“ভৌতিক ভীতির মূল শুধু প্রত্যক্ষের অগোচর বাস্তবকায়াহীন সত্তার অস্তিত্ব কল্পনার হয়নি। প্রাণের নিঃসঙ্গ একাকিত্বের মৌলিক অসহায় ভীতির মধ্যেই এর বীজ রয়েছে। …নিঃসহায় একাকিত্বের অহেতুক ভীতি এই-ই ভূতের ভয় প্রভৃতি অনির্দেশ্য আতঙ্কের বীজ।” (গল্পের ভূত/সুকুমার সেন)

শীতকাতুরে বাঙালি। আবার, বর্ষাসচেতন বাঙালি—ছাতা ভুলে ফেলে আসা তাদের দস্তুর। এবং বাঙালি আড্ডাবাজ। এই ত্র্যহস্পর্শ ঘটলে তো তারিয়ে তারিয়ে ভয় উপভোগের ক্ষেত্রে তাদের জুড়ি মেলা ভার। ভূত আছে কি নেই এ সব অর্থহীন প্রশ্ন, ভয় যে আছে তা অনস্বীকার্য। ফলে কোনো এক বর্ষার সন্ধেয় তেলেভাজা যোগে বা শীতের রাতে তাস পেটাতে পেটাতে ভূতের গল্পের প্যান্ডোরা বাক্স তারা খুলে বসে। এ সব গল্প শুরুই হয় নির্জনতা দিয়ে। অঝোর বৃষ্টির রাতে কোথাও ফেঁসে গেছেন কথক, জনমানবহীন প্রান্তিক রেল স্টেশন; বা রাস্তার মাঝে হানাবাড়ি—আগাছায় ছেয়ে যাওয়া দোতলা জানালা-দরজাহীন আদ্যিকালের কোঠাবাড়ির অতৃপ্ত প্রেত—ছায়া জমে জমে অশরীরী নিজেকে জানান দিচ্ছে—এই তো গল্পের সেটিং। এরকম স্পেস-টাইমটাই ভৌতিক, ভূত না থাকলেও চলবে। বাংলা ভূতের গল্পে অধিকাংশ সময়েই ভূত থাকে না বা থাকলেও তারা আপদ নয় বরং তারা আবেগী, উপকারী, মানুষের সঙ্গে দুদণ্ড কথা বলতে পেরে যেন আরাম পাচ্ছে এরকম ভাব।

এমনই একটা গল্প বলি শুনুন— জ্বরে কাহিল আমাদের কথককে ডাক্তারে পরামর্শ দিয়েছিলেন হাওয়া বদল করতে, তিনি কোথায় যাবেন কোথায় যাবেন ভেবে তাঁর বাবার এক বন্ধু সুধাংশুবাবুর মধুপুরের ‘হাসনুহানা’ কুঠিতে গিয়ে উঠলেন। অযত্নের বাড়ির নেমপ্লেট থেকে উঠে গেছে প্রথম ত্রয়ী অক্ষর, ফলে বাড়ি এখন ‘হানাকুঠি’। সুধাংশুর বাবা সীতাংশু বানিয়েছিলেন এই বাড়ি, তিনি এখন মরে ভূত। তাঁর আত্মা নাকি বাড়ি আগলে আজও রয়েছে। যদিও সে প্রেতাত্মা কিন্তু খুব একটা বিপজ্জনক নয়। “প্রেতাত্মা হলেও সতাত্মা! এক হিসেবে মহাত্মাও বলা যায়।” তো কথক এ সব জেনে অন্য এক বাড়িতে উঠে গেলে সীতাংশুর প্রেত রেগে কাঁই, কেননা কথক তাঁর অতিথি। ফলে রাতের বেলা কথককে তাঁর বাড়ি থেকে তুলে আনেন ‘হানাকুঠি’-তে। এই হল বাঙালি ভূতের আর্কেটাইপ। (মধুপুরের হানাকুঠি/হিমানীশ গোস্বামী)

বাংলা ভূতের গল্পে অধিকাংশ সময়েই ভূত থাকে না বা থাকলেও তারা আপদ নয় বরং তারা আবেগী, উপকারী, মানুষের সঙ্গে দুদণ্ড কথা বলতে পেরে যেন আরাম পাচ্ছে এরকম ভাব।

কাছাকাছি এরকমই আর একটি গল্পের কথা বলি একটু—

এ গল্প কিন্তু মজার নয় মোটেই। কথক ডাক্তারি পড়ুয়া। তাঁর সহপাঠীর এক দিদি আর মাসি উত্তর ভারত ভ্রমণকালে ট্রেন দুর্ঘটনায় মারা যান। ঘটনাচক্রে তাঁর সেই দিদির শব কথকের কলেজে আসে ব্যবচ্ছেদের জন্য। কিন্তু তাঁর মাসির ভূত সেই শবের গোত্র পরিচয় জানিয়ে কথককে বুঝিয়ে দেয় এ শব কার। কেননা মাসির ভূত চেয়েছিল তাঁর বোনঝির যথার্থ সৎকার। (মড়া কাটার ভয়ে/মোহনলাল গঙ্গোপাধ্যায়)

অর্থাৎ, বাংলা সাহিত্যের ভূতেরা আসলে মানবিক গুণ নিয়েই উপস্থিত—মানুষের মতো করেই তাদের ভাবনা এগোয়। তাদেরও নাকি নানান সামাজিক রীতি-নীতি আছে। তারা অমাবস্যার রাতে বা মঙ্গলবার ছাড়া মানুষের ঘাড়ে চাপে না, এমনকি তাদের বর্ণভেদও রয়েছে (কঙ্কালের টংকার/মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়); এমনকি তাদের ইউনিয়নও আছে, সেখানে কারা ভয় দেখাতে সক্ষম হচ্ছে আর কারা নয় তার খোঁজ রাখা হয়, এমনকি তারা ভুলোও হয় (ভুলো ভূত/মহাশ্বেতাদেবী); আবার এমন ভূতও আছে যারা মারা যাওয়ার আগে হয়তো ছিল নাপতেনি, অর্থাৎ সমস্ত বাড়িতে অবাধ যাতায়াতে তাদের সব বাড়ির হাঁড়ির খবর সংগ্রহই ছিল নেশা ও পেশা, মারা যাওয়ার পরেও সে সব ছাড়তে পারছে না (ভূতের মাসি ভূতের পিসি/পূর্ণেন্দু পত্রী); বা, ম্যালেরিয়ায় মারা যাওয়ার পরেও স্বামীর প্রতি স্ত্রীর কর্তব্য না ভুলে অন্যান্য ভূতের হাত থেকে বাঁচানো (জামাই/মনোজ বসু)। এরকম আরও কত কত যে ভূত আছে তার ইয়ত্তা নেই।

বাংলা সাহিত্যে ভূতের বৈচিত্র্য নেহাতই কম নয়, কত রকমের ভূত—মেছো ভূত, গেছো ভূত, বেঁশো ভূত, হ্যাংলা ভূত, বেম্ভদত্যি, শাঁকচুন্নি, পেত্নি—এ সব ভূত বিদেশি সাহিত্যে দুর্লভ, কেননা এরা বাংলার জল-হাওয়া, সামাজিকতা ও ইতিহাসের ধারায় নির্মিত। তাই এরা নিতান্তই বাঙালি ভূত।

বাংলা সাহিত্যের ভূতেরা আসলে মানবিক গুণ নিয়েই উপস্থিত—মানুষের মতো করেই তাদের ভাবনা এগোয়। তাদেরও নাকি নানান সামাজিক রীতি-নীতি আছে।

যে সব কাজ সাধারণ মানুষের পক্ষে দুঃসাধ্য সে সব কাজ ভূতকে দিয়ে করিয়ে নিয়েছেন লেখকেরা, আবার ভূতকে দিয়ে মজার ছলে বলিয়ে নিয়েছেন এমন অনেক কথা যা রাষ্ট্র বিরুদ্ধ—ফলে রূপক ভূতের সংখ্যাও অল্প নয়। যেমন মনে পড়বে রবীন্দ্রনাথের কর্তার ভূতকে, যা কিনা একটা গোটা সাম্রাজ্যবাদী মানসিকতার কনসেপ্ট বা মনে পড়বে ত্রৈলোক্যনাথের ‘লুল্লু’-কে, যে কিনা ঔপনিবেশিক পরিবর্তনকে নির্দ্বিধায় প্রশ্ন করতে পারে; এ প্রসঙ্গে চলে আসবে পরশুরামের গল্পও। এখানে বৈদ্যনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটা গল্পের কথাও মনে পড়বে—

পাকিস্তানের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় প্রচুর ওদেশি হিন্দু বাঙালির প্রব্রজ্যা ঘটেছিল। এরকম পশ্চিমবঙ্গের পার্শ্বস্থ এক গ্রামের বাসিন্দাদের রাজাকার বাহিনীর অস্ত্রের আঘাত থেকে বাঁচিয়ে নিশ্চিন্তে এ দেশের মাটিতে পৌঁছে দিয়েছিল এক বালিকার প্রেত। মৃত্যু বিভীষিকার আতঙ্ক ভৌতিক আতঙ্কের চেয়ে কোনো অংশেই কম নয়। (জীবন্ত পুতুল/বৈদ্যনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়)

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পোড়া ছায়া’ এরকমই এক গল্প। কলকাতায় দাঙ্গার পরিস্থিতিতে এক বারোঘরের মধ্যে মধ্যরাত্রে ভূতের উপদ্রবে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে বাসিন্দারা—যা আসলে দেশভাগের ফলে শত শত মানুষের ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে ঠাঁই খোঁজার আখ্যান; যেখানে ভূত আসলে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় ভুক্ত মানুষদের দ্যোতক।

যে সব কাজ সাধারণ মানুষের পক্ষে দুঃসাধ্য সে সব কাজ ভূতকে দিয়ে করিয়ে নিয়েছেন লেখকেরা, আবার ভূতকে দিয়ে মজার ছলে বলিয়ে নিয়েছেন এমন অনেক কথা যা রাষ্ট্র বিরুদ্ধ—ফলে রূপক ভূতের সংখ্যাও অল্প নয়।

মৃত্যু পরবর্তী জীবন নিয়ে মানুষের ভাবনার কোনো অন্ত নেই। এ জীবনকে মৃত্যুহীন করতে চাওয়ার সে কী আকুল প্রয়াস। মৃত্যুর থেকে ছিনিয়ে নেবে প্রিয়জন বা আত্মজীবন—এ নিয়ে মরিয়া মানুষ বারবার শরণাপন্ন হয়েছে তন্ত্রের কাছে, অপদেবতার কাছে। বাংলা সাহিত্যে তান্ত্রিকের অভাব নেই। আশাদেবীর লেখা ‘বিষের বাঁশি’ এ রকমই এক গল্প—নির্জন ছোট্ট পাহাড়ি গ্রামে একটি ছোটো মনাস্ট্রি, সেখানে গুপ্ত বাক্সয় বন্দি এক বৌদ্ধ তান্ত্রিকের সিদ্ধ বাঁশির রহস্যময় মৃত্যুটান গল্পটিতে রোমাঞ্চরস জুগিয়েছে। বিভূতিভূষণের ‘বিরজা হোম ও তার বাধা’-ও এরকম গল্প, যেখানে তন্ত্রের মাধ্যমে যমের হাত থেকে ছিনিয়ে নিতে চায় কালাজ্বরে আক্রান্ত একটি মেয়ের প্রাণ—কিন্তু মৃত্যুদেবতার হাত থেকে উদ্ধার নেই কারো। সেই অপদেবতার রূপ— “পিছনের ছাদের কার্নিসের ওপর দাঁড়িয়ে এক বিরাটাকার অসুর কিংবা দৈত্যের তন্ময় মূর্তি। তার ততো বড়ো হাত-পা—সেই মাপে। মাথা একটা ঢাকাই জালার মতো। চোখ দুটো আগুনের ভাটার মত রাঙা, আগুন ঠিকরে পড়ছে। আমার দিকেই তাকিয়ে আছে অসুরটা। যেন আমাকে জ্বালিয়ে ভস্ম করে ফেলবে।”

বাঙালি ভূতেরা এরকমই, তাদের কুলোর মতো কান, হাতির মতো দাঁত, তাল গাছের মতো পা; তারা হাত-পা যত খুশি বড়ো করতে পারে, তারা পা জ্বালিয়ে রান্না করে—এরকম আরো কত কি। এই ধরনের ভূতের আমদানি কিন্তু রূপকথা থেকেই, ভারতীয় রূপকথার আদলটাই তাই। সম্প্রতি ‘TUMBBAD’ (২০১৮) ভারতীয় হরর্ জঁরের সিনেমায় আলোড়ন ফেলেছে, সেখানেও আদি-ভৌতিকের শরীর রূপকথার গল্পের ধাঁচেই নির্মিত। রূপকথার ভূতেরা কোনো না কোনো ভাবে নৈতিক শিক্ষার মাধ্যম, যা আসলেই ভারতীয় ভূতের নিজস্বতা।

আধুনিক সাহিত্যের ধারায় বিদেশি প্রভাব কিন্তু এরকম ভূতের রূপের অনেক বদল ঘটিয়েছে। ভূত মাত্রেই এখন অশরীরী এবং অলৌকিক শক্তির বলে মৃত্যুর দূত—যা আসলেই অশুভ। সেরকমের গল্প পড়তেই ইদানীংকার পাঠক বোধহয় বেশি ভালোবাসে। এই গল্পগুলোও নানাভাবে মানুষের নানান মন-জগতের স্বরূপ তুলে ধরতে পারছে। ভূতেদের খনা গলার ডাকও কিন্তু এখন বদলে গেছে, স্বাভাবিক মানুষের ডাকে।

পৃথিবী বদলায়, জীবন বদলায়। ফলে বদলে যাচ্ছে ভৌতিক গল্পের খোলনলচে। তার মধ্যেই বাংলা ভূতের গল্পের বহুমাত্রিকতা যে আসলেই মানুষের গল্প তা যেন ভুলে না যাই।


তথ্যঋণ: গল্পের ভূত, সুকুমার সেন, আনন্দ পাবলিশার্স, ১৯৮২
অলংকরণ সৌজন্যে: শতাব্দীর সেরা ভূতের গল্প, সংকলক: ননীমাধব চোধুরী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.