প্রশ্ন ১— আপনার সঙ্গে পূর্ববঙ্গের সম্পর্কটা ঠিক কীরকম?
উত্তর— ময়মনসিংহের তৎকালীন শহর থেকে আনুঃ ৩০ কিলোমিটার দূরে একটা গ্রাম বেতাগরি। সেখানেই ছিল আমাদের পূর্বপুরুষদের বাস। পিতামহ আইনী পেশায় ছিলেন, কিছু ভূসম্পত্তি ছিল। বাবা আনন্দমোহন কলেজের ইংরাজির স্নাতক, ১৯৪৬ নাগাদ সরকারি চাকরির সূত্রে কলকাতায় আসেন। মাতামহ থাকতেন কিশোরগঞ্জে। কলকাতায় ডাক্তারি পড়তে এসেছিলেন। পড়া শেষ করেননি। কংগ্রেস করতেন। স্বাধীনতা সংগ্রামে জড়িয়ে পড়ে জেলে গিয়েছিলেন। পরে আইনের পেশার সঙ্গে যুক্ত হন। একটা প্রেস ছিল। আমাদের ভাইবোনদের মধ্যে বড় দিদি। তার পর আমরা যমজ ভাই, পরে আরও এক ভাই। সবারই জন্ম কলকাতায়। ঘনিষ্ঠদের অনেকেই পূর্বতন পূর্ববঙ্গের।
প্রশ্ন ২— পূর্ববঙ্গে হিন্দুদের ক্রমহ্রাসমান জনসংখ্যার বিষয়টা মোটামোটি কবে মনে দাগ কেটেছিল?
উত্তর— ওভাবে বলা মুস্কিল। আমার জন্ম ১৯৫৪-তে। শৈশব কেটেছে যাদবপুর উদ্বাস্তু কলোনি অঞ্চলে। যখন বোধবুদ্ধি হল, মোটামুটি তখন অনেকটাই সামাজিক পরিস্থিতি বামেদের নিয়ন্ত্রণে। ওপার থেকে আসা কেউ কেউ ওঁদের দুঃখের কথা বলতেন। কিন্তু সেটাকে অনেকে ভবিতব্য হিসাবে ধরে নিয়েছিলেন। কিশোর মনে বোধটা জাগাতে যে আলোচনা-চর্চা দরকার ছিল, সেই পরিবেশ একেবারেই ছিল না। যেন ওগুলো নিয়ে আলোচনা করতে নেই। নামী লোকেরা সব হারিয়ে এসেও ‘আমরা চলে এলাম’ বলে দাঁড়ি টেনে দিতেন। তাই হিন্দু নির্যাতনের ব্যাপারটা মনে দাগ কাটা সেভাবে হয়েছে অনেকটা দেরিতে।
প্রশ্ন ৩ — এই অবস্থায় তো কেউ বলতেই পারেন, হিন্দুরা সত্যিই নির্যাতিত হয়ে দলে দলে দেশ ছেড়েছেন তা কেউই লিখলেন না! সেটা কি আদতেই সম্ভব?
উত্তর— তেমন কেউই লেখেননি। বরং বাংলাদেশ হবার পর বাংলাদেশ থেকে নিয়মিত হিন্দু নির্যাতন ও বিতাড়ন নিয়ে কিছু মুক্তমনা বাংলাভাষী মুসলমান, আবুল বরকত, মুনতাসির মামুন, তসলিমা নাসরীন, শাহরিয়ার কবিররা লিখেছেন, বলেছেন। তনভীর মোকাম্মেল বাংলাদেশের বামপন্থী চলচ্চিত্র পরিচালক। দেশভাগের ওপর একাধিক ছবি করেছেন। সওয়া দুঘন্টার ছবি ‘সীমান্তরেখা’-তে মুসলিমদের অত্যাচারের অনেক প্রসঙ্গ এনেছেন। কিন্তু হিন্দুদের পাল্টা মারের ছবি বা তথ্য খুঁজেও পাননি। বস্তুত সর্বহারার মত পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছিল ও এখনো আসছে হিন্দুরা। সম্প্রতি দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ার দু-একজন অধ্যাপকের নেতৃত্বে একদল শিক্ষার্থীকে আমি বলেছিলাম, ধর্মীয় কারণে এই বাংলা থেকে ওপারে যেতে বাধ্য হয়েছেন, এরকম এক জন মুসলমানকে হাজির করলে বিনিময়ে আমি ধর্মীয় কারণে ওপার বাংলা থেকে এপারে আসতে বাধ্য হয়েছেন, এ রকম ১০ লক্ষ হিন্দুর নাম-তালিকা দেব।
প্রশ্ন ৪— এই অবস্থার জন্য কাকে দায়ী করেন আপনি?
উত্তর— এক নম্বর মোহনদাস গান্ধী। ১৯১৯ সালে খিলাফৎ আন্দোলন সমর্থন করে ভারতে ইসলামিক মৌলবাদের সম্প্রসারণের বীজ তিনিই পুঁতে দেন। আর ১৯৫০-এ কফিনে শেষ পেরেকটা ঠুকল নেহরু-লিয়াকৎ চুক্তি। এ ছাড়া দায়ী করব কমিউনিস্টদের। এমনকি বিষয়টি নিয়ে নির্যাতিত পরিবারের কমিউনিস্টরাও অসম্ভব রকমের নৈঃশব্দ অবলম্বন করেছিল। এখনও করে। এছাড়াও দায়ী তথাকথিত বুদ্ধিজীবীরা। উদ্বাস্তু জীবন নিয়ে চলচ্চিত্র করে নাম করেছিলেন ঋত্বিক ঘটক। তিনিও হিন্দুদের দলে দলে দেশত্যাগের কারণের গভীরে ঢোকেননি। পাক আমলে হিন্দু নারীদের ওপর সবচেয়ে বেশি অত্যাচার হয়েছে বরিশালে। সেই বরিশাল থেকে এপার বাংলায় এসে অজস্র লিখেছেন শঙ্খ ঘোষ। হিন্দুদের ওপর নির্যাতনের কিচ্ছু লেখেননি। তাঁর ভাই নিত্যপ্রিয় ঘোষ আত্মজীবনী লিখেছেন। একটা লাইনও লেখেননি ঠিক কেন, কীভাবে চলে এলেন। শিল্পী যোগেন চৌধুরী মূল বাড়ি শহিদনগর কলোনীতে। একটা ছবিও আঁকেননি ওই নির্যাতন নিয়ে। লেখেননি শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ও। সমরেশ বসুর মত একটু আধটু যাঁরা ছুঁয়ে গিয়েছেন, তাঁরাও বীভৎস ঘটনাবলী, চরম মানবাধিকার লঙ্ঘণের বিষয়সমূহ কৌশলে এড়িয়ে গিয়েছেন। পরে মনে হয়েছে একেই বুঝি বলে ভণ্ডামি। মতুয়া, রামকৃষ্ণ মিশন, ভারত সেবাশ্রম, সৎসঙ্গ— প্রায় সবার একই রকম মুখে কুলুপ আঁটা।
প্রশ্ন ৫— কেন পূর্বতন পূর্ববঙ্গ এবং পূর্ব পাকিস্তানে হিন্দু জনসংখ্যা এভাবে কমে গেল?
উত্তর— এটা কেবল ওই অঞ্চলে নয়, মুসলিমপ্রধান সর্বত্র এই জিনিস হয়েছে। পৃথিবীর কোনও ইসলামিক রাষ্ট্রে সংখ্যালঘুরা টিঁকতে পারেনি। পাঁচ দশক আগে মধ্যপ্রাচ্যে যথেষ্ঠ ইহুদি, খ্রিষ্টান ছিলেন। এখন তাঁরা প্রায় নিশ্চিহ্ণ হয়ে গেছেন। লেবাননে ৬০ শতাংশ খ্রিস্টান এখন কমে ৩৫ শতাংশ। একইভাবে পূর্ব পাকিস্তান ও পরে বাংলাদেশে ২৮ শতাংশ হিন্দু কমে ৭ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে।
প্রশ্ন ৬— এটা তো ঠিক, মুক্তিযুদ্ধের আগের চেয়ে পরে ওখানে হিন্দু নির্যাতন কমেছে?
উত্তর— প্রথমত, মুক্তিযুদ্ধ বলে যেটা নিয়ে হইচই করা হয়, সেটা ভিত্তিহীন। কিছু বিক্ষিপ্ত ঘটনা হয়েছিল। তবে সোজা কথা, ভারতীয় সেনা গিয়ে পাক কবল থেকে পূর্ব পাকিস্তানকে মুক্ত করেছে। তথাকথিত মুক্তিযুদ্ধে ২৫ লক্ষ হিন্দুকে খুন করা হয়েছিল। সেটা নিয়ে কোনও হইচই হয়? পৃথিবীর ইতিহাসে এত বড় গণহত্যা আর কোথাও হয়নি। আর নির্যাতন কমার প্রসঙ্গে বলি, ছবিটার খুব বেশি বদল হয়নি। হওয়ারও নয়। ১৯৪০-এ লাহোর প্রস্তাবে মুসলিমদের পৃথক অঞ্চলের সিদ্ধান্ত হয়। এর পর সময়ের সঙ্গে সব কিছু এগিয়েছে। বাংলাদেশকে বলা যেতে পারে পাকিস্তানের একটা অন্য আদল। ভাষা আন্দোলনকে মহিমান্বিত করা হয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগে আন্দোলনকারীদের মূল দাবি ছিল পূবের আরও অধিকার ও ক্ষমতা।বাংলাদেশ গঠনের সঙ্গে বাংলা ভাষা বা অপ্রদায়িকতার কোনও যোগ নেই।
ছবি: এখনও অত্যাচারের বিরাম নেই।
প্রশ্ন ৫— এ ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা কীরকম?
উত্তর— আওয়ামি লীগের ভূমিকা বিএনপি-র তুলনায় সামান্য ভাল। তবে, আবুল বরকত জানিয়েছেন, বাংলাদেশের হিন্দু নির্যাতন, সম্পত্তি লুঠের ব্যাপারে দু’দলই যুক্ত ছিল। আর ভারতের কোনও দলের ব্যাপারটা নিয়ে আন্তরিক মাথাব্যথা নেই। বাংলাদেশ সম্পর্কে ভারতীয় জনতা পার্টির অবস্থান খুবই ধোঁয়াটে। খালেদা জিয়া বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর তাঁকে প্রথম অভিনন্দন জানিয়েছিলেন ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী। ২০০১-এ সীমান্তরক্ষী বাহিনীর ১৪ জনকে তুলে নিয়ে খুন করা হল। এর উপযুক্ত প্রতিক্রিয়া বাজপেয়ী সরকার করেনি। গুজরাটে ২৭ বছর ক্ষমতায় আছে বিজেপি। ওই রাজ্যে মোট জনসংখ্যার মাত্র ৮ শতাংশ মুসলমান। কিন্তু তাদের বিন্দুমাত্র নিয়ন্ত্রণে আনা যায়নি। রামনবমীর মিছিল আক্রান্ত হয়েছে সেখানে। পশ্চিমবঙ্গে প্রতিবাদ যেটুকু করার বিশ্ব হিন্দু পরিষদ করেছে। গত কয়েক বছরে একমাত্র যোগী আদিত্যনাথ উত্তরপ্রদেশে ও হিমন্ত বিশ্বশর্মা অসমে কিছু করার চেষ্টা করেছেন।
প্রশ্ন ৬— কিন্তু ভারতে তো প্রায়শই বিজেপি-র বিরুদ্ধে মুসলিমবিরোধী পদক্ষেপের অভিযোগ ওঠে?
উত্তর— বিজেপি ভারতীয় সংস্কৃতির দল ফলে বিরোধীরা এবং ইসলাম পন্থী বামেরা সমালোচনা করে, তাতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। এখন নাম পরিবর্তনের কথা উঠেছে। মুসলমানরা কোথাও গেলেই সেখানের নাম পাল্টে ইসলামী নাম দেয়। মাত্র তিন মাস কলকাতা দখলে এনে সিরাজদ্দৌল্লা কলকাতার নাম পাল্টে করেছিল আলিনগর। সার্বিকভাবে জায়গার নাম বদলের সিদ্ধান্তের সমর্থন আমি করছি না। কিন্তু আহমেদাবাদের আসল নাম তো কর্নাবতী। যদি সেই নামে শহরটাকে চিহ্ণিত করার চেষ্টা হয়, ভুল কোথায়? সেটা হয়নি। ভোপালের আসল নাম ভোজপাল। মোঘল সাম্রাজ্যের সবচেয়ে অত্যাচারী সম্রাট আওরাঙ্গজেবের নামে আওরাঙ্গাবাদ। তার নামে ভারতে কী করে এখনো শহর আছে তাই আশ্চর্যের।
বাংলাদেশে এত ধর্মস্থানে পরিকল্পিত আক্রমণ হল। ক’জনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে? ওই সব আক্রমণের ঠিক পরে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ভারতে আসেন। ২০২২-এর ২২ অক্টোবর যন্তর মন্তরে একটা শান্তিপূর্ণ অবস্থান বিক্ষোভের ডাক দেওয়া হয়। অল ইণ্ডিয়া রিফিউজি ফ্রন্টের যুগ্ম আহ্বায়ক হিসাবে আমি গেলাম। স্থানীয় থানার অনুমতিও ছিল। শেষ মুহূর্তে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক নিষেধাজ্ঞা জারি করে।
প্রশ্ন ৭— বাংলাদেশে হিন্দুদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আপনার অনুমান কী?
উত্তর— বাংলাদেশে হিন্দুদের কোনও ভবিষ্যৎ নেই। হিন্দু জনসংখ্যা আরও কমবে। কোনও প্রতিবাদ-প্রতিরোধ হবে না। পশ্চিমবঙ্গে মুসলিম অনুপ্রবেশকারী বেড়েছে, বাড়ছে। এ ব্যাপারে সব রাজনৈতিক দল উদাসীন। বিজেপি মাঝে মাঝে দু’এক কথা বললেও এ ব্যাপারে কার্যকরী কোনও ভূমিকা নেয় না।
———
ডঃ মোহিত রায়— প্রযুক্তি-পরামর্শদাতা। মানবাধিকার এবং বাংলাদেশের সংখ্যালঘু অধিকার নিয়ে যাঁরা দীর্ঘকাল সক্রিয় ও নিষ্ঠা-সহকারে চর্চা করছেন, তাঁদের অন্যতম। যাদবপুর ও ম্যাঞ্চেস্টারের প্রাক্তনী। বিজেপি-র রাজ্য কমিটির সদস্য ও অন্যতম মুখপাত্র।