সুচিত্রা সেনের শেষ ছবি ‘প্রণয় পাশা’ (১৯৭৮) মুখ থুবড়ে পড়েছিল বক্স অফিসে। তারপর থেকেই সিনেমাজগত থেকে স্বেচ্ছাবসর নেন সুচিত্রা সেন। লাইমলাইটের আলো, অনন্ত সাক্ষাৎকার, নানান অনুষ্ঠান, ছবির প্রিমিয়ার, সবকিছু থেকে অবসর, সব জায়গায় অদৃশ্য তিনি, থেকেও নেই। যেন সচেতন ভাবে নিজের ভাবমূর্তিকে ভেঙেচুরে নতুন রূপ দিলেন। এমন এক রূপ, যার অবস্থান এত বছর ধরে রুপোলি পর্দায় এবং মিডিয়ায় সযত্নে গড়ে তোলা রূপের একেবারে বিপরীত মেরুতে। তাঁর এই ‘নতুন জীবন’ নিয়ে আজ পর্যন্ত যত জল্পনা, যত লেখালিখি হয়েছে, তার অধিকাংশই হয় লোকমুখে, অথবা রামকৃষ্ণ মিশনে তাঁর নিয়মিত যাতায়াতের বিবরণ থেকে সংগৃহীত।
‘প্রণয় পাশা’-য় যখন অভিনয় করছেন, সুচিত্রার বয়স তখন ৪৭, অতএব সমাজের অলিখিত নিয়ম অনুযায়ী ‘হিরোইন’ সাজার মেয়াদ তাঁর ফুরিয়েছে।
সত্যিই কি ‘সোশ্যাল অ্যাংজায়েটি ডিজঅর্ডার’, অর্থাৎ সামাজিক উদ্বেগ ব্যাধির শিকার হয়েছিলেন শ্রীমতী সেন? বিশেষজ্ঞরা বলেন, বিবিধ জেনেটিক ও মনোসামাজিক (Psychosocial) কারণে সৃষ্টি হয় এই ব্যাধি এবং ভিন্ন ভিন্ন রূপে এর প্রভাব পড়ে আমাদের অনেকের মধ্যে। উদাহরণ স্বরূপ, কারোর ক্ষেত্রে কোনও একটি বিশেষ সামাজিক ঘটনার সূত্র ধরে দীর্ঘমেয়াদি উদ্বেগ দেখা দেয় জীবনের সব ক্ষেত্রেই। এমন কী হয়ে থাকতে পারে, যে ‘প্রণয় পাশা’ ছবির চূড়ান্ত বাণিজ্যিক ব্যর্থতা মেনে নিতে পারেননি সাফল্যের শিখরে থাকা সুচিত্রা? এতটাই, যে তা ব্যাধিতে পরিণত হয়? যেহেতু সম্ভাব্য রোগ নির্ধারণ অথবা চিকিৎসা, কোনোটাই তাঁর ক্ষেত্রে হয়নি, তাঁর অদৃশ্য হয়ে যাওয়াকে ব্যাধি হিসেবেও দেখেননি কেউ, সকলেই ধরে নিয়েছেন স্বেচ্ছাবসর।
অবশ্য এমনও হয়ে থাকতে পারে যে তিনি নিভৃতবাসই চেয়েছিলেন, সত্যিই সরে যেতে চেয়েছিলেন সমাজের মূলস্রোত থেকে। এই ধরনের নিভৃতবাসে যাওয়ারও অনেক কারণ থাকতে পারে – ধর্মীয় বিশ্বাস, নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার বাসনা, মানসিক ব্যাধি, বা স্রেফ নির্জনতার আশ্রয় খোঁজা। একাধিক সেলিব্রিটির ক্ষেত্রে কমবেশি এই প্রবণতা দেখা গিয়েছে। এক্ষেত্রে মনে পড়তে বাধ্য পণ্ডিত রবিশঙ্করের প্রথম স্ত্রী অন্নপূর্ণাদেবীকে, যিনি রবিশঙ্করের সঙ্গে বিবাহের অল্প সময় পর থেকেই লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে যান, যে অবস্থান তিনি বজায় রাখেন আমৃত্যু। এমনকি দ্বিতীয় স্বামী রুষিকুমার পান্ড্যর সঙ্গেও কথোপকথন ছিল প্রায় শূন্যের কোঠায়, যদিও বম্বেতে একই ফ্ল্যাটে থাকতেন দুজনে।
আমাদের মনে রয়ে গিয়েছেন অসামান্যা সুন্দরী, অসম্ভব গ্ল্যামারাস, অত্যন্ত সফল এক অভিনেত্রী। পর্দার আড়ালের মেক-আপ বিহীন, সাদামাটা সুচিত্রা সেনকে আমরা চিনি না, চিনিনি কোনোদিন।
‘প্রণয় পাশা’-য় যখন অভিনয় করছেন, সুচিত্রার বয়স তখন ৪৭, অতএব সমাজের অলিখিত নিয়ম অনুযায়ী ‘হিরোইন’ সাজার মেয়াদ তাঁর ফুরিয়েছে। অথচ ছবিতে রয়েছেন মোটামুটি যুবতীর ভূমিকায়। ছবিটি যাঁরা দেখেছেন তাঁরা জানবেন, চড়া মেক-আপ সত্ত্বেও কেমন যেন ক্লান্ত, কখনও কখনও অসুস্থ দেখায় তাঁকে। তাঁর স্বামীর ভূমিকায় মাত্র চার বছরের ছোটো সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের চেয়ে বয়সও যেন মাঝে মাঝে অনেক বেশি মনে হয়।
সদাসর্বদা আড়ম্বর এবং বাহ্যিক চাকচিক্য বজায় রাখা যেখানে পেশার অন্যতম প্রয়োজনের মধ্যে পড়ে, সেখানে আচমকা সেই চাকচিক্যে ভাটা পড়লে মেনে নিতে না পারাটাই স্বাভাবিক। বিশেষ করে পেশার প্রতি নিবেদিত প্রাণ হলে অনেকসময়ই তার ফল হয়ে দাঁড়ায় নিজের প্রকৃত স্বরূপ এবং পারিবারিক পরিস্থিতির থেকে বাড়তে থাকা দূরত্ব। জীবনের যে সময়ে কাউকে কাছে পাওয়া সবচেয়ে দরকার, সেই সময় একাকিত্বের আগ্রাসন।
সত্যিই কি ‘সোশ্যাল অ্যাংজায়েটি ডিজঅর্ডার’ অর্থাৎ সামাজিক উদ্বেগ ব্যাধির শিকার হয়েছিলেন শ্রীমতী সেন? বিশেষজ্ঞরা বলেন, বিবিধ জেনেটিক ও মনোসামাজিক কারণে সৃষ্টি হয় এই ব্যাধি, এবং ভিন্ন ভিন্ন রূপে এর প্রভাব পড়ে আমাদের অনেকের মধ্যে।
এমনই কি হয়েছিল সুচিত্রার জীবনেও? নিজেকে গুটিয়ে নিতে নিতে ক্রমশ একেবারেই গৃহবন্দি হয়ে পড়েছিলেন। সময় কাটত গাছে জল দিয়ে, পুজো করে, ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে কাকেদের খাইয়ে এবং গৃহস্থালির কাজের তদারকিতে। সপ্তাহে অন্তত একবার বেলুড় মঠে যেতেন, কিন্তু ১৯৮৯ সালে তাঁর গুরুদেব ভরত মহারাজ অর্থাৎ স্বামী অভয়ানন্দের প্রয়াণের পর তাও বন্ধ করে দেন।
এছাড়াও তাঁর প্রিয় ছিল হুগলি জেলার আঁটপুর রামকৃষ্ণ মিশন, যেখানে দীক্ষা নেন স্বামী বিবেকানন্দ স্বয়ং। কলকাতা থেকে গাড়িতে করে মাত্র ঘণ্টাখানেকের পথ, সুতরাং মাঝেমাঝেই সেখানে চলে যেতেন একদা মহানায়িকা, প্রকৃতি এবং মঠের সন্ন্যাসীদের সান্নিধ্যে কাটাতেন সারাদিন, শুনতেন স্তোত্রপাঠ, ধর্মকথা। সব শেষে প্রসাদ খেয়ে বাড়ি ফেরা।
আগেই বলেছি, তাঁর মানসিক অবস্থার কোনও পরীক্ষা বা চিকিৎসা হয়নি কখনও, অতএব তিনি যে ‘সোশ্যাল অ্যাংজায়েটি ডিজঅর্ডার’-এর ফলেই নিজেকে সামাজিক জীবন থেকে সরিয়ে নেন, একথা বলা অন্যায় হবে। তবে প্রভূত অর্থ, খ্যাতি, ও সাফল্য ত্যাগ করে নিজেকে একেবারে বিলীন করে ফেলার প্রচেষ্টা, ইতিহাসের পাতা থেকে নিজের সব চিহ্ন মুছে ফেলার বাসনা, তাঁকে কিন্তু প্রকৃত অর্থেই অমর করে রেখেছে। হয়তো সেই কারণেই অনেকে বলেছেন, জেনেশুনেই নিভৃতবাসে চলে গিয়েছিলেন ‘মিসেস সেন’। নিশ্চিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন যে তাঁর অভিনয় জীবন ও গ্ল্যামারাস ভাবমূর্তি নিয়ে যতটা আগ্রহ ছিল তাঁর অগুনতি অনুরাগীদের মনে, ততটাই যেন থাকে তাঁর অভিনয়-পরবর্তী জীবন নিয়েও।