সোদপুরের খাদি প্রতিষ্ঠান ট্রাস্টকে গান্ধি নিজের দ্বিতীয় ঘর বলতেন । স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় সেখানে এসেছিলেন গান্ধি ছাড়াও সুভাষচন্দ্র বসু, জওহরলাল নেহরু প্রমুখ । আজ সেই প্রতিষ্ঠান ভগ্নদশায়।
এখানেই সুভাষ বোস কংগ্রেস ছেড়েছিলেন। ত্রিপুরী কংগ্রেসের পর এখানেই হয়েছিল বিখ্যাত সেই গান্ধী, নেহেরু, নেতাজী বৈঠক।
আবার বাংলাভাগের জন্য গান্ধীর অনুমোদন এখানেই আদায় করেছিলেন শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী
হুসেন সুবাবর্দী, শিশির বোসরা এখানেই ইউনাইটেড বেঙ্গলের প্রস্তাব রাখেন…
ডিসেম্বর ১৩, ১৯২৮। মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধি চিঠি লেখেন হেমপ্রভা দাশগুপ্তকে । হেমপ্রভা ছিলেন একনিষ্ঠ গান্ধিবাদী । বিজ্ঞানী সতীশচন্দ্র দাশগুপ্তর স্ত্রী । চিঠিতে গান্ধি লেখেন, “I shall try to treat Sodepur on the same footings as Sabarmati…The existence of Sodepur is for the shake of khadi , while that of Sabarmati is for experiments in truth , etc. This does not mean that Sabarmati is superior. I merely defined the fields of work of two places . I do desire to make experiments at sodepur , similer to those at sabarmati.”( Vol 43, page 367. Complete works of Mahatma Gandhi).
হ্যাঁ, সেই সোদপুর । যাকে গান্ধি নিজের “দ্বিতীয় ঘর” হিসেবে চিহ্নিত করেছেন । এক সময় পশ্চিমবঙ্গে এলে এখানেই থাকতেন তিনি । এখানেই 1939 সালের সেই ঐতিহাসিক বৈঠক । সেই বছর 31 জানুয়ারি সিতারামাইয়াকে পরাজিত করে সুভাষচন্দ্র বসু দ্বিতীয়বারের জন্য কংগ্রেস সভাপতি হন । ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে মার্চ মাসে ত্রিপুরির অধিবেশনে নানা কারণ দেখিয়ে ওয়ার্কিং কমিটির 12 জন সদস্য পদত্যাগ করেন । পরে তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু । 27 এপ্রিল সকাল 10 টায় সোদপুর খাদি প্রতিষ্ঠানে আসেন মহাত্মা গান্ধি । তখন হাজির ছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু, জওহরলাল নেহেরু । হয় ঐতিহাসিক বৈঠক । 29 এপ্রিল পর্যন্ত বৈঠক হয় । 3 দিনের সেই গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকের পর শেষবারের মতো কংগ্রেস সভাপতি হিসেবে সাংবাদিক সম্মেলন করেন সুভাষচন্দ্র বসু । বলেন, ” সব সমস্যার সমাধান রয়েছে একটি খামে । ” ওই দিন বিকেলে কলকাতার ওয়েলিংটন স্কয়্যারে নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির অধিবেশনে সুভাষচন্দ্র বসু ঐতিহাসিক ঘোষণা করেন । কংগ্রেস ছাড়েন তিনি ।
বিজ্ঞানী সতীশচন্দ্র দাশগুপ্ত ছিলেন বিজ্ঞানী । আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র ঘোষের ছাত্র । আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র প্রতিষ্ঠিত বেঙ্গল কেমিকেলেই চাকরি করতেন তিনি । ভারতের প্রথম অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র তৈরি করেন তিনি । বেঙ্গল কেমিকেলসে এই যন্ত্র উৎপাদন শুরু হয় । তাঁর ফরমুলাতেই তৈরি হয়েছিল সুলেখা কালি । যা একটা সময় খ্যাতি কুড়িয়েছিল ভারত ছাড়িয়ে বিশ্বের দরবারে । তাঁর স্ত্রী হেমপ্রভা দেবী ছিলেন প্রবল গান্ধি অনুরাগী । 1921 সালে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের বাড়িতে তিলক স্বরাজ তহবিল তৈরির কাজে ব্যস্ত ছিলেন গান্ধি । সেখানে হেমপ্রভাদেবী হাতের সোনার বালা খুলে জমা দিয়েছিলেন । প্রাথমিকভাবে সেই কাজটি ভালোভাবে নেননি সতীশ । প্রাথমিক সেই বিরাগ অনুরাগে পরিণত হয় । অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রের লভ্যাংশ থেকে পাওয়া দু’লাখ টাকা দিয়ে তৈরি হয় খাদি প্রতিষ্ঠান ট্রাস্ট । যে ট্রাস্টের সভাপতি হন আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র ঘোষ । সতীশবাবু হন ম্যানেজিং ট্রাস্টি । সেই ট্রাস্টের মাধ্যমে 1925 সালের 25 জুন একটি জনসেবামূলক প্রতিষ্ঠান হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে খাদি প্রতিষ্ঠান । ওই বছরই সোদপুরে কেনা হয় 34 বিঘা জমি । রেল স্টেশনের পাশেই সেই জমি । গান্ধির জীবনীকার ডি জি তেন্ডুলকর লিখেছেন, ” মাত্র নয় মাসের মধ্যে 70 হাজার টাকা ব্যয় করে 30 বিঘা জমির ওপর তৈরি হয় সুদৃশ্য আশ্রম । ” 1927 সালের 2 জানুয়ারি মহাত্মা গান্ধি উদ্বোধন করেন সেই আশ্রমের । তখন ট্রেনেই সোদপুরে আসতেন গান্ধিজি ।
সেই সময় “প্রবাসী” পত্রিকায় আশ্রমের বিস্তারিত বিবরণ এবং ছবি ছাপা হয়েছিল । সেই বিবরণ থেকে জানা যায় , প্রতিষ্ঠানটির মূল প্রবেশপথ সাঁচি স্তূপের তোড়ণের আকারে বানানো হয়েছিল । তারই মধ্যে ব্যারাকের আদলে কয়েকটি বাড়ি ছিল । ছিল একটি রন্ধনশালা ও কর্মীদের আবাসন । সেখানে গান্ধি উদ্বোধন করেছিলেন একটি পাকাঘরের । সেটি U আকৃতির ছিল । এখন শুধু সেইটিই অবশিষ্ট আছে । স্বাধীনতার পর বাকি অংশটুকু বিক্রি করে দেয় ট্রাস্ট ।
ফিরে আসা যাক সেপ্টেম্বর 2019 – এ । সোদপুর গভর্নমেন্ট কোয়ার্টারের মাঝে আগাছা ভরা একখণ্ড জমি । লোহার গ্রিলের চারপাশে ভগ্নস্তূপের মধ্যে U আকৃতির একটা বাড়ি । জানালার কাচ ভেঙে পড়েছে। সেখান থেকে উঁকি মেরে তাকালে দেখা যায়, টালির চালের ভেঙে পড়া সেই বাড়ি । মূল ফটকের সামনে রাখা আছে স্টোন চিপের স্তূপ । সেখান থেকে উঁকি মারলে দেখা যায় গান্ধির বিবর্ণ স্ট্যাচু । খাদি প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে এক কেয়ারটেকার আছেন । বিনা পারিশ্রমিকের সেই কেয়ারটেকার রোজ খোলেন না আশ্রম । সোদপুরবাসীর অনেকে জানেনই না, ওই একখণ্ড ভূমিতেই পা পড়েছিল ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের বরেণ্য ব্যক্তিদের । গান্ধিজি নিজে এই ভূমিকে বলে গেছিলেন তাঁর ” দ্বিতীয় ঘর । “
1927 সালে জানুয়ারিতে গান্ধিজি সোদপুর খাদি আশ্রমের উদ্বোধন করে সেখান থেকেই ট্রেনে যান কুমিল্লায় অভয় আশ্রমে । তারপর দু’বছর সোদপুরে পা রাখেননি তিনি । তবে হেমপ্রভাদেবী এবং সতীশচন্দ্রের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ছিল । 1929 সালের 3 মার্চ তিনি কলকাতায় এসে সোদপুরের খাদি আশ্রমে বসবাস শুরু করেন । এই সময়কালেই নেওয়া হয়েছিল বিদেশি বস্ত্র বয়কটের সিদ্ধান্ত । গান্ধিজির সেই ঘোষণার পরেই বিদেশি বস্ত্র আগুনে নিক্ষেপ শুরু করে জনতা । 5 মার্চ সোদপুরের আশ্রমে হাজির হয় ব্রিটিশ পুলিশ। উদ্দেশ্য ছিল গান্ধিজিকে গ্রেপ্তার । গ্রেপ্তার বরণ করেন গান্ধি । কিন্তু সেই দিনই তাঁর রেঙ্গুনে যাওয়ার কথা ছিল । সেই কারণে ব্যক্তিগত জামিনে তাঁকে মুক্ত করা হয়।
এরপর প্রায় 8 বছরের বিরতি । এইসময় কলকাতাতেই আসেননি গান্ধি । 1937 সালের এপ্রিল মাসে কলকাতায় আসেন গান্ধিজি । 10 এপ্রিল কিছু সময়ের জন্য এসেছিলেন সোদপুর খাদি প্রতিষ্ঠানে । তারপর আসেন 1939 সালের জওহরলাল নেহরু এবং সুভাষচন্দ্র বসুর সঙ্গে সেই গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে । পরে 1945 সালের 1 ডিসেম্বর ফের সোদপুরে আসেন গান্ধিজি । 7 ডিসেম্বর থেকে 10 ডিসেম্বর পর্যন্ত কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় খাদি প্রতিষ্ঠানেই । সোদপুর থেকেই 18 ডিসেম্বর গান্ধিজি যান শান্তিনিকেতনে । ফিরে আসেন 20 ডিসেম্বর । পরে মেদিনীপুর সফর শেষে ফের 3 জানুয়ারি সোদপুরে আসেন গান্ধিজি । 5 এবং 6 জানুয়ারি মহত্মার উপস্থিতিতেই সেখানে অনুষ্ঠিত হয় বঙ্গীয় কংগ্রেস কর্মী সম্মেলন । 19 জানুয়ারি সোদপুর থেকে তৎকালীন মাদ্রাজে রওনা দেন গান্ধি ।
এরপর গান্ধির সোদপুর আগমন অত্যন্ত বেদনাদায়ক । তখন হয়ে গেছে মহম্মদ আলি জিন্নাহর ডাকে ডাইরেক্ট একশন ডে । হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গার আবহে হিংসার আগুনে জ্বলছে গোটা বাংলা । 29 অক্টোবর দিল্লি থেকে সোদপুরে আসেন গান্ধি । 31 অক্টোবর সোদপুরে মহত্মার সঙ্গে দেখা করতে আসেন তৎকালীন বাংলার প্রিমিয়ার তথা মুসলিম লিগ নেতা হোসেন সুরাবর্দি এবং গভর্নর মিস্টার কে সি । দীর্ঘ বৈঠক হয় সেখানে । সরকারি নানা টালবাহানার পর 6 নভেম্বর সোদপুর স্টেশন থেকেই নোয়াখালির উদ্দেশে রওনা হন গান্ধি । দীর্ঘ 5 মাস পূর্ববঙ্গের নানা স্থানে কাটানোর পর সোদপুরে ফিরে আসেন 3 মার্চ । 4 মার্চ সোদপুরের তাঁর সঙ্গে ফের বৈঠক করতে আসলেন সুরাবর্দি । 5 মার্চ তিনি বিহারের উদ্দেশে রওনা হন সোদপুর থেকেই ।
কয়েক মাস পরেই তিনি ফের সোদপুরে আসেন । সেবার তার সফরসঙ্গী ছিলেন নাতনি মনু গান্ধি, ওয়ার্ধা আশ্রমের বিষেনজি, ডঃ অমিয় চক্রবর্তী সহ অনেকেই । 9 মে শরৎচন্দ্র বসু সোদপুরে গান্ধির সঙ্গে দেখা করেন । 10 মে তাঁর সঙ্গে দেখা করেন আবুল কাশেম । 12 মে সুরাবর্দির সঙ্গে দীর্ঘ বৈঠক করেন গান্ধি । তখন বাংলা ভাগের কার্যকলাপ চলছে পুরোদমে । সেদিনের আলোচনায় বিষয় ছিল ইউনাইটেড বেঙ্গলের পরিকল্পনা । নেতাজির মেজদা শরৎচন্দ্র বসু বাংলা ভাগের পরিকল্পনা আটকাতে সুরাবর্দির সঙ্গে মিলে ইউনাইটেড বেঙ্গল তৈরির পরিকল্পনা করেন । এরপর গান্ধিজির সঙ্গে কথা বলতে আসেন শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি । তিনি বাংলা ভাগের জন্য জোরদার সাওয়াল করেন ।
সোদপুরে গান্ধি 1947 সালের 9 অগাস্ট শেষবার এসেছিলেন । সেবার তিনি ছিলেন 13 অগাস্ট পর্যন্ত । তার দু’দিন পরেই স্বাধীন হয় ভারতবর্ষ । শুধুমাত্র জওহরলাল নেহরু, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, শরৎচন্দ্র বসু, সুরাবর্দিরাই নন, ইতিহাস বলছে সোদপুরের এই আশ্রমে পা রেখেছেন সরোজিনী নাইডু, পদ্মজা নাইডু, ড: সুশীলা নায়ার, ক্ষিতীশ চন্দ্র দাসগুপ্ত, সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেল, প্যারেলাল নায়ার, মৌলানা আবুল কালাম আজাদ সহ আরও অনেকে । 1948 সালের 30 জানুয়ারি গান্ধির মৃত্যুর পর শেষ হয়ে যায় সোদপুর খাদি প্রতিষ্ঠানের রাজনৈতিক গুরুত্ব । 1964 সালে প্রতিষ্ঠানের বেশিরভাগ জমি নিয়ে তৈরি হয় সরকারি আবাসন । তারই এক কোণে উজ্জ্বল ইতিহাসের স্মৃতি বুকে রেখে দাঁড়িয়ে রয়েছে সোদপুর খাদি প্রতিষ্ঠান ।
UNESCO -র ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের প্রস্তাবিত তালিকায় রয়েছে সোদপুর খাদি প্রতিষ্ঠান নাম । রাজ্য সরকারের হেরিটেজ হিসেবেও চিহ্নিত এই প্রতিষ্ঠান । কিন্তু তারপরেও এর রক্ষণাবেক্ষণে কোন উদ্যোগে চোখে পড়েনি । বাড়ির কেয়ারটেকার বলেন, “ আসলে আমাদের কোনো ফান্ড নেই । নিজেদের টাকায় যেটুকু পারি রক্ষা করার চেষ্টা করি ।” গান্ধি গবেষক ড: শেখর শেঠ বলেন, ” আমরা রাষ্ট্রপতিকে পর্যন্ত চিঠি লিখেছি । জানিয়েছি কেন্দ্রীয় সরকারকে । রাজ্য সরকারের কাছেও আছে তথ্য । মাঝে 5 লাখ টাকা দেওয়া হয়েছিল । তা দিয়ে যেটুকু পারা যায় সংস্কার হয়েছে । কিন্তু এখন আর কারও উদ্যোগ নেই এই প্রতিষ্ঠানকে বাঁচিয়ে রাখার ব্যাপারে । “
স্থানীয় বিধায়ক নির্মল ঘোষ এবিষয়ে বলেন, ” আমরা চেষ্টা করছি এই প্রতিষ্ঠানকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য । রাজ্য সরকার উদ্যোগী হয়েছে বটে । কিন্তু ফান্ড একটা বড় সমস্যা । ” প্রতিশ্রুতি আছে, ঐতিহাসিক গুরুত্ব আছে, আছে স্বাধীনতা সংগ্রামের গৌরবময় অধ্যায় । তারপরেও একটু একটু করে শেষ হয়ে যাচ্ছে সোদপুরের গান্ধি আশ্রম ।