(প্রথম পর্ব)
১৯০৩ সালের গ্রীষ্মকাল, মেদিনীপুর পৌঁছেছেন ভগিনী নিবেদিতা। দেশপ্রেমী যুবকেরা উল্লাসে চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘হিপ্ হিপ্ হুররে’। ‘না, না’; বারণ করে উঠলেন নিবেদিতা। ‘এটা ইংরেজ জাতির বিজয়োল্লাস, ভারতীয়দের তা কিছুতেই ব্যবহার করা উচিত নয়, কখনই নয়।’ হাত তুলে তিনি উচ্চৈস্বরে তিনবার বললেন — ‘ওয়া গুরুজীকি ফতে। বোল্ বাবুজীকি খালসা।’ গুরুর জয়, গুরুদেবের জয়, তিনিই আমাকে বাঁচিয়েছেন, তারই কৃপায় রক্ষা পেয়েছি। একদা এই ধ্বনি বীরত্বের লীলাভূমি পাঞ্জাবে বীরেন্দ্র দেশপ্রেমিক শিখেরা দিগ্ মন্ডল কম্পিত করে উচ্চারণ করত মোঘল শিখের রণে।
দক্ষিণেশ্বরে নানকপন্থী সাধুরা আসতেন শ্রীরামকৃষ্ণ সান্নিধ্যে। তাঁরা শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে আধ্যাত্মিক আলোচনায় অংশ নিতেন। ১৮৮৩ সালের ২১ শে ডিসেম্বর, দিন উল্লেখ করে কথামৃতে রয়েছে, “অপরাহ্নে নানকপন্থী সাধু আসিয়াছেন। হরিশ, রাখালও আছেন। সাধু নিরাকারবাদী। ঠাকুর তাঁহাকে সাকারও চিন্তা করিতে বলিতেছেন।” (শ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত, প্রথম খন্ড)। অনেকসময় পঞ্চবটীর তলায় এসে বসে থাকতেন নানকপন্থী সাধুরা।
ঠাকুরের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ ছিল তাদের, যোগাযোগ ছিল চানক বা বর্তমান বারাকপুর পল্টনের সিপাই কুঁয়ার সিং-এর সঙ্গে। তিনি ঠাকুরকে ‘নানক’ জ্ঞানে শ্রদ্ধা করতেন; কারণ ঠাকুরের মধ্যে তো ধর্মের, সকল ধারার, সকল পন্থার বিকাশ! চানকের শিখ ও অন্যান্য সিপাইদের ঠাকুর আধ্যাত্মিক শিক্ষা দিয়েছেন, অভ্যাস যোগ করতে বলেছেন। এইভাবেই হিন্দু-শিখ ধর্মকে কাছাকাছি এনে ফেলছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ।
এবার ঠাকুরের শিষ্য স্বামীজির উপর বর্তালো হিন্দু-শিখ সমন্বয়-নদীতে জোয়ার আনতে। ‘হিন্দুধর্মের সাধারণ ভিত্তি’ বিষয়ে লাহোরে ধ্যান সিং-এর হাবেলীতে শিকাগো বিজয়ের পর ১৮৯৭ সালে বক্তৃতা দিলেন স্বামীজি (দ্রষ্টব্য: বিবেকানন্দ রচনা সমগ্র, অখণ্ড বাংলা সংস্করণ, নবপত্র প্রকাশন, কলকাতা, পৃ. ৭৭০-৭৭৬)। বললেন, “এখানেই অপেক্ষাকৃত আধুনিক কালে দয়াল নানক তাঁর অপূর্ব বিশ্বপ্রেম প্রচার করেন। এখানেই সেই মহাত্মা তাঁর প্রশস্ত হৃদয়ের দ্বার খুলে এবং বাহু প্রসারিত করে সমগ্র জগৎকে — শুধু হিন্দুকে নয়, মুসলমানদেরও পর্যন্ত আলিঙ্গন করতে ছুটে গিয়েছিলেন। এখানেই আমাদের জাতির শেষ এবং মহামহিমান্বিত বীরগণের অন্যতম গুরু গোবিন্দ সিংহ জন্মগ্রহণ করেন।……. আমাদের মধ্যে কি কি বিভিন্নতা আছে তা প্রকাশ করবার জন্যে আমি এখানে আসি নি।
এসেছি আমাদের মিলনভূমি কোথায় তাই অন্বেষণ করতে। কোন্ ভিত্তি অবলম্বন করে আমরা চিরকাল সৌভ্রাতৃসূত্রে আবদ্ধ থাকতে পারি। কোন্ ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত হলে যে বাণী অনন্তকাল ধরে আমাদের আশার কথা শুনিয়ে আসছে, তা প্রবল থেকে প্রবলতর হতে পারে, তা বোঝার চেষ্টা করতে আমি এখানে এসেছি।” দেখা যাচ্ছে বহুধা বিদীর্ণ ধর্মীয় মতবাদের মাঝে যোগসূত্র স্থাপনে অনন্য প্রয়াস-সাধনে হাত দিয়েছেন বীর সন্ন্যাসী। শিখ গুরুর মতই তিনি বীর।
ভারতব্যাপী গুরু নানকের ৫৫০ তম আবির্ভাব বর্ষকে কেন্দ্র করে হিন্দু-শিখ নৈকট্য ও সমন্বয় সাধনের প্রচেষ্টা এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করবে; তার পথিকৃৎ শ্রীরামকৃষ্ণ – স্বামীজি ও নিবেদিতার প্রাসঙ্গিকতা তাই উদ্ধৃত করা গেল।
সকলেই ‘ভাই-ভাই’ এই সাম্যবাদ প্রচার করে গিয়েছিলেন নানক নিরহংকারী। হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতির কথা বলেছেন বারেবারে। অতীতের অন্ধকারকে হরণ করে উজ্জ্বলতার কথা বলেছেন তিনি। এখন নানক, কবীর, শ্রী চৈতন্যের মত মহাত্মাদের আবির্ভাব কেন গুরুত্বপূর্ণ — তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন বিজ্ঞানাচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, “যদি তাঁহারা এই শিক্ষা প্রচার না করিতেন, তাহা হইলে উত্তর ভারতে আরও অনেক লোকে নিশ্চয় মুসলমান ধর্মগ্রহণ করিত।” অর্থাৎ সমকালীন রাজনৈতিক-সামাজিক-ধর্মীয় পরিবেশে এই সমন্বয় না হলে আরও হিন্দু ধর্মান্তরিত হতেন এবং হিন্দুদের উপর নেমে আসতো আরও ভয়ঙ্কর আক্রমণ।
সর্বদা দেখা যায়, মানুষ সুযোগ সুবিধা পেতে তার রাজার ধর্ম গ্রহণ করে থাকেন; কখনও তরবারির সাহায্যেও রাজা তার প্রজাকে আপন ধর্মের অনুসারী হতে বাধ্য করেন। সামাজিক-ধর্মীয় পরিস্থিতিতে যদি উপযুক্ত সংস্কার সাধন না হয়, তবে মানুষ আপন ধর্ম থেকে পাতলা হতেও দ্বিধা করেন না। নানক তাঁর সময়ে হিন্দুত্ব ছেড়ে মুসলমান ধর্ম গ্রহণে স্বয়ং বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন শিখপন্থার নামে। ভারতবর্ষকে এখন বুঝতে হবে শিখপন্থা হিন্দুত্বের বৃহত্তর আধার ব্যতিরেকে কিছুই নয়। খ্রিস্টান আর মুসলমানেরা তাদের ধর্মপ্রচারের সুবিধার্থে বুঝিয়ে গেছে; তাদের দোসর বামৈস্লামিক সেকুলার শক্তি সহজে বুঝিয়ে গেছে — তুমি বৌদ্ধ তুমি আলাদা; তুমি জৈন, তুমি হিন্দু নও, তুমি আলাদা; তুমি শিখ, তাই অবশ্যই হিন্দুদের থেকে আলাদা; তারপর হিন্দুদের মজ্জার মধ্যেও বিভাজন ঢুকিয়ে গেছে — তুমি তপশিলি জাতি, তুমি আলাদা; তুমি তপশিলি উপজাতি, তুমিও ভিন্ন; তুমি ওবিসি, কাজেই আলাদা। নানানভাবে হিন্দুত্বকে দুর্বল করার এক বিশ্বগ্রাসী ক্ষুধা নিয়ে কাজ করে চলেছে ধর্মান্তকরণের কারিগরেরা। আজ তারই বিপ্রতীপে আমাদের বুঝতে হবে কোথায় আমাদের মিল, কোথায় বৌদ্ধ-হিন্দু মিলনসূত্র, কোথায় শিখ-হিন্দু অভিন্ন, কোথায় জৈনতে-হিন্দুতে একাকার।
স্বামীজি বলেছিলেন, “বর্বর জাতির আক্রমণ-তরঙ্গ বারবার আমাদের এই জাতির মস্তিষ্কের ওপর দিয়ে চলে গেছে। শত শত বছর ধরে ‘আল্লা হো আকবর’ রবে ভারতের আকাশ মুখরিত হয়েছে। আর সেই সময় এমন কোনো হিন্দু ছিল না যে প্রতি মুহূর্তে নিজের বিনাশের আশঙ্কা করে নি।” (লাহোরে প্রদত্ত স্বামীজির বক্তৃতা, বিষয়: হিন্দুধর্মের সাধারণ ভিত্তি, তথ্যসূত্র: ঐ, পৃ. ৭৭১)
শিখপন্থার মানুষের কাছে স্বামীজির বার্তা ছিল, “যদি পারি তাহলে আমাদের পরস্পরের মিলনভূমি আবিষ্কার করার চেষ্টা করব। এবং যদি ঈশ্বরের কৃপায় এ সম্ভব হয় তাহলে ঐ তত্ত্ব কাজে পরিণত করতে হবে।”
২০১৭ সালের বিজয়া দশমীর ভাষণে আরএসএস-এর সম্মানীয় সরসঙ্ঘচালক শ্রী মোহন ভাগবত উল্লেখ করেছিলেন, বৌদ্ধ প্রধান দেশের প্রয়াত ১৯ তম কুশক বাকুলা রিনপোছে-র অবদানের কথা। ‘কুশক বাকুলা রিনপোছে’ হচ্ছে তিব্বতি বৌদ্ধ উপাধি বা ভারতের লাদাখের স্পিতুক অঞ্চলের পেথুপ বৌদ্ধবিহারের প্রধানের উপাধি; তিনি অমিতাভ (ভগবান বুদ্ধ)-র অবতার রূপে খ্যাত। প্রথম কুশক বাকুলা রিনপোছে ছিলেন স্বয়ং বুদ্ধ অমিতাভ। ১৯৯০-২০০০ সময়ে ১৯ তম কুশক বাকুলা রিনপোছে ছিলেন মঙ্গোলিয়ায় ভারতের রাষ্ট্রদূত, তিনি পদ্মভূষণ পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিলেন। তাঁর জন্মশতবর্ষ পালনের জন্য তদানীন্তন পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ মঙ্গোলিয়া গিয়েছিলেন, সাংস্কৃতিক সম্পর্ক হয়েছিল মঙ্গোলিয়ার রাষ্ট্রপতির সঙ্গে। শ্রী মোহন ভাগবতের সেদিনের কথাতেও বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি একটি পরিষ্কার বার্তা ছিল।
বার্তাটির মূলসুর হিন্দু ধর্মের সঙ্গে বৌদ্ধ ধর্মের সমন্বয়-ভাবনা। এই সমন্বয়ের কাজটি আরও ১২০ বছর আগেই করতে চেয়েছিলেন স্বয়ং স্বামীজি। ১৮৯৬ সালে ‘প্রবুদ্ধ ভারত’ নামে একটি মাসিকপত্র প্রকাশের নির্দেশে ছিল সেই ভাবনার ব্যবহারিক প্রয়োগ। ‘ভারত’ কথাটির মধ্যেই হিন্দুত্ব কথাটি বিরাজিত; তার পূর্বে ‘বুদ্ধ’ কথাটি যোগ করে তিনি হিন্দু-বৌদ্ধ সমন্বয়ের কাজটি শুরু করে দিতে চাইলেন। তাছাড়া ‘বুদ্ধ’ দশম অবতারের এক অবতার হওয়ায়, সেই সমন্বয়ের কাজ তো চলছিলই। স্বামীজি ভারতবাসীর জন্য বারেবারে বুদ্ধের মত হৃদয় প্রার্থনা করেছেন। বর্তমানে শিখ-হিন্দু সমন্বয়ের কাজটি তাই ত্বরান্বিত করতে গুরু নানকের ৫৫০ তম আবির্ভাব বর্ষ উৎযাপন এক অনন্য রূপ ও সৌকর্য দিতে পারে।
স্বামীজি নিশ্চয়ই বলেছেন, সমগ্র বিশ্বে একটি ধর্ম কখনই থাকতে পারে না। তিনিই বলেছেন, কোনো ধর্মকেই ঘৃণা করা উচিত নয়। সেই তিনিই আবার যখন শিয়ালকোটে ‘ভক্তি’ বিষয়ক বক্তৃতা দিতে গিয়ে বললেন, “যে ধর্ম অন্যায়-কাজের পোষকতা করে সেই ধর্মের প্রতিও কি সম্মান দেখাতে হবে? এর উত্তর ‘না’ ছাড়া আর কি হতে পারে? এই সব ধর্ম যত শীঘ্র দূরীভূত করা যায় ততই মঙ্গল। কারণ ঐ ধর্মের দ্বারা লোকের অকল্যাণই হয়ে থাকে।” (স্বামীজির শিয়ালকোটে প্রদত্ত বক্তৃতা, বিষয় — ভক্তি; সূত্র: বিবেকানন্দ রচনা সমগ্র (অখণ্ড বাংলা সংস্করণ, নবপত্র প্রকাশন, কলকাতা, পৃ. ৭৬৮)
হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন, শিখ — বিশ্বের এই চারটি ধর্মের উৎসভূমি ভারতবর্ষ। আলাদা ধর্ম বলা হলেও তা যে আদতে একই ধর্মের কুসুমোদ্যানে প্রস্ফুটিত পৃথক ফুল – সেই শাশ্বত সত্যটি প্রকাশ করাই বর্তমান ভারতে একান্তভাবে জরুরী হয়ে পড়েছে। গুরু নানকের জন্মের ৫৫০ বর্ষপূর্তি উৎযাপন তারই ভাবনায় অন্বিত। ৫৭০ সালের ২৯ শে আগষ্ট মুসলমান নবী হযরত মহম্মদের জন্মের সূত্রে ইসলামের আবির্ভাব এবং পরবর্তীকালে ভারতবর্ষে মুসলমান শাসক ও লুন্ঠনবাজদের আক্রমণ ও মুসলিম শাসনের প্রেক্ষাপটে ভারতবর্ষীয় চারটি ধর্মের তুলনা চলে না। কিছুতেই তুলনা চলে না খ্রীস্ট ধর্মীয় শাসক ও ধর্মীয় প্রচারকদের সঙ্গেও। তবে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের সরসঙ্ঘচালক শ্রী মোহন ভাগবতজী একাধিকবার বলেছেন, ভারতবর্ষের সকল মুসলমানই আদতে হিন্দু, এ এক যুগান্তকারী বিবৃতি। যিনি ভারতবর্ষের বাসিন্দা, ভারতবর্ষকে আপন মাতৃভূমি কল্পনা করেন, ভারতবর্ষের বিপদ নিজের বিপদ বলে মনে করেন, ভারতের বহমান সংস্কৃতিকে আপন সংস্কৃতির অচ্ছেদ্য বন্ধনে মেলাতে উৎসাহী হন, তিনি আর যাইহোক, তিনি আদতে হিন্দু। হয়তো দেখা যাবে কয়েক পুরুষ আগেও তিনি হিন্দু ছিলেন। বহু পুরুষ আগেও যদি তিনি হিন্দু হন বা না হন, তাতেও তার হিন্দুত্বের কোনো ব্যতয় ঘটবে না, যদি না তিনি ভারত বিরোধী হন।
নানকের ধর্মমত
‘শিখ’ শব্দের অর্থ শিষ্য। শিখপন্থা হচ্ছে শিষ্যের পথ; আর শিষ্য যখন আছেন, গুরু অবশ্যই আছেন। গুরু হলেন পথ প্রদর্শক, তিনি ভবসমুদ্রের কান্ডারি, তিনি ভক্তের Custodian, protector, helper, friend। শিষ্য যেন নদী, গুরু হলেন জ্ঞান সমুদ্রের বিশালতা। নদী যেমন সমুদ্রে মেশে, শিষ্যও গুরুমুখী হন, আর গুরু-শিষ্য মিলনে মনুষ্যজীবন ঈশ্বর সান্নিধ্যের মহত্ত্ব লাভ করে। সৎনাম জপ করে, সৎকর্তার নামে সম্বোধন করে বিজয়সাফল্যের ধ্বজা উড়িয়ে সে স্বর্গলাভ করে। সঙ্গত বা সমবেত কীর্তন আর লঙ্গরখানা বা একত্র আহারের মাধ্যমে সকল বিভেদের অবসান ঘটবে, অপূর্ব সমন্বয় আর সত্যের মিশ্রণ ঘটবে।
শিখপন্থা ভক্তিবাদী আন্দোলনের এমন একটি ধারা, যেখানে ধর্মবিশ্বাসের মূলে একেশ্বরবাদ প্রধান হয়ে উঠেছে; যেখানে ঈশ্বর স্বয়ম্ভূ, নিরাকার, নির্গুণ, স্রষ্টা, সত্য, নির্ভীক, বৈরলেশহীন, অমর, মহান; এমন ঈশ্বরকে যিনি মান্যতা দেন তিনিই শিখ। শিখপন্থার প্রথম গুরু হলেন শ্রী নানক নিরহংকারী। একবার নানককে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, তিনি কোন সম্প্রদায়ের? তিনি কী হিন্দু, না মুসলমান? নানক উত্তর দিয়েছিলেন, আগুন ও কাঠ যে সম্প্রদায়ভুক্ত, তিনি সেই সম্প্রদায়ের; অর্থাৎ তিনি দাহ্য সম্প্রদায়ের। ‘নানক’ কথাটির অর্থ হল আগুন। আগুনের আছে দাহিকাশক্তি, আগুনের রয়েছে দীপ্তি। নানকের মধ্যে এই দুই বৈশিষ্ট্যের সমাহার, দাহিকা আর দীপ্তির যুগপৎ আধার। তাহলে তিনি কী দগ্ধ করতে চেয়েছিলেন, আর কী-বা দীপ্তিমান করতে চেয়েছিলেন? তিনি দগ্ধ করেছিলেন ধর্মীয় সংকীর্ণ দৃষ্টি, ধর্মের নামে আচারসর্বস্বতা, আড়ম্বর প্রিয়তা, ধর্মীয় সংকীর্ণতা, ভ্রষ্টাচার। তিনি দীপ্তিমান করেছিলেন মানবতা, উদারতা, ঈশ্বরপ্রেম আর ভক্তির প্রবাহকে।
এখন গুরু কে? তার উত্তর দিয়েছিলেন স্বামীজি; বলেছেন — গ্রন্থকীট, বৈয়াকরণ বা সাধারণ পণ্ডিতগণ গুরু হওয়ার যোগ্য নন।… ‘যথা খরশ্চন্দনভারবাহী, ভারস্য বেত্তা ন তু চন্দনস্য’। চন্দন ভারবাহী গাধা চন্দনের ভারই জানে, চন্দনের গুণাবলি সম্বন্ধে কিছুই জানে না। এইসব পন্ডিতেরাও সেইরকম। প্রকৃত গুরু পরের হিত করেন, প্রতিদানে কিছুই চান না। নানকের ধর্মমত পর্যালোচনা করতে গিয়ে দেখা যায় গুরুর থাকবে অনন্ত রত্নরাজি — উপাসনা, দান, শুচিতা, সংযম, নম্রতা, দয়া, বিশ্বাস এবং সর্ব-সংস্কারমুক্ত হৃদয়। নানকের ধর্মীয় অবস্থান হিন্দুদের কাছে এক বিসংবাদী সংস্কারকের, মুসলমানদের কাছে ওয়ালী বা দ্রষ্টার, কিন্তু নবী নন। শিখধর্মের শিক্ষা হল একেশ্বর, গুরু এবং নামজপের।
প্রচলিত সংস্কার মুক্ত শিখধর্মে মূর্তিপূজায় প্রশ্রয় নেই, তার নির্যাস হিন্দুধর্মের নির্গুণ ব্রহ্মবাদেও আছে। নানকের বার্তায়-বাণীতে হিন্দু ধর্মের স্বর্গ-নরক বাদ, কর্মফল, ধর্মাচরণে পাপক্ষয় এবং পুনর্জন্মবাদের সমর্থন আছে; আছে মায়াবাদ, আছে গুরুবাদের অনুসরণ। নানক অবতার তত্ত্বের বিরোধী ছিলেন, তাঁর ভক্তিবাদ নির্গুণ ব্রহ্মবাদে পরিপুষ্ট। শ্রী চৈতন্যের ভক্তিবাদ আর নানকের ভক্তিবাদে তাই তফাৎ আছে। নানক মনে করতেন মানুষ জন্ম ও মৃত্যুর অধীন; ঈশ্বর জন্ম-মৃত্যুহীন, তিনি মানুষের রূপ নিতে পারেন না। মুসলমান ধর্মের কঠোরতা, আল্লার মত ঈশ্বরের সর্বময় কর্তৃত্বের কথা রয়েছে এই নানক-পন্থায়। ইসলাম-ইহুদী ধর্মের ঈশ্বরভাবনার সঙ্গে হিন্দুধর্মের নির্গুণ ব্রহ্মবাদের সমন্বয় এই পন্থার বৈশিষ্ট্য।
ড. কল্যাণ চক্রবর্তী
(এরপর পরবর্তী পর্বে)
লেখক বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ এবং প্রাবন্ধিক