আসানসোলে খান্দরার বক্সি বাড়িতে মা দুর্গা “ক্ষেপীমা”

কাশফুলের দোলা আর শিউলির সুবাসে শরতের আগমনী বার্তা পেতেই আসানসোলের খান্দরা গ্রামে বক্সি বাড়িতে একে বারে সাজো সাজো রব। বাড়িতে যে ক্ষেপীমা আসছেন। হ্যাঁ বক্সি বাড়ির মাদুর্গা ক্ষেপীমা নামেই  আরাধিতা।

প্রায় ৩৫০ বছরের পুরোনো খান্দরার বক্সি বাড়ির ক্ষেপীমায়ের পুজো,  জানালেন বক্সি বাড়ির সদস্য তমলেন্দু বক্সি। তিনি বলেন, বক্সি তাদের বর্ধমান রাজার কাছে পাওয়া পদবী। আগের পদবী ছিল দাস।

বক্সিবাড়ির ক্ষেপী মায়ের পুজোর সঙ্গে যে নাম ইতিহাসের পাতা থেকে উঠে আসে তাহল বক্সি পরিবারের বৈষ্ণব ভক্ত কিশোরী মোহন দাসের নাম। যিনি বক্সি পরিবারের অন্যতম পূর্বপুরুষ। তিনি খান্দরায় সর্বপ্রথম গোপালের মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর বক্সি পরিবারের আর এক পূর্ব পুরুষ স্বর্গীয় গোবর্দ্ধন দাসের নাম জানা যায়। যিনি বর্ধমান মহারাজার দপ্তরের উচ্চপদস্থ কর্মী ছিলেন। তাঁকেই দেবী স্বপ্নাদেশ দেন। বক্সিবাড়ির মহাশক্তি মহামায়া দেবী দুর্গা স্বপ্নাদেশে নিজের এক অদ্ভুত রূপ দেখান, যা সত্যিই বিরল। দেবীর ডান পাশের চারটি ও বাম পাশে চারটি বাহু অত্যন্ত ক্ষুদ্র। আবার ডান পাশের পঞ্চম বাহু এবং বাম পাশের পঞ্চ বাহু স্বাভাবিক আকারের। দেবী দুর্গা এবং তার সন্তান-সন্ততি প্রত্যেকে এক বিশেষ ধরনের পোশাক পড়ে থাকেন যা মাটি দিয়েই তৈরি। কোনও ডাকের সাজ নেই দেবীর শরীরে। যা সাধারণত পারিবারিক পুজোতে দেখা যায় না। পরিবারের সদস্যা মনামি বক্সি জানান, দেবী তাঁর স্বপ্নাদেশে উল্লেখ করেছিলেন “আমার পরিধিত বস্ত্র এবং গয়না যেন মাটির তৈরি হয়।”

এছাড়াও এই একচালার মূর্তিতে গণেশ ও কার্তিক একে অপরের স্থানে অধিষ্ঠিত হয়েছেন। অর্থাৎ গণেশ মা লক্ষ্মীর পরিবর্তে সরস্বতীর পাশে আর কার্তিক লক্ষ্মীর পাশে অধিষ্ঠিত।

খান্দরা অত্যন্ত বর্ধিষ্ণু একটি গ্রাম। এখানে শতকরা ৯০ ভাগ অধিবাসী শিক্ষিত। এই গ্রামের সরকার বড়ির পুজোর সঙ্গে বক্সি বাড়ির পুজোর একটি যোগ সূত্র রয়েছে। জানাযায় আকবরের আমলে শুরু হওয়া সরকার বাড়ির পুজো শুরুর কয়েক বছর পরেই শুরু হয় বক্সি বাড়ির পুজো। ফলে উভয় পুজোর আচার নিয়মে রয়েছে অনেক মিল।

বক্সি বাড়ির ক্ষেপীমায়ের পুজোয় কোনও অন্ন ভোগ হয় না। ফলমূল, মিষ্টান্ন, নাড়ু, কদমা, আরসা, মন্ডা দিয়ে পুজো দেওয়া হয়। তবে পুজোতে পাঠা ও মোষ বলির প্রচলন আজও আছে।

অন্যদিন হয় পাঠাবলি ও নবমীর দিন হয় মোষ বলি।
এক্ষেত্রেও রয়েছে এক অদ্ভুত নিয়ম। যে মোষ নবমীর দিন বলি হবে, সেই মোষের জন্ম কখনোই ভাদ্র মাসে হওয়া চলবে না।

মা দুর্গার পুজোতে বলি হলেও এই বলির প্রসাদ বক্সি বাড়ির কেউ গ্রহন করতে পারেন না। বলির প্রসাদ বিতরণ করে দেওয়া হয় স্থানীয় বাউড়ি বাগদী ভক্তদের মধ্যে।

পুজোর ক’দিন বক্সি পরিবারে সকলে নিরামিষ খাবার খান এবং অত্যন্ত নিষ্ঠা করে পুজোর সব আচার পালন করেন।

দশমীর দিন গ্রামের পুকুর থেকে পাঁচ সের চ্যাং মাছ ধরা হয়। সেই চ্যাং মাছ পুড়িয়ে দেবীকে ভোগ দেওয়া হয়। দেবী বিসর্জনের পর সেই পোড়া চ্যাং মাছের প্রসাদ বক্সি বাড়ির সদস্যরা গ্রহন করতে পারেন।

তবে মোট ১৬ দিন ধরে ক্ষেপী মায়ের আরাধনা হয়। মহাষ্টমী তিথির এক সপ্তাহ আগে ১৬ দিনের জন্য ঘট প্রতিষ্ঠা করা হয়। আর ১৬ দিন ধরে একটি ঘিয়ের প্রদীপ অখণ্ডজ্যোত হিসেবে প্রজ্বলিত হয়।

ক্ষেপীমায়ের পুজো উপলক্ষে বাড়ির সদবারা ষষ্ঠীর দিন মাটির শাঁখা পড়েন। এই নিয়ম যুগ যুগ ধরে চলে আসছে।

কালের পরিবর্তনে পুজো পদ্ধতিতে সামান্য কিছু পরিবর্তন এলেও আজও পুরাতন ঐতিহ্য, নিয়ম বজায় রেখে বক্সি পরিবার ক্ষেপী মায়ের পুজো করে চলেছেন বছরের পর বছর।

পুজো উপলক্ষে গ্রামের বাইরে থাকা পরিবারের সব সদস্যরা ছুটে আসে ক্ষেপী মায়ের টানে। পালা করে পুজোর খরচ সামাল দেন বাড়ির সকলে। ক্ষেপী মায়ের সঙ্গে অনাবিল আনন্দে পুজোর ক’টা দিন কীভাবে যে কেটে যায় তা বুঝতেও পারেন না কেউ। ১২০টি ঢাকের তালে আনন্দে মেতে ওঠে গোটা বক্সি পরিবার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.