিয় বাঙালির কীর্তনখোলা নদী ঘেরা রূপসী বরিশালের অপার রূপ। ভোরের পাখপাখালি হাঁস মুরগীদের দখলে থাকা নিজস্ব কলকাকলিময় নৈঃশব্দ্য। বোঝ যায় জীবনানন্দের প্রকৃতি প্রেমের নিজস্বতা। একটি খাল থেকে অন্য পারে যাওয়ার শুধুই দু’ গাছা বাঁশের সেতু। অবলীলায় পেরিয়ে যাচ্ছে মানুষজন ও শিশুরা। সকাল হতেই তো কখন সপ্তমী পড়ে গেছে। তোড়জোড় চলছে দূরের কালীগঙ্গার মোহনা থেকে জল আনার। বছরে একবার অবরুদ্ধ আবেগ কাঁসর ঘণ্টা শঙ্খধ্বনির নাতিদীর্ঘ জল যাত্রায় যে মুক্তির স্বাদ পায় তার তুলনা নেই। যাদের পাড়ায় পুজো হয়নি নদীর দুকূল ধরে সেই নারী পুরুষ শিশুদের দৌড় আমাদের নৌকাযাত্রা ঘিরে ভোলা যায় না। সেই অসহায়তা শুধুই অনুভবের বস্তু। তাকে ক্যামেরাবন্দি করা অপচেষ্টা তবু করা হয়েছে।
সন্ধি পুজোর আরতির পর স্বামীজির এক অতিথি এলেন পুজোর শুভেচ্ছা বিনিময় করতে।স্বামীজির ডাকে সকলেই গেলাম অতিথি সন্দর্শনে।কালো পেটা চেহারা বয়স আনুমানিক পঞ্চাশ। কুশল বিনিময়ের পর বিদায় নিলেন। স্বামীজি স্নেহ তিরস্কার করলেন দিদিকে। মা তোমার সোনার বালাটা দেখে চোখে পুরোনো দ্যুতি ফিরে এসছিল মইদুলের। পুরোনো অপরাধীর পেশার কথা মনে পড়ছিল। সেই প্রথম এমন ছদ্মবেশী এক বেআইনি মানুষের সঙ্গে বাক্যালাপের সুযোগ হলো।
পূজা মন্ত্রের অনুবাদ ছাড়াও স্বামীজি জাতিভেদ প্রথাও নিঃশব্দে ভেঙে দিয়েছেন। এখানে ব্রাহ্মণ হতে গেলে ব্রাহ্মণকুলে জন্মানো শর্ত নয়। তিনি তরুণ ছেলেদের উপনয়ন করিয়ে ব্রাহ্মণ্য ধর্মে দীক্ষিত করেছেন। তারা ভারত সম্পর্কে সর্বাংশে কৌতূহলী; ইতিহাস, সমকালীন রাজনীতিতে তাদের বিশ্লেষণ ঈর্ষণীয়। জানার ইচ্ছা অদম্য। কয়েকটি স্বস্তিকা নিয়ে গিয়েছিলাম তারা সাগ্রহে শেষ করে আলোচনা শুরু করলো। অনেকেই আশ্রমে থেকে স্কুল কলেজে পড়ে। চাকরি পেলেও শিকড়কে ভোলে না। এটিই যথার্থ গুরুকুল। পুজোর পুরোহিত কেউ একা নয়। সম্মিলিতভাবে উপাসনা, অর্চনা চলছে। স্বামীজির পূর্বাশ্রমের পদবি মিস্তিরি। সন্ন্যাস নাম শ্রীকুমার আচার্য। কয়েক বিঘা পৈতৃকজমির ওপর এই আশ্রমে তিনি হিন্দুদের ভরসাস্থল হিসেবে বিরাজ করছেন। এখানে প্রতিমা বিসর্জিত হয় না। তার অন্তর্নিহিত কারণ অনেক কিছু হতে পারে। দশমীর দিন তিনি স্থানীয় স্কুল কলেজের হেডমাস্টার, অধ্যাপক, অধ্যক্ষ, সর্ব সম্প্রদায়ের মানুষের সম্মেলন ঘটান। ডেকে নেন মধ্যাহ্ন ভোজে। জনে জনে আপ্যায়িত করেন।
নিগূঢ় উদ্দেশ্য তাঁরা যাতে হিন্দুর প্রতি একটু সুনজর দেন। এ কলকাতার রাস্তায় ভাষা দিবস পালনের ভণ্ডামি নয়, শত্রু পরিবৃত অবস্থায় প্রতিকূল পরিস্থিতির বুকের কলজে দিয়ে মোকাবিলা। উনি কোনো অবস্থায় ছেড়ে আসেননি। উল্টে ঝুঁকি নিয়ে তৈরি করেছেন একটি কল্যাণধর্মী সমাজ। মানুষের মধ্যে উন্মেষ ঘটিয়েছেন মনুষ্যত্বের। ফিরোজপুর ছেড়ে আরো দূর অঞ্চলে উনি নানা হোম পূজাপাঠ আলোচনা করতে যান। এই আশ্রমেই বসে ভারি সুন্দর নামের একটি সংস্থার বৈঠক সুজন সমাবেশ। সকলেই শ্রদ্ধা করেন স্বামীজিকে। বাঙ্গালীর উত্তরায়ণ, গুরুপূর্ণিমা, হরিনাম সঙ্কীর্তন, জলজঙ্গলের নিরাপত্তা কিছুই তাঁর অনুশীলনের বাইরে নয়। দশমীর সন্ধ্যায় আশ্রমে আবার অতিথি সমাগম হয়। চলে প্রণামের পরম্পরা। পুজোর ছোট বড় সকল অংশগ্রহণকারীদের কিছু না কিছু উপহার দেন তিনি। আশ্রমিকরা কপালে এঁকে দেন মঙ্গল তিলক।
শ্রান্ত স্বামীজি অতি সাধারণ শয্যায় মানুষের শুভ কামনায় মগ্ন হয়ে যান। একাদশীর সকাল থেকেই রাত পোহানোর বেদনা ঘিরে ধরে। চলি মুন্সিগঞ্জের পদ্মা পেরিয়ে বুড়িগঙ্গার ঢাকায়। ঐতো রমনা কালীবাড়ী। আরে ওই যে সেই ঢাকেশ্বরী মন্দির দেখালেন সোনালী ব্যাঙ্কের জেনারেল ম্যানেজার। বেলা হয়ে গেছে। কলকাতার রাস্তায় যেমন দেশ গ্রামের স্মৃতি জড়ানো ঢাকা বা বিক্রমপুর মিষ্টান্ন ভাণ্ডার দেখা যায় এবার আসল ঢাকা বিক্রমপুরের মিষ্টির দোকান দেখে ঢুকে পড়লুম। বিনিময় মূল্যের কারণে আমাদের দশ টাকার মিষ্টি এখানে মোটামুটি পনেরো টাকা। রমনা মন্দিরের জমি কেড়ে নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। তাঁর বাড়িটি জাদুঘর। শয়নকক্ষে তাঁর অর্ধ পান করা একটি কোকাকোলার বোতল স্মৃতিভারেও সোজাই রয়েছে।
ঘর থেকে বেরোলেই সিঁড়ির জায়গায় জায়গায় অসস্পষ্ট রক্তের দাগগুলিকে অক্ষয় করতে কর্তৃপক্ষ সেলোটেপ লাগিয়ে দৃষ্টি আকর্ষিত করেছেন। ফিরোজপুর রামকাটি আশ্রমস্থিত দেবীর নয়নদুটি হয়তো তাঁর অসহায় ভক্তদের জন্য চিরঅশ্রুসজল। গোয়ালন্দ হয়ে এবার বাস সমেত পদ্মার ওপর। গন্তব্য গঙ্গাপার।