তথ্য-প্রযুক্তির উন্নতি ভারতবর্ষের প্রকৃত ইতিহাস সামনে আনতে সহায়ক হয়েছে।

হ্যাঁ, ভারতবর্ষেই এটা সম্ভব। ভারতবর্ষে লোধি রোড, লোধি গার্ডেন আছে ভারতের রাজধানী দিল্লিতে লোধি বংশের সুলতানদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে।প্রত্নতাত্ত্বিক ফ্রেডেরিক সালমন গ্ৰাউসে’র (Frederic Salmon Growse) বই ‘মথুরা বৃন্দাবন’ এ তিনি বলেছেন কিভাবে সিকান্দার লোধি কৃষ্ণ জন্মভূমির মন্দির সহ বিভিন্ন মন্দির ধ্বংস করেছে।
ফ্রেডেরিক এই তথ্য পেলেন কোথা থেকে? মোঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের সমসাময়িক ঐতিহাসিক আব্দুল্লাহর ‘তারিখ-ই-দৌদি’ (Tarikh-i-Daudi) থেকে। ‘infidels’ অর্থাৎ অবিশ্বাসীদের উপাসনাস্থল ধ্বংস করা হয়েছে কারণ তারা সুলতানদের বিশ্বাসে বিশ্বাসী ছিল না। ভারতবর্ষ বিশ্বাস প্রতিষ্ঠার জন্য তর্ক দেখেছিল যুক্তি তর্কের মাধ্যমে আদি শঙ্করাচার্য ও মন্ডন মিশ্রের মধ্যে।আঠারো দিন চলা শাস্ত্রার্থের পরে সস্ত্রীক মন্ডন মিশ্র, শঙ্করাচার্যের মতকে শিরোধার্য করে তাঁর শিষ্যত্ব গ্ৰহণ করেছিল। মতপ্রতিষ্ঠার জন্য ধ্বংসলীলার সঙ্গে ভারতবর্ষ পরিচিত হল , ‘অবিশ্বাসী’ হলে শাস্তি পেতে হয়, ভারতবর্ষ প্রথম জানলো সিন্ধ প্রদেশ বিদেশীদের দখলে যাওয়ার পর।
যাদের উদ্দেশ্য শুধুমাত্র রাজ্য দখল ছিল না , উদ্দেশ্য ছিল এদেশের ধর্ম-সংস্কৃতিকে উপড়ে ফেলা ; যাদের ধ্বংসলীলার চিহ্ন আজও বহন করে চলেছে মথুরা, কাশী,বৃন্দাবন তাদের নামে এদেশের রাজপথ,বাগান,শহর নামাঙ্কিত করার নামই কি ‘সেক্যুলারিজম’ (বিঃ দ্রঃ — সেক্যুলারিজম এর অর্থ ধর্মনিরপেক্ষতা নয়)। ভারতবর্ষের ইতিহাসে সেই মোঘল , লোদি,তুঘলকদের মহান বানিয়েছে কারা ?
কমিউনিস্ট ঐতিহাসিকরা বরাবর মোঘলদের কীর্তিকে মহান করে দেখিয়েছেন।
ইংরেজ আমলে, ইংরেজদের লেখা ভারতবর্ষের ভুল ইতিহাস দেখে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আক্ষেপ করেছিলেন “ভারতবর্ষের যে ইতিহাস আমরা পড়ি এবং মুখস্থ করিয়া পরীক্ষা দিই, তাহা ভারতবর্ষের নিশীথকালের একটা দুঃস্বপ্নকাহিনীমাত্র। কোথা হইতে কাহারা আসিল, কাটাকাটি মারামারি পড়িয়া গেল, বাপে-ছেলেয় ভাইয়ে-ভাইয়ে সিংহাসন লইয়া টানাটানি চলিতে লাগিল, একদল যদি বা যায় কোথা হইতে আর-একদল উঠিয়া পড়ে–পাঠান-মোগল পর্তুগীজ-ফরাসী-ইংরাজ সকলে মিলিয়া এই স্বপ্নকে উত্তরোত্তর জটিল করিয়া তুলিয়াছে।”

তাহলে ইতিহাস লেখার দৃষ্টিকোণ কিরকম হওয়া উচিত ? কবিগুরু লুটেরাদের, বিদেশীদের আড়ালে লুকিয়ে রাখা ভারতবর্ষের শিকড়ের সঙ্গে যুক্ত ইতিহাস চেয়েছেন…

“আমরা ভরতবর্ষের আগাছা-পরগাছা নহি; বহুশত শতাব্দীর মধ্য দিয়া আমাদের শতসহস্র শিকড় ভারতবর্ষের মর্মস্থান অধিকার করিয়া আছে। কিন্তু দুরদৃষ্টক্রমে এমন ইতিহাস আমাদিগকে পড়িতে হয় যে, ঠিক সেই কথাটাই আমাদের ছেলেরা ভুলিয়া যায়। মনে হয়, ভারতবর্ষের মধ্যে আমরা যেন কেহই না, আগন্তুকবর্গই যেন সব”।
যেসব কমিউনিস্ট ঐতিহাসিকরা শেখালেন মোঘলরাই এদেশে স্থাপত্য, শিল্প , চিত্রকলা,ভাষায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে; কবিগুরুর সেই কথাগুলো কি আজও তাদের জন্য প্রাসঙ্গিক নয় ?—-
“এরূপ অবস্থায় বিদেশকে স্বদেশের স্থানে বসাইতে আমাদের মনে দ্বিধামাত্র হয় না–ভারতবর্ষের অগৌরবে আমাদের প্রাণান্তকর লজ্জাবোধ হইতে পারে না। আমরা অনায়াসেই বলিয়া থাকি, পূর্বে আমাদের কিছুই ছিল না, এবং এখন আমাদিগকে অশনবসন আচারব্যবহার সমস্তই বিদেশীর কাছ হইতে ভিক্ষা করিয়া লইতে হইবে”।
যে ঔরঙ্গজেব , সনাতন সংস্কৃতি ধ্বংস করতে চেষ্টার ত্রুটি রাখেনি, কাশী বিশ্বনাথ মন্দির সহ অসংখ্য মন্দির ধ্বংস করেছে, তাকে বলা হলো ‘জিন্দাপীর’ । শিবাজী পুত্র সম্ভাজীকে নৃশংস ভাবে হত্যা করলেও স্বাধীনতার পর ৭৫ বছর কেটে গেলো মহারাষ্ট্রের একটি জেলার নাম ‘ঔরঙ্গাবাদ’ থেকে পরিবর্তন করে ‘সম্ভাজী নগর’ করতে ; যে মুঘলদের হারেমে নারীর সম্মান লুন্ঠিত হতো প্রতিদিন তাদের নামাঙ্কিত ‘মুঘল গার্ডেন’ কে ‘অমৃত উদ্যান’ হতে লাগলো ৭৫ বছর।
ইতিহাসে বিদেশীদের বড় করে দেখলে স্বদেশের সঙ্গে যোগসূত্র দুর্বল হয়ে পড়ে আর তারপর ধীরে ধীরে রাষ্ট্রনীতির প্রত্যেক ক্ষেত্রে বিদেশী তত্ত্বের জায়গা পাকা করতে সুবিধা হয় বলেই কি এইরকম অপচেষ্টা হয়েছে দশকের পর দশক? তারপর এই দেশের শিকড়ে প্রাণের রস সঞ্চার করেছিলেন যে সমস্ত মহাপুরুষ তাদের ভুলিয়ে দিয়ে কার্যালয়ে, বাড়িতে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে , যুবকদের টি শার্টে বিদেশীয়দের ছবি জায়গা পায় স্বদেশী মহাপুরুষদের স্থানে।তখন স্বদেশের সবকিছুকেই বদলে ফেলে বিদেশের ছাঁচে তৈরি করতে চায় যুবক মন—- এই কি ইতিহাস কে ব্যবহার করে ক্ষমতায়নের ব্লু প্রিন্ট ?
‘ভারতবর্ষের পুণ্যমন্ত্রের পুঁথিটিকে একটি অপরূপ আরব্য উপন্যাস দিয়া মুড়িয়া’ যারা নকল ইতিহাস পাঠ্যক্রম রচনা করে যারা ভারতবর্ষের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও ঐতিহাসিকের উপাধি ধারণ করে লুটেরাদের নায়কের আসন দিয়ে দেশরক্ষায় প্রাণ বলিদান দেওয়া রাণা প্রতাপ , রানী দুর্গাবতী কে আড়ালেই রেখে দিলেন , তাদের কৃত্রিম জ্ঞান ‘এমন স্থানে কৃত্রিম আলোক ফেলে, যাহাতে আমাদের দেশের দিকটাই আমাদের চোখে অন্ধকার হইয়া যায়’ । ক্ষতি অনেক হয়েছে, বিশ্বকবির ভাষায় ‘ভারতবর্ষের সেই নিজের দিক হইতে ভারতবর্ষকে না দেখিয়া আমরা শিশুকাল হইতে তাহাকে খর্ব করিতেছি ও নিজে খর্ব হইতেছি’।
স্বাধীনতার ৭৫ বছর পার করে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নতির ফলে আসল তথ্য আমাদের কাছে সহজলভ্য আর ধীরে ধীরে কুয়াশার চাদর সরে আসল ইতিহাস বেরিয়ে আসছে , শুধু প্রয়োজন সেই ইতিহাস কে পাঠক্রম পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়ার , সেই ঐতিহাসিককে আহ্বান জানানো যিনি স্বদেশের সম্পূর্ণ ইতিহাস রচনা করে ভারতবর্ষ কে তাঁর শিকড়ের সন্ধান দিবে যেমনটি কবিগুরু আশা করেছিলেন — “মামুদ ও মহম্মদ ঘোরির বিজয়বার্তার সন তারিখ আমরা মুখস্থ করিয়া পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হইয়াছি, এখন যিনি সমস্ত ভারতবর্ষকে সম্মুখে মূর্তিমান করিয়া তুলিবেন অন্ধকারের মধ্যে দাঁড়াইয়া সেই ঐতিহাসিককে আমরা আহ্বান করিতেছি।”

পিন্টু সান্যাল

তথ্যসূত্র:
১) মানসী সিনহা ( Saffron Swords এর লেখিকা)
২) ভারতবর্ষের ইতিহাস — রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.