আজ অর্থাৎ চৈত্র সংক্রান্তির দিনটি থেকে শুরু হচ্ছে বসুধারা ব্রত। গ্রীষ্মের চরম দাবদাহকে মনে রেখেই এই ব্রত। গৃহাঙ্গনে রোপিত গাছগুলিকে সূক্ষ্ম জলের ধারা দিয়ে বাঁচিয়ে রাখার এক হিন্দু ব্রত ও আচার।
‘বসুধারা’ মানে পৃথিবী অথবা পৃথিবীর জল-সম্পদের স্রোত। বিবাহ উপলক্ষে সনাতনী হিন্দুর গৃহে দেওয়ালে আঁকা হয় সিঁদুরবিন্দুসহ ঘিয়ের পাঁচটি অথবা সাতটি স্রোত, তাকেও বসুধারা বলে। বসুধারা কথাটির মধ্যে রয়ে গিয়েছে প্রবাহের অনুভূতি।
ভারতের নারীরা পারিবারিক মঙ্গলের জন্য চৈত্র সংক্রান্তি থেকে টানা একমাস তুলসীমঞ্চতে তুলসীধারার ব্যবস্থা করেন। একটি মাটির হাঁড়িতে তলায় ছোটো একটি ফুটো করে, তাতে পলতের কাপড় প্রবেশ করিয়ে অতি ধীর ধারায় সেচের বন্দোবস্ত করেন তারা, একে বিন্দুপাতি সেচ বলা যেতে পারে, ইংরাজীতে Drip Irrigation। ভারতীয় নারী যে বসুধারা ব্রত পালনের অঙ্গ হিসাবে স্নান সেরে সেই ঝারায় জল ঢালেন এবং তুলসী পূজন করেন তাও তুলসী নামক এক পবিত্র ও ভেষজ উদ্ভিদের প্রতি ধন্যবাদাত্মক চিন্তন।
বসুধারা ব্রতে বাঙালি নারী আবৃত্তি করেন, “তুলসী তুলসী নারায়ণ / তুমি তুলসী বৃন্দাবন /তোমার শিরে ঢালি জল/ অন্তকালে দিও স্থল।” যেন জীবনকালে এ এক মহার্ঘ ভেষজ আর অন্তিমকালেও জীবনের মায়াজাল থেকে মুক্তির মহৌষধি; বাংলার ব্রতেও তারই পুণ্য-পূজন। কবি অক্ষয় কুমার বড়াল ‘এষা’ কাব্যগ্রন্থে লিখছেন, “তোমার নিঃশ্বাসে / সর্বরোগ নাশে/যায় দুঃখ পলাইয়া।” নানান ব্যাধিতে বনবাসী কৌম সমাজ তুলসীর ব্যবহার করে থাকে; কখনো এর ব্যবহার সর্দিকাশিতে, কখনো লিউকোডারমা-র চিকিৎসায়, কখনো দাঁদের ক্ষত দূর করার জন্য কখনো বা ম্যালেরিয়া ঘটিত জ্বরনাশক রূপে।
বসুধারা ব্রতের উদ্দেশ্য বসুধা বা পৃথিবীকে উর্বরা এবং শস্য-সবুজ করে তোলা। ফসলের জন্য জল চাই, জলের জন্য বৃষ্টি চাই, বৃষ্টির জন্য মেঘ। বঙ্গদেশকে মেঘালয় করে গোলার কামনার নামই বসুধারা ব্রত। বৈশাখ মাসের আর একটি ব্রত হল দধিসংক্রান্তি। এটি সৌরজগত বিষয়ক একটি ব্রত। দই খাওয়ার মধ্যে গ্রীষ্মের চরম তাপমাত্রাকে সহ্য করার গুণ রয়েছে। এছাড়া কলাছড়া ব্রত, ঘৃত সংক্রান্তি ব্রত, আদর সিংহাসন ব্রতও বৈশাখ মাসে অনুষ্ঠিত হয়।
এখন ব্রত কাকে বলে?
কোনো কিছু কামনা ও চেষ্টা করে, আশা-আশঙ্কা করে প্রকৃতিকে অনুকরণের মাধ্যমে যে লৌকিক-সামাজিক অনুষ্ঠানের আয়োজন, তাকেই বলে ব্রত। এই ব্রতের কামনার প্রতিচ্ছবিতে আলপনা মূর্ত হয়ে ধরা দেয়, প্রকাশ পায় লোকায়ত পরত। পূজারি-তন্ত্রমন্ত্র বর্জিত লোকায়ত অনুষ্ঠান হল ব্রত। যতক্ষণ না পর্যন্ত কামনার পরিসমাপ্তি হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত ব্রত চলতে থাকে। কামনার শেষে ব্রতের উৎযাপন হয়।
ড. কল্যাণ চক্রবর্তী