পূর্ববঙ্গ থেকে আসা বাঙালি হিন্দু উদ্বাস্তু পরিবারগুলির কাছে আশীর্বাদ নিয়ে এসেছিলো নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল ২০১৬। পূর্ববঙ্গে হিন্দু হয়ে থাকার জন্য অসহনীয় অত্যাচার সহ্য করেছেন তাঁরা। এদেশে আসার পর ১৯৪৭ সালের পর থেকে কংগ্রেস সরকার তাঁদের প্রতারিত করেছে।
দণ্ডকারণ্যে বা উড়িষ্যার কান্ধমালে তাঁদের নারকীয় জীবন যাপন করতে বাধ্য করেছিল। মানা ক্যাম্পে শত শত মানুষের মৃতদেহ স্তূপ করে পোড়ানো হয়েছিল। বামফ্রন্ট সরকার হিন্দু উদ্বাস্তুদের উপর মরিচঝাঁপিতে যে ভীষণ নিষ্ঠুর আচরণ করেছিল তা মানব সভ্যতার ইতিহাসে বিরল। ১৯৭৯ সালের সুন্দরবনের মরিচঝাঁপিতে পূর্ববাংলা থেকে টোপসিলি নমঃশূদ্র সম্প্রদায়ের শত শত মানুষকে গুলি করে হত্যা করার অভিযোগ ওঠে জ্যোতি বসুর বামফ্রন্ট সরকারের বিরুদ্ধে। যে সব মহিলা মরিচঝাঁপি থেকে কুমিরমারীতে নৌকা করে পানীয় জল আনতে যেতেন, তাঁদের নৌকা পুলিশের বোট দিয়ে ধাক্কা দিয়ে উল্টে দেওয়া হতো।
ধর্ষিতা মেয়ের মুখ চেপে ধরে কান্না চাপতে হতো। আর রাজনৈতিক নেতাদের পায়ে ধরতে হয়েছে ভোটার কার্ড বা রেশন কার্ডের জন্য। পুলিশের অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে ভারতবর্ষে থাকার জন্য। অথচ তাঁদের পূর্বপুরুষ মহালয়ার তর্পণ করার সময়, পুজোর আচমন করতে গিয়ে শত শত বছর ধরে “গঙ্গে চ যমুনা চৈব গোদাবরী সরস্বতী” বলে এসেছে। অথচ এই ভারতবর্ষে তাদের থাকার আইনগত অধিকার দেয়নি কোনো সরকার। তাঁরা এদেশে অবাঞ্ছিত বহিরাগত ছিলাম। প্রতি মুহূর্তে আতঙ্কের জীবন কাটাতে হয়েছে।
এই প্রথম কোনো কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ববঙ্গের উদ্বাস্তুদের সম্মানজনক নাগরিকত্বের ব্যবস্থা করেছে। কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদির সরকার ১৯৫৫ সালের ভারতীয় নাগরিকত্ব বিলের সংশোধন করেছে। এই সংশোধনী বিলের নাম “নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল ২০১৬ “, এটি ১৯ জুলাই ২০১৬-তে সরকার সংসদে পেশ করে। এই আইন লাগু হলে বাংলাদেশ, পাকিস্তান এবং আফগানিস্তান থেকে আসা শিখ , বৌদ্ধ , জৈন, পার্সি এবং খ্রিস্টান মানুষ যাঁরা ভারতবর্ষে এসেছেন তাঁরা মাত্র ৬ বছর পরেই ভারতের নাগরিকত্ব পাবেন। এই বিলটি আসার পর থেকেই সি পি আই এম তৃণমূল কংগ্রেসের মতো দলগুলি প্রতিবাদ করতে থাকে। তাই ১২ই অগাস্ট ২০১৬ তারিখে এটিকে জয়েন্ট পার্লামেন্টোরি কমিটিতে পাঠানো হয়। এই কমিটি ৭ জানুয়ারী ২০১৯ তারিখে সংসদে তাদের রিপোর্ট পেশ করে ঠিক তার পরে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং সংসদে পেশ করেন। ভারতীয় জনতা পার্টি সংখ্যাগরিষ্ঠতার বলে এই বিল সংসদের নিচের কক্ষে মানে লোকসভায় পাস করিয়ে নেয়।
এরপরে এটি রাজ্যসভাতে যায়। এই বিল রাজ্যসভায় যাওয়ার পরেই বামফ্রন্ট তৃণমূল কংগ্রেসের মতো দলগুলি এক অদ্ভুত চক্রান্ত তৈরী করে। সেই সময় রাজ্যসভায় ভারতীয় জনতা পার্টির সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল না। এই দলগুলি বলতে থাকে যে যতক্ষণ না পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে আসা মুসলমান সম্প্রদায়ের অনুপ্রবেশকারীদের ভারতবর্ষের নাগরিকত্ব সরকার দেবে না, ততদিন পর্যন্ত পূর্ববঙ্গ থেকে বা অধুনা বাংলা দেশে থেকেআসা অত্যাচারিত হিন্দুদের ভারতীয় নাগরিকত্ব দেওয়া এই প্রক্রিয়াও এগোতে দেবেন না। বাংলাদেশ থেকে আসা হিন্দুদের বঞ্চিত করার জন্য তৃণমূল বা সি পি এমের মতো দলগুলি যে ভূমিকা নিয়েছে তা কেবল অনৈতিক নয় একান্ত ওপার বাংলা থেকে হিন্দু বা বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের যাঁরা এখানে আসছেন তাঁরা নিতান্ত অত্যাচারিত হয়ে এখানে আসছেন। তাঁদের নির্দয়ভাবে পরিবারের সদস্যদের মৃত্যু দেখতে হয়েছে। মায়ের সামনে মেয়েকে মেয়ের সামনে মাকে গণধর্ষিতা হতে দেখতে হয়েছে এদের সঙ্গে যারা কেবল অর্থনৈতিক কারণে বা ভারতবিরোধী জেহাদি গতিবিধি বাড়াতে পশ্চিমবঙ্গে আসছে তাদের নাগরিকত্বের অধিকার সমানভাবে দেখা হচ্ছে।
২০০১ সালের ৮ অক্টোবর তারিখে বাংলাদেশের সিরাজগঞ্জ জেলার উল্লাপাড়া উপজেলায় ১৩ বছর বয়সের পূর্ণিমা শীলকে ১১ জন মিলে গণধর্ষণ করেছিল। পূর্ণিমার অসহায় মা ওই ধর্ষণকারীদের পায়ে ধরে অনুরোধ করেছিল “বাবা তোমরা এক এক করে এস। আমার মেয়েটার বয়সটা বড় কম।” এই পূর্ণিমার মতো যে শত শত হতভাগিনীর পরিবারের ভারতবর্ষে নাগরিকত্ব পাওয়ার অধিকার আর শাকিল আহমেদের অধিকার এক হবে? মানবিকতা কি বলে?
এবছরও সেপ্টেম্বর মাসের ৯ তারিখে ময়মনসিংহ জেলার ধুবাউড়ায় ১১ বছরের সপ্তম শ্রেণীর এক ছাত্রীকে আব্দুস সাত্তার (৩০) নামে একজন ধর্ষণ করেছে বলে ১৯ সেপ্টেম্বর ধুবাউড়া থানায় অভিযোগ জমা পড়েছে। মেয়েটির বাবা পুলিশের কাছে যেতেই ভয়ে কাঁপছিলেন। গত ১৮ আগস্ট ২০১৯ তারিখে মৌলভী বাজার জেলার জুড়ি থানায় মাধবী রানী বিশ্বাসকে গণধর্ষণ করে হত্যা করা হয়েছে বলে অভিযোগ। গত ৩০ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামের হাতাঝাড়ি থানার সামন্ত দাস ও আরও তিন জনকে হত্যার চেষ্টা করা হয়। সামন্ত দাসের পায়ের মাংস মৌলবীরা খুবলে নিয়েছে বলে অভিযোগ। গত ১২ সেপ্টেম্বর পাঁচগড় জেলার গ্রিপাড়া কালীমন্দির ভেঙে গুড়িয়ে দেওয়ার হয়েছে বলে অভিযোগ। কেউ ধরা পড়েনি, কারোর শাস্তি হয়নি। এমন ভীষণ পরিস্থিতির মধ্যে যাঁরা আছেন তাঁরা কেবল বাঁচার জন্য আর বাড়ির মেয়েদের ইজ্জত বাঁচাতে এই বাংলায় আসছেন। তৃণমূল কংগ্রেস আর সি পি আই এমের মতো দলগুলির বিরোধিতায় এই নির্যাতিত হিন্দুরা ভারতের নাগরিকত্ব পেলেন না আর এই নিদারুণ অত্যাচারের শিকার যে মানুষ তাদের নাগরিকত্ব এই ভোটার ব্যাবসায়ীরা ততদিন হতে দেবেন না যতদিন না শাকিল আহমেদের মতো ভারত বিরোধীরা নাগরিকত্ব পাবেন না।
বার বার শাকিল হামিদের নাম কেন আসছে?
কে এই শাকিল আহমেদ ? ২০১৪ সালের খাগড়াগড়ের বিস্ফোরণের কথা নিশ্চই মনে আছে? ১ অক্টোবর ২০১৪ তারিখে ইম্প্রোভাইসড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস বিস্ফোরণ হলো সেই বিস্ফোরণে এই স্লিপের সেলের মূল পাণ্ডা শাকিল আহমেদের মৃত্যু হয়। বাড়ির মালিক হাসান চৌধুরী তৃণমূল কংগ্রেসের নেতা। শাকিলরা বাড়ির উপরের তলায় বিস্ফোরকের কারখানা বানিয়েছিলো। আর নিচের তলায় তৃণমূলের একটি অস্থায়ী অফিসও ছিল। আলকায়দার নির্দেশে এই মৃত দুই মুজাহিদিন দুর্গাপূজার সময় কলকাতার ১০ টি সিরিয়াল বিস্ফোরণ করতে চেয়েছিলো বলে মনে করেছিলো তদন্তকারী এনআইএ (দ্য টাইমস অফইন্ডিয়া, অক্টোবর ২০১৪)। এই শাকিল ছিল এক বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী। ১৯৯৯ সালের শাকিল পশ্চিমবঙ্গে করিমপুরে আসে। তখন বামশাসন মধ্যগগনে। নেতাদের ধরাধরি করে শাকিল ভোটার কার্ড বানিয়ে ফেলে।
ভোটার কার্ড বানিয়েই সে জেহাদের কাজে লেগে যায়। শিমুলিয়া মাদ্রাসার মতো জেহাদের আঁতুড় ঘর গড়ে তোলে। সেখান থেকে কওসরের মতো গরিব ভারতীয় মেয়েদের সংগ্রহ করে দেশবিরোধী কাজে লাগানো শুরু করে। আজ ওই দুই জঙ্গির মৃত্যুর পরে কওসর আর ওর সঙ্গী ভারতীয় দুই মহিলা দুটো কোলের বাচ্চা নিয়ে নরকের জীবন যাপন করছে। তাই শাকিলের মতো বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীরা কেবল পশ্চিমবঙ্গে হিন্দুদের জন্য বিপজ্জনক নয়। এদেশের নাগরিক মুসলমান সম্প্রদায়ের জন্যও সমানভাবে ক্ষতিকর।
এই তর্ক আসতেই পারে যে বাংলাদেশ থেকে আসা সব মুসলমান অনুপ্রবেশকারীই জেহাদি বা শাকিল আহমেদের মতো স্লিপার সেলের সদস্য নয়। কিন্তু তা হলেও বাংলাদেশ থেকে সা কোনো হিন্দু বৌদ্ধ বা খ্রিস্টানরাই শুধু উদ্বাস্তু কারণ আন্তর্জাতিক আইনে অর্থনৈতিক কারণে কেউ একদেশ থেকে অন্য দেশে এলে তাদের অনুপ্রবেশকারী বলা হয়। উদ্বাস্তু বা শরণার্থী বলা হবে না।
রাষ্ট্রসঙের যে সংস্থা এই উদ্বাস্তু সংক্রান্ত বিষয়ের নিয়ামক তার নাম ইউনাইটেড নেশনস হাইকমিশন ফর রিফিউজিস (ইউ এন এইচ সি আর) এই সংস্থার সংজ্ঞা অনুসারে এক দেশ থেকে অন্যদেশে অত্যাচারিত হয়ে এলেই কেবল উদ্বাস্তু হবে, অর্থনৈতিক কারণে এলে হবে না। তাই আন্তর্জাতিক আইন মানলে সিটিজেনশিপ আমেন্ডমেন্ট বিল ২০১৬ একশো শতাংশ ঠিক। এই বিলে কোনো সাম্প্রদায়িকতা নেই। এর বিরোধিতা করে তৃণমূল বা সি পি এমের মতো দলগুলি বাংলাদেশ থেকে বাধ্য হয়ে ভারতে আশ্রয় নেওয়া হিন্দুর সঙ্গে প্রতরণা করেছে। শাকিল আহমেদের মতো ভয়ানক ক্ষতিকারকদের জন্য তো বটেই এছাড়া বহু কারণে ন্যাশনাল রেজিস্টার যোগ সিটিজেনস একান্ত জরুরি। স্বাধীনতার পরে পরিকল্পিতভাবে আসামের হাইলাকান্দি, করিমগঞ্জ বা বদরপুরে হিন্দুরা সংখ্যালঘু হয়ে গেছে। এই জেলাগুলি আজ অপরাধের স্বর্গরাজ্য। পশ্চিমবঙ্গেও সীমান্তবর্তী জেলাগুলো ধীরে ধীরে হিন্দুশূন্য হয়ে যাচ্ছে। বসিরহাট সন্দেশখালিতে ক্রমবর্ধমান অপরাধ চক্রের অন্যতম কারণ এই অনুপ্রবেশ। জাতীয় পঞ্জীকরণ না হলে পশ্চিমবঙ্গ পশ্চিম বাংলাদেশ হয়ে যাবে।
যে কোনো স্বাধীন সর্বভৌময় দেশের নিজের নাগরিকদের হিসাব থাকে। আর যেখানে সমানে বিরোধীদের আনাগোনা সেখানে তো অবশ্যই থাকা উচিত। উত্তরে রংপুর থেকে দক্ষিণ মঙ্গলা পর্যন্ত বাংলাদেশের পুলিশ অপরাধের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নিলেই এপারে অবাধে চলে আসে। সেই সঙ্গে এই অপরাধীরাই গোপাচার চোরাচালানের মুলচক্রী। এই সর্বনাশা গতিবিধি বন্ধকরার জন্য যেমন সীমান্ত সুরক্ষা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন , প্রয়োজন পশ্চিমবঙ্গের প্রশাসনিক সংস্কার। একই ভাবে ভীষণ জরুরি জাতীয় পঞ্জীকরণ বা এন আর সি।
প্রশ্ন হলো পশ্চিমবঙ্গে এন আর সির ফলে পূর্ববঙ্গ থেকে আসা হিন্দুদের এত ভোগান্তি হচ্ছে কেন। এর মূল কারণ হলো অধিক সন্ন্যাসীতে গাজন নষ্ট হওয়া।
আসামের এন আর সি এর “কাট অফ ডেট” হিসাবে ১৯৭১ সালের ২৪ সে মার্চ ধরা হয়েছে। বিজেপি সহ অনেক জাতীয়তাবাদী দল এই বেস ইয়ার ১৯৫০ ধরার কথা বলেছিলেন। কারণ ১৯৭১ সালের পরে মূলত তপশিলি জাতিভুক্ত হিন্দু উদ্বাস্তুরাই বাধ্য হয়ে এসেছেন। রাজ্যে এনআরসির কাজ ২০১৩ সালে কংগ্রেস সরকারের নির্দেশে শুরু হয় সেখানে অত্যাচারিত উদ্বাস্তু আর অর্থনৈতিক কারণে আসা অনুপ্রবেশকারীকে একভাবে বিদেশি বাঙালি হিসাবে দেখা হয়েছে। যখন মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট এই বিষয়ে এক আদেশ দেন তখন তড়িঘড়ি বাস্তবায়ন শুরু হয়। মহামান্য প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈ এবং রোহিঙটাঙ ফালি নরিম্যানের বেঞ্চ এর তত্ত্বাবধান করেন। এই পুরো বিষয়টি প্রতীক হাজেলা নামে এক সরকারি আধিকারিক দেখভাল করেন। তাই আসামে সংঘটিত এন আর সি তে কেন্দ্রীয় সরকারের দৃঢ়তা ছিল ঠিকই কিন্তু সরকারি লালফিতের সবরকম দোষ এরমধ্যে থেকে গেছে।
এ বিষয়ে সবচেয়ে বাঙালিবিরোধী আইনগুলো হয়েছে অবিজেপি শাসিত সরকারের আমলে। লৌহ পুরুষ সর্দার প্যাটেল ১৯৫০ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসাবে বলেছিলেন পূর্ববঙ্গ ও পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আসা হিন্দুরা আমাদের রক্তমাংসের সমান। কিন্তু সেই বছরই ৪ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী নেহেরুজী সই করলেন নেহেরু-লিয়াকত চুক্তি। সেই চুক্তিতে ঠিক হলো ভারত ও পাকিস্তানের উভয় দিকের সংখ্যালঘুদের সুরক্ষার বাব্যস্থা করবে সেখানকার সরকার। ভারত এই চুক্তি অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিল। কিন্তু পাকিস্তান এসবের তোয়াক্কা করেনি। তাই পূর্ববঙ্গে দাঙ্গায় হারানো সম্পত্তি , বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া মেয়েদের বা লুঠে নেওয়া অস্থাবর সম্পত্তি কিছুই হিন্দুরা ফেরত পায়নি। বরং একের পর এক জেলায় অত্যাচার বাড়তে থাকে। এই যে অত্যাচার বাড়ছে, পাকিস্তান যে নেহেরু লিয়াকত চুক্তির তোয়াক্কা করছে না, সেই বিষয়ে ভারতের নেহেরু সরকার কোনো প্রতিবাদ সতর্কতা বা আন্তর্জাতিক মহলে তুলে নিয়ে যায়নি। ফলে হিন্দুরা অত্যাচারিত হয়েছে , বাধ্য হয়ে এদেশে এসেছে কিন্তু উদ্বাস্তু হিসাবে বৈধতা পায়নি। এদেশে বেআইনি প্রবেশকারী হয়ে থেকে গেছেন।
নেহেরুজীর সরকার ১৯৫৫ সালে সিটিজেনশিপ এক্ট ১৯৫৫ চালু করলেন। সেখানে সিটিজেন বাই ডিসেন্ট এর সঙ্গে নিরুপিত হলো। ঠিক হয়ে গেল যে ১৯৫০ সালের পর আসা কেউ এদেশের নাগরিক হবেন না। ওপার বাংলায় বাবাকে নিজের কবর খুঁড়তে দেখতে হলেও ,মেয়েকে গণধর্ষিতা হওয়ার সাক্ষী থাকলেও বাড়ির ভদ্রাসনের খাওয়ার থালা বাতি পর্যন্ত লুঠ হয়ে গেলেও ভারতে এলে সেই হতভাগ্য হিন্দু বৈধ নাগরিকত্ব পাবে না।
১৯৮৩ সালের ইন্দিরা গান্ধীর সরকার ইল্লিগাল মাইগ্রান্ট (ডিটার্মিনেশন বাই ট্রাইবুনাল ) এক্ট ১৯৮৩ লাগু করেন। বিশেষ করে আসামে এই আইন হিন্দু উদ্বাস্তুদের জন্য অভিশাপ হয়ে দাঁড়ায়। হিন্দুদের সদাসর্বদা ভয়ে ভয়ে থাকতে হতো এই বুঝি ট্রাইবুনালে ডাক পড়ে। আজকের আসামে ভারতীয় জনতা পার্টির মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সোনোয়ালের করা মামলা তে মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট ২০০৫ সালে এই ২১এ আইন বন্ধ করে দেন।
তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকার মামলাটিকে ২০১২ সাল পর্যন্ত চালালেও আই এম ডি টি আর বেঁচে ফেরেনি। ১৯৬০ সালের জুন মাস আসামের মুখ্যমন্ত্রী তখন কংগ্রেস দলের বিমলা প্রসাদ চালিহা। গৌহাটির কটন কলেজে শুরু হলো “বাঙালি খেদাও” দাঙ্গা। গৌহাটির জেলাশাসক বাংলাভাষী তাই শতাধিক লোক তাঁর বাড়িতে ঢুকে ছুরি মারে। সেইসময় ডেপুটি ইন্সপেক্টর অফ পুলিশ ও বাংলাভাষী ছিলেন তিনিও ছুরিকাহত হলেন। গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয় আর মেডিকেল কলেজ থেকে বাঙালি ছাত্রছাত্রীদের বের করে দেওয়া হল। কমপক্ষে ৫০হাজার বাংলাভাষী হিন্দু ঘরছাড়া হয়ে পশ্চিমবঙ্গে পালিয়ে এলেন। ১০ অক্টোবর ১৯৬০ আসামের কংগ্রেস বিধানসভায় বিল এনে অসমীয়া ভাষাকে একমাত্র সরকারি ভাষা হিসাবে ঘোষণা করলেন।
উত্তর করিমগঞ্জের বিধায়ক রণেন্দ্র মোহন দাস প্রতিবাদ করলেন। ১৯৬১ সালের ১৯ মে বাঙালিদের প্রতিবাদ মিছিলে গুলি চললো। ১২ জনের গুলিবিদ্ধ দেহ হাসপাতালে আনা হল। তারমধ্যে ৯ জন সেদিনই মারা গেলেন। এরপর থেকেই প্রাদেশিকতার ভিত্তিতেই অল আসাম স্টুডেন্টস ইউনিয়নের মতো দলগুলি রাজনৈতিক জমি খুঁজতে থাকে। ক্রমাগত দাঙ্গা করে “বাঙালি খেদাও” চলতে থাকে। ১৯৮৪ সাল ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের রাজীব গান্ধী তখন প্রধান মন্ত্রী, আসামের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন কংগ্রেসের হিতেশ্বর সইকিয়া। স্বাক্ষরিত হলো আসাম আকৰ্ড এই মেমোরেন্ডাম অফ সেটেলমেন্ট (এম ও এস ) প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীর উপস্থিতিতে স্বাক্ষরিত হয়। আসামের আন্দোলনকারীদের মধ্যে সাক্ষর করেন , প্রফুল্লকুমার মহান্ত, ভুগু কুমার ফুকন আর অল আসাম গণ সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক বিরাজ শর্মা। ভারত সরকারের পক্ষে স্বাক্ষর করেন গৃহমন্ত্রালয়ের সচিব আর ভি প্রধান এবং মুখ্য সচিব পি পি ত্রিবেদী। আজ যে কয়েক লক্ষ উদ্বাস্তুর নাম এন আর সি তে বাদ পড়েছে তার সূচনা সেদিনই হয়ে ছিল। ঠিক হয় আসাম থেকে অবৈধ বিদেশিদের সনাক্ত করে বের করে দেওয়া হবে। পশ্চিমবঙ্গ সহ সমস্ত দেশেই রাষ্ট্রীয় নাগরিক পঞ্জীকরণ হওয়া উচিত। যে কোনো সভ্য দেশেই নিজের নাগরিকদের হিসেবে রাখা একান্ত জরুরি। কিন্তু সেই সঙ্গে প্রয়োজন শক্তিশালী বিদেশনীতি। বাংলাদেশের প্রতিটি উপজেলায় স্নায়ুতন্ত্রের মতো অনুভব ব্যবস্থা থাকা জরুরি। ওপারে একজন সংখ্যালঘু যেন নির্যাতিত হয়ে এপারে আসতে বাধ্য না হন। যাঁরা নিপীড়িত হয়ে এদিকে এসেছে তাঁরা ভারত ছাড়া আর কোথায় যাবেন। তিনি ৬ বছর আগেই আসুন আর ৬ মাস আগেই আসুন।
গঙ্গা গোদাবরী ভারতবর্ষে তাঁর জন্মগত অধিকার। তাই এ রাজ্যে সব রাজনৈতিক দলের উচিত নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল ২০১৬ কে রাজ্যসভাতে পাশ করানো। পূর্ণিমা সিলের কষ্ট না বুঝে তাকে শাকিল আহমেদের সঙ্গে এক সারিতে দাঁড় করাবেন না নিতান্ত ভোটের লোভে। পশ্চিমবঙ্গে এনআরসির নামে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত ভাবে অহেতুক ভীতি ছড়ানো হচ্ছে। সেইসঙ্গে পরিকল্পিত ভাবে শুরু হয়ে গেছে সীমান্তবর্তী এলাকায় রাজনৈতিক মদতে কাগজ তৈরির কারসাজি। এরাজ্যের সচেতন নাগরিক হিসাবে ওই অসাধু রাজনীতি ব্যবসায়ী কিংবা কায়েমী স্বার্থে ডেস্কে বিপদে ফেলা কতিপয় ভূমিসংস্কার দপ্তরের কর্মীর কাজে সক্রিয় ও জোরালো প্রতিবাদ করতে হবে। অন্যায় বন্ধ করতে হবে। আজ ২০১৯ সাল এক গুরুত্বপূর্ণ সময়। সমগ্র বাংলার সাম্প্রতিক ইতিহাসের এই গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে বাংলার মানুষকে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। না হলে বঙ্কিমচন্দ্র বিবেকানন্দ রবীন্দ্রনাথ শ্রীঅরবিন্দের নাম নেওয়ার জন্য; জগদীশ চন্দ্র, প্রফুল্লচন্দ্রের প্রজ্ঞাকে বহন করার মতো; নেতাজি সুভাষ, শ্যামাপ্রসাদের চাপরাশ বহন করার মতো একজন বাঙালিও এই উপমহাদেশে অবশিষ্ট থাকবেন না।