প্রাচীন ভারতে যুদ্ধের এক অপরিহার্য অঙ্গ ছিল হস্তিবল অর্থাৎ হাতীর শক্তি। প্রাচীন ভারতে হিন্দু সেনাবাহিনীতে চতুরঙ্গ সেনাদল ছিল, যার অন্যতম ছিল হস্তিবাহিনী। সেজন্য মৌর্য সম্রাট চন্দ্রগুপ্তের আমলে উৎকৃষ্ট হাতি জন্মানোর জন্য বিশেষ চেষ্টা করা হয়েছিল। কেউ হাতি হত্যা করলে তার প্রাণদণ্ড পর্যন্ত হতো। হাতিদের জন্য ছিল হস্তিবন। আর সেগুলি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ছিল নির্দিষ্ট সরকারি কর্মচারি। সরকারিভাবে ছিল হস্তিপালন বিভাগ। এর জন্য অনেক কর্মচারি ছিল, যাদের মধ্যে প্রধান ছিলেন হস্ত্যধ্যক্ষ।
হাতিশালার হাতিদের দেখাশুনা ও হাতিদের জন্য সংরক্ষিত বনগুলির নিয়মিত তদারকির ব্যবস্থা ছিল। হস্তিবনের দেখাশুনার জন্য ছিল “নাগবনপাল” নামের এক বিশেষ রাজকর্মচারি। বনের পরিধি, বনের প্রবেশ পথ, বাইরে বেরোনোর পথ, পাহাড়, নদী, হ্রদের অবস্থান সম্পর্কে সহকারিদের সাহায্যে নাগবনপাল এসব তথ্য সংগ্রহ করতেন। আর হাতি ধরার জন্য ছিল “নাগবনাধ্যক্ষ।”
নাগবনাধ্যক্ষদের সাহায্য করার জন্য ছিল—
১) হস্তিপক: এরা হাতি তাড়া করে আনতো।
২) পাদপাশিক: এদের কাজ ছিল হাতির পায়ে ফাঁস লাগানো।
৩) সৈমিক: নাগবনের সীমান্ত রক্ষী।
৪) পারিকর্মিক: বিভিন্ন কাজের জন্য চাকর।
৫) বনচরক: যারা বনে ঘুরে বেড়াতো।
৬) অনীকস্থ: হাতি শিক্ষক।
কোন্ হাতি ধরার যোগ্য, তা দেখেই বুঝতে পারতেন অনীকস্থরা। তবে ছোট দাঁতের হাতি, অসুস্থ, গর্ভবতী, ছোট্ট বাচ্চা আছে এমন মা হাতি, কম বয়সী দন্তবিহীন, বালক হাতি ধরা হতো না। কখনও কখনও খেলার জন্য দু’চারটি ধরা হতো।
হাতি ধরতে “হস্তিবন্ধকী” নামে হস্তিনীদের কাজে লাগানো হতো। হাতি ধরার উপযুক্ত সময় ছিল গ্রীষ্মকাল। হাতিদের পায়ের ছাপ, বিশ্রাম স্থল, হাতিদের দ্বারা বিধ্বস্ত হ্রদ কিংবা নদীতীর ও তাদের মলমূত্রের গন্ধ অনুসরণ করে পাঁচ-সাতটি কুনকি হাতি নিয়ে হাতি ধরার দলটি বনে ঘুরে বেড়াতো। সাধারণত ভেলা গাছের সারি দিয়েই এই দলটি খোঁজাখুঁজি করতো। এর কারণ, ভেলা গাছের ঠাণ্ডা ছায়ায় হাতিরা বিশ্রাম করতো, কিংবা এই গাছের পাতা তাদের প্রিয় খাদ্য ছিল। লেফটেন্যান্ট ইভান্স রচিত গ্রন্থে এসব বিবরণ আছে।
হাতি ধরার কৌশল সম্পর্কে চমৎকার বিবরণ আছে মেগাস্থিনিসের লেখায়। তা থেকে জানা যায়—
কিছুটা ফাঁকা জায়গার চারদিকে গভীর খাত কাটা হতো। এই খাতের ওপর তৈরি করা হতো একটি সরু সেতু। এই সেতুটিই ছিল ভেতরের প্রবেশ। তিন-চারটি প্রশিক্ষিতা হস্তিনীকে এই খাত পরিবেষ্টিত এলাকায় ছেড়ে দেওয়া হতো। আর লোকজন গুপ্ত কুঁড়ের ভেতরে লুকিয়ে থাকতো। বুনো হাতিরা দিনের বেলায় এর ভেতরে আসতো না, তবে রাতের বেলায় এই ফাঁদে পা দিতো। হাতির দল ভেতরে ঢোকামাত্র লোকজন ছুটে এসে বাইরের পথ বন্ধ করে দিতো। খাবার না পেয়ে তারা দুর্বল হয়ে পড়তো। তখন বলিষ্ঠ পোষা হাতিদের ভেতরে ছেড়ে দেওয়া হতো। দু’পক্ষের মধ্যে জোর লড়াই চলতো। এরপর যখন বুনো হাতিগুলি ক্লান্ত হয়ে পড়তো, তখন সাহসী মাহুতরা গিয়ে তাদের পেটের তলায় গুড়ি হয়ে ঢুকে বুনো হাতিদের পা বেঁধে ফেলতো।
এরপর হাতিদের রাজকীয় হাতিশালায় এনে তাদের পরিচর্যা করা হতো। এই হাতিশালা ছিল দু’ভাগে বিভক্ত—এক ভাগে থাকতো দুর্গের ভেতরে, অন্য ভাগটি বাইরে। দুর্গের ভেতরে থাকতো সামরিক শিক্ষায় শিক্ষিত হাতিরা, আর বাইরে রাখা হতো শিক্ষাধীন অবাধ্য হাতির দল।
উত্তর অথবা পূর্ব দিকে মুখ করে তৈরি হতো হাতিশালা। উচ্চতায় একটি হাতির দ্বিগুণ এবং এর উচ্চতার অর্ধেক লম্বা হতো এগুলি। হস্তিনীদের জন্য ছিল পৃথক ঘর। ঘরের মধ্যে হাতিদের শোবার ব্যবস্থাও থাকতো। আর হেলান দেবার জন্য একটি মঞ্চ তৈরি করা হতো।
হাতিশালা তদারকির জন্য ছিল—
১) চিকিৎসক,
২) হস্তিশিক্ষক “অনীকস্থ”,
৩) আরোহক অর্থাৎ মাহুত,
৪) আঘোরণ অর্থাৎ দক্ষ মাহুত,
৫) হস্তিপক (হস্তিরক্ষক),
৬) ঔপচারিক (হাতিদের জন্য পরিচারক),
৭) বিধাপাচক ( হাতিদের জন্য রাঁধুনি),
৮) যাবসিক ( ঘাস সরবরাহকারী),
৯) পাদপাশিক ( যারা হাতির পায়ে শেকল পরাতো),
১০) কুটিরক্ষ ( পাহারাদার),
১১) উপশায়িক ( রাতের বেলায় হাতিদের পরিচর্যার কাজে নিযুক্ত ব্যক্তি)।
উপরোক্ত সকল কর্মচারিদের বেতন ও খাবার দেওয়া হতো।
বয়স অনুসারে হাতিদের খাবার দেওয়া হতো। খাদ্য তালিকায় ছিল—
চাল, তেল, ঘি, লবণ, ফলের শাঁস, রস বা দৈ, শর্করা, মদ্য, দুধ, মাঠের কাঁচা ঘাস, বড়ো ঘাস, খড় ও বিভিন্ন ডাল কলাইয়ের ডাঁটা। গায়ে ও মাথায় মাখার জন্য বরাদ্দ ছিল তেল। এছাড়া তেল দিয়ে প্রতিটি ঘরে থাকতো প্রদীপ জ্বালানোর ব্যবস্থা।
সকাল ৬ টা থেকে সাড়ে সাতটার মধ্যে একবার এবং বিকেলে বেলা ৩ টে থেকে সাড়ে চারটের মধ্যে আরেকবার—এই দু’বার হাতিদের স্নান করানো হতো। স্নানের পর তাদের খাবার দেওয়া হতো।
এরপর দুপুরে হাতিদের ব্যয়াম করানো হতো এবং তারপর বিকেলে তাদের শিক্ষা দেওয়ার কাজ চলতো।
হাতিদের শিক্ষার জন্য ছিল দক্ষ শিক্ষক। শিক্ষার জন্য হাতিদের চারটি শ্রেণীতে ভাগ করা হতো—
১) দম্য ( যেগুলিকে পোষ মানানো হতো),
২) সান্নাহ্য ( যুদ্ধের জন্য শিক্ষা দেওয়া হতো),
৩) উপবাহ্য ( যুদ্ধের পর শান্তির কাজে আরোহণের জন্য তৈরি করা হতো) এবং
৪) ব্যাল ( অবাধ্য)।
শিক্ষার বিভিন্ন স্তর ছিল, যেমন—
১) যুথগত অবস্থা: বুনো হাতিগুলি ধরে আনার পর পোষা হাতিদের সঙ্গে রাখা হতো। এর ফলে তারা ক্রমশ শান্ত হয়ে যেতো।
২) অপপাতগত অবস্থা: বুনো হাতিদের হিংস্র ভাব দমন করতে তাদের কৌশলে একটি গর্তে ফেলে রাখা হতো।
৩) বারিগত অবস্থা: এরপর বুনো হাতিদের বনের একটি নিদির্ষ্ট সীমানার মধ্যে ছেড়ে দেওয়া হতো।
৪) স্তম্ভগত অবস্থা: হাতি ক্রমে শান্ত হয়ে এলে তাদের একটি স্তম্ভের সঙ্গে বেঁধে রাখা হতো।
৫) স্কন্ধগত অবস্থা: হাতি শান্ত হয়ে যখন মাহুত বা শিক্ষককে পিঠে চড়তে দিতো।
সামরিক বাহিনীর জন্য ব্যবহৃত হাতিদের যে সব শিক্ষা দেওয়া হতো, তার মধ্যে ছিল—
১) উপস্থান: ওঠা, নত হওয়া, লাফিয়ে বেড়া ডিঙানো ইত্যাদি),
২) সংবর্তন: ঘোরাফেরা করা,
৩) সংযান: সামনে কিংবা পাশে যে কোনো দিকে যাওয়া এবং সাপের মতো এঁকে-বেঁকে যাওয়ার শিক্ষা,
৪) বধাবধ: শত্রুকে বধ বা পায়ে পিষে ফেলা,
৫) হস্তিযুদ্ধ: শত্রুপক্ষের হাতির সঙ্গে যুদ্ধ,
৬) নাগরায়ণ: নগর বা দুর্গ আক্রমণ করা,
৭) সাংগ্রামিক: যুদ্ধ সম্পর্কিত বিভিন্ন গতি-প্রকৃতি শিক্ষা দেওয়া।
হাতিদের নানা ধরনের অলংকার পরানো হতো। এর মধ্যে ছিল—গলায় বৈজয়ন্তী ও ক্ষুরপ্রমাল হার, দেহের জন্য আস্তরণ ও পিঠে হাওদা।
হাতিদের নিয়মিত চিকিৎসার ব্যবস্থা ছিল। নদী মাতৃক দেশের হাতিদের দাঁত তাড়াতাড়ি বাড়তো বলে আড়াই বছর পর পর তাদের তা কাটা হতো এবং পার্বত্য অঞ্চলের হাতিদের দাঁত আস্তে আস্তে বাড়তো বলে পাঁচ বছর পর পর তাদের দাঁত কাটা হতো। দাঁত কাটার নির্দিষ্ট নিয়ম ছিল। দাঁতের মূলদেশের পরিধির দ্বিগুণ দৈর্ঘ্য রেখে দাঁত কাটা হতো।
হাতিদের মঙ্গল কামনায় বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো। বর্ষা কিংবা ঋতু সন্ধিকালে পুরোহিতরা দিনে তিনবার আরতি করতেন। এছাড়া পূর্ণিমা ও অমাবস্যা তিথিতে ভূতেদের উদ্দেশ্যে এবং দেব সেনাপতি কার্তিকের উদ্দেশ্যে চালু ছিল বলিদান প্রথা। এভাবেই মৌর্য সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের শাসনকালে গড়ে উঠেছিল এক শক্তিশালী সমৃদ্ধ ভারতবর্ষ।
তথ্যসূত্র:
১) কৌটিলীয় অর্থশাস্ত্র: রাধাগোবিন্দ বসাক সম্পাদিত, জেনারেল প্রিন্টার্স, ১৯৬৪।
২) প্রাচীন হিন্দু দণ্ডনীতি, প্রথম ভাগ: ডাক্তার নরেন্দ্রনাথ লাহা, নিউ সরস্বতী প্রেস, ১৯২৩।