প্রতিদিন সূর্য মাথার উপর উঠলেই যেন চিড়বিড় করে পুড়তে শুরু করছে সমস্ত কিছু। এখনও মে-জুন মাস আসতে খানিক দেরি আছে। স্কুল-কলেজের গরমের ছুটির সময়ও হয়ে ওঠেনি। অথচ বৈশাখ মাসের সূচনা হওয়ার আগেই আবহাওয়া দপ্তর বাংলা জুড়ে জারি করেছে দাবদহের হাই-অ্যালার্ট! তাপপ্রবাহের পারদ নাকি ৪০ ডিগ্রি ছাড়িয়ে পৌঁছে যেতে পারে আরও উপরে। কিন্তু ঘরের ভিতর থেকেই বা এই অস্বাভাবিক তাপপ্রবাহের হাত থেকে রেহাই পাওয়া যাচ্ছে কই!
বর্তমানে অনেক বাড়িতেই এক বা একাধিক এয়ার কন্ডিশনার থাকতে দেখা যায়। তবে, এতে সাময়িক ভাবে গরম থেকে মুক্তি পাওয়া গেলেও শেষরক্ষা হয় না। অতিরিক্ত মাত্রায় এসি’র উপর আমাদের নির্ভরশীলতা পরোক্ষে বায়ুদূষণকেই পথ দেখায়। এসি’র সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে টান পড়তে থাকে সামগ্রিক বিদ্যুৎভান্ডারে। ঘরের ভিতরের বাতাসকে হিমশীতল করবার পরিবর্তে ভিতরের বাতাস বাইরে বের করে বিপুল পরিমাণে ক্ষতিকারক কার্বন ডাই-অক্সাইড। তাছাড়া, দীর্ঘ সময় এসি চালানোর ফলে যে বিপুল পরিমাণে ইলেকট্রিক বিল আসে, তা মেটানো সাধারণ মধ্যবিত্তের সাধ্যাতীত বলা চলে। বিশ্ব উষ্ণায়নের বাড়বাড়ন্ত না থাকলেও আগেকার দিনে যে গরম পড়তো না এমন নয়। চৈত্র বা বৈশাখে রীতিমতো লু বইতো। লু অর্থাৎ গরম হাওয়া যখন ঘরের জানলার গা ঘেঁষে বেরিয়ে যেত তখন, ঘরের ভিতর আগে থেকে ভিজিয়ে রাখা পর্দা সেই হাওয়াকেই ঠাণ্ডা শীতল করে তুলতো। এভাবেই গ্রীষ্মের দাবদাহকে ঠেকাতেই অফিস-কাছারি কিংবা বাড়িতে ব্যবহার হত খসখসের পর্দা বা বাঁশের চিক, যার অস্বিত্ব বর্তমানে প্রায় ভুলতেই বসেছি আমরা।
‘ভেটিভার’ (তামিল শব্দ ‘ভেট্টিভার’ থেকে এর উৎপত্তি) নামের একজাতীয় ঘাসকে বিশেষ পদ্ধতিতে বুনে তৈরি হয় খসখসের পর্দা। খসখসের পর্দার গায়ে জল ছিটিয়ে দিলে এক অদ্ভুত সুগন্ধে ভরে ওঠে সমস্ত ঘর। এটি বাইরের তাপকে ঘরের ভিতরে প্রবেশ করতে না দিয়ে, ঘরের তাপমাত্রা একধাক্কায় অনেকখানি নামিয়ে আনতে সাহায্য করে। তাছাড়া, খসখস সম্পূর্ণ রূপে জীবাণুবিয়োজ্য (biodegradable)। ব্যবহারের ফলে ধীরে ধীরে এক সময় নষ্ট হয়ে গেলে, খুব সহজেই এগুলির রিসাইকেল করা সম্ভব। এতে একাধারে পরিবেশ দূষণও রোধ করা সম্ভব। পর্দা ছাড়াও ‘ভেটিভার’ ঘাস থেকে তৈরি হয় আয়ুর্বেদিক ওষুধ, সুগন্ধী তেল বা ঘাসজাত নানান হস্তশিল্প।
অন্যদিকে, ঘরের সৌন্দর্য বাড়াতে এবং ঘর শীতল রাখতে বাঁশের চিকও দারুণ। ঘরে পর্যাপ্ত বাতাস ঢুকবে। প্রাকৃতিকভাবে ঘর তুলনামূলক ঠান্ডা থাকবে। আপনার শরীর ও মন সতেজ থাকবে। কারণ, বাঁশের চিক রোদের তাপ ঢুকতে বাধা দেবে। ঘরের দরজা-জানালায় ভারী কাপড়ের কিংবা গরদ ও এ-জাতীয় কাপড়ের পর্দা থাকলে বাতাস ঢুকতে পারে না। এ ধরনের ফেব্রিক বাতাস চলাচলে ব্যাঘাত ঘটায়।
তবে চাহিদার অভাবেই বর্তমানে দ্রুত গতিতে কমছে খসখসের পর্দা বা বাঁশের চিকের যোগান। যে কয়েকটি দোকান এখনও কোনোমতে নিজেদের অস্তিত্ব বাঁচিয়ে রেখেছে, তার মধ্যে অন্যতম হল গড়িয়াহাটের ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল খসখস’ (গড়িয়াহাট থানার বিপরীতে)। গড়িয়াহাটের রঙচঙে ছোটো বড়ো দোকানের ফাঁকে সামান্য একটু জায়গা দখল করে আজও দাঁড়িয়ে রয়েছে ভগ্নপ্রায় দোকানটি। দোকানের কর্মচারী রাজু খান্না বলেন, “বর্তমানে খসখসের পর্দা প্রায় বিক্রি হয় না বললেই চলে। কেউ কেউ অফিস বা বাড়ি সাজানোর জন্য খসখসের পর্দা কিনে নিয়ে যান ঠিকই। তবে বেশিরভাগ মানুষই এর চাইতে বাড়িতে এসি লাগানোকে সহজ মনে করেন।”
তাছাড়া, খসখসের পর্দা কেবল টাঙালেই হয় না। এটি সংরক্ষণ করতে খানিক যত্নের দরকার হয়। এটি প্রাকৃতিক উপায়ে তৈরি হওয়ার দরুন ক্রমাগত জল লাগলে এতে পোকা জন্মায়; ফলে একটা সময়ের পর সমস্ত পর্দা ধরে ফেলে দেওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। তাহলে উপায়? “খসখসের বদলে বাঁশের চিকের পর্দা কেনা যেতে পারে”, রাজু জানান, “বাঁশের চিকের পর্দা দেখতে অনেকটা এক রকম হলেও, এটির তৈরির পদ্ধতিতে তফাৎ রয়েছে। ঘাসের বদলে বাঁশের আঁশ বুনে এই পর্দা তৈরি করা হয়। একপাশে মোটা কাপড় লাগানো বাঁশের চিকের পর্দা ঘরকে ঠাণ্ডা রাখে। অন্যদিকে আবার, কাপড় না লাগানো বাঁশের চিকের পর্দাগুলির ফাঁক দিয়ে ঘরে হাওয়া বাতাস চলাচল করতে পারে। যার ফলে গ্রীষ্মের দুপুরগুলোয় গুমোট অসহনীয় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় না।”
অতএব, এই সব দিক বিচার করে এই অসহনীয় গরমে বাড়িতে এসি ব্যবহার করতে চাইলে করুন কিন্তু তার সঙ্গে সঙ্গে মনে রাখতে পারেন খসখস বা বাঁশের চিকের মতো প্রাকৃতিক সমাধানের কথাও।