বয়স ১০০ ছাড়িয়েছে, এখনও সারিন্দাটা বাজিয়ে চলেছেন ‘পদ্মশ্রী’ মঙ্গলকান্তি রায়

Story image

বিশ্ব সংগীতশাস্ত্রের ইতিহাসে অসামান্য অবদানের জন্য ভারতীয় ধ্রুপদ সংগীত জগৎজুড়ে সমাদৃত হয়েছে। ভারতীয় ধ্রুপদ সংগীতের অসাধারণ সুর, তাল, লয় দিয়ে জয় করে নিয়েছে পৃথিবীর অগুন্তি মানুষের হৃদয়। প্রাচীন ভারতের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি বাদ্যযন্ত্রগুলির মধ্যে পড়ে তবলা, সেতার, সরোদ, তাম্বুরা, বাঁশি, সানাই ইত্যাদি। দেখা যায়, এলাকা ও সংস্কৃতিভেদে বারবার পাল্টে পাল্টে গেছে ভারতে ব্যবহৃত বাদ্যযন্ত্রগুলির আকার, আয়তন এমনকী বাজানোর প্রক্রিয়া। কিছু কিছু বাদ্যযন্ত্র আবার কালের নিয়মে হারিয়ে গেছে। উন্নততর বাদ্যযন্ত্রের অনুসন্ধান, অবশিষ্ট বাদ্যযন্ত্রগুলিকে ঠেলে দিয়েছে হারিয়ে যাওয়ার মুখে।

এমনই এক হারাতে বসা প্রাচীন ভারতীয় বাদ্যযন্ত্র হল সারিন্দা। সমগ্র ভারতবর্ষে যে মানুষটি এখনো অবধি প্রাণপাত করে যন্ত্রটির চর্চা ধরে রেখেছেন, তিনি হলেন মঙ্গলকান্তি রায়, পশ্চিমবঙ্গের সবথেকে প্রবীণ লোকসংগীত শিল্পীদের মধ্যে অন্যতম। তাঁর নিরলস সাধনার জন্য, চলতি বছরে পদ্মশ্রী পুরস্কারের লোকসংগীত বিভাগে তাঁর নাম মনোনীত করা হয়। জলপাইগুড়ি জেলা সংলগ্ন ময়নাগুড়ি ব্লকের অন্তর্গত ধৌলাগুড়ি নামের একটি ছোটো গ্রামে বাস করেন তিনি। সঙ্গে থাকেন স্ত্রী চম্পা রায়। সারিন্দা বাজানোয় মঙ্গলকান্তি রায়-এর জুড়ি মেলা ভার।

উত্তরবঙ্গে প্রচলিত এক ধরনের বেহালাজাতীয় তারের বাদ্যযন্ত্র, আগে মুর্শিদা গানের সঙ্গে বাজাবার একমাত্র যন্ত্র ছিল সারিন্দা। সব ক্ষেত্রে মন ব্যাকরণ মানে না, তাই কোনও কোনও ফকির মুর্শিদা গানের সঙ্গে দোতারাও বাজাতেন। তবে সাধকদের মতে বিলম্বিত লয়ের মুর্শিদা গানের সুর সারিন্দা যেমন বোঝে, তেমনটা আর কোনও বাদ্যযন্ত্র বোঝে না। বলা হয়, এই যন্ত্রের বয়স ৫০০ বছরের চাইতেও বেশি এবং বাংলার বাউলদের হাত ধরেই সারিন্দা প্রাথমিকভাবে জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। এই বাউলেরা এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাত্রাকালীন গেয়ে বেড়াত অসামান্য সুরসমন্বিত বাউল গান। কখনো ধর্মীয় আচার, কখনো বা প্রাত্যহিক দিনে ঘটে চলা নানান ঘটনা হয়ে উঠত এই গানগুলির বিষয়বস্তু। একেকটি সারিন্দায় একাধিক তার থাকে। আর এটি বাজানোর জন্য একটা ধনুকাকৃতি হাতলের সাহায্য নিতে হয়। মেঝেতে উল্লম্ব ভঙ্গিতে বসে বাজাতে হয় এই সারিন্দা।

স্থানীয় অধিবাসীদের কাছে সমাদর পান মঙ্গলকান্তি বাবু। তারা তাঁকে ভালোবেসে ‘মঙ্গল গোঁসাই’ নামে ডাকে। তিন ছেলে ও চার মেয়ে থাকা সত্ত্বেও স্ত্রীর সঙ্গে একাই থাকেন তিনি। আধুনিক যুগে, সারিন্দা দ্রুততার সঙ্গে প্রাসঙ্গিকতা হারিয়ে ফেলছে; এবং এর জায়গা ক্রমে নিয়ে নিচ্ছে সারঙ্গি। সারঙ্গি খানিকটা একই রকম দেখতে, অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র গ্রীবাযুক্ত তারের বাদ্যযন্ত্র, যার চল বাংলাসহ ভারতের বেশ কিছু জায়গায় রয়েছে।

ছোটো থেকেই সারিন্দার সঙ্গে ওতপ্রোত সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল মঙ্গলকান্তি বাবুর। এর আগে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে বঙ্গভূষণ পুরস্কারে ভূষিত করা হয়েছিল তাঁকে। এই ঘটনা তাঁকে খ্যা্তির আলোয় নিয়ে আসে, যার ফলে একের পর এক অনুষ্ঠানে ডাক পড়তে থাকে। নিজের পরিবারকে আর্থিকভাবে সাহায্য করতেও বেশ কিছুটা সক্ষম হন তিনি। তবে তাঁর জীবনের সবথেকে কঠিন সময়টি আসে লকডাউন চলাকালীন। এ সময়ে পেট চালানোর জন্য অন্যের কাছে হাত পাতা ছাড়া আর অন্য কোনো উপায় দেখতে পাননি তিনি। বয়সের কারণে তাঁর গানের গলাটিও আগের চাইতে দুর্বল হয়ে গেছিল। ফলে গান গেয়ে উপার্জন করাও তাঁর পক্ষে আর সম্ভব হয়ে উঠছিল না।

তবে লোকমুখে ছড়িয়ে পড়েছিল মঙ্গলকান্তি রায়ের এই দুর্দশার কথা। জানতে পারা যায়, যে মঙ্গলকান্তি বাবুর বাড়ির একটি অংশ একেবারেই ভেঙে পড়েছে, যা সারানোর মতো আর্থিক স্বচ্ছলতা তাঁর ছিল না। রোদ-জল থেকে বাঁচতে কোনোমতে একটা প্লাস্টিকের চাদর দিয়ে ঢেকে রাখা হয় ভাঙা অংশ। কয়েকটা অনুষ্ঠানে সংগীত পরিবেশনের সুযোগ পেলেও, ১০০০ টাকার বেশি আয় হত না। গ্রামবাসীদের থেকেও তেমন কোনো সাহায্য জোটেনি।

গ্রামবাসীদের মতে, বাংলাদেশি সংগীতশিল্পী ধুমাকান্ত রায়ের কাছ থেকে সারিন্দা বাজানোর পাঠ গ্রহণ করেছিলেন মঙ্গলকান্তি। তাঁর কাছ থেকেই সারিন্দা কিনে বাজাতে শুরু করেন। এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দক্ষ বাদক হয়ে ওঠেন। সারিন্দা বাজিয়ে তিনি গান করতেন উদাত্ত কণ্ঠে। গানের পাশাপাশি নানান রকম পশু ও পাখির ডাক নকল করতে পারতেন মঙ্গলকান্তি। তাঁর এই বিশেষ গুনটি স্থানীয় মানুষদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয়তা পায়। পদ্মশ্রী-তে সম্মানিত হয়ে মঙ্গলকান্তি খুশি হলেও, তিনি জানান, আধিকারিকদের কাছ থেকে তেমনভাবে সহায়তা পাননি তিনি। নিজের শিল্পকে পরিবেশন করবার মতো পর্যাপ্ত সুযোগ দেওয়া হয়নি তাঁকে।

সারিন্দা নামক বাদ্যযন্ত্রটির তারে আঙ্গুল খেলাতে ভালোবাসেন মঙ্গলকান্তি। এই ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য তিনি ঐকান্তিক প্রচেষ্টা চালিয়ে গত আট দশক ধরে সারিন্দা শিল্পকে অক্ষুণ্ণ রেখেছেন। যখনই সুযোগ ঘটেছে, সারিন্দা বিষয়ে মানুষজনকেও অবগত করেছেন। ভারতীয় সংগীতশাস্ত্রে মঙ্গলকান্তি রায়ের অসামান্য অবদানের জন্য সমগ্র বাংলা আজ গর্বিত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.