শিল্পের সৃষ্টির মূলে মানুষের মনের তীব্র আবেগ আছে সত্য, কিন্তু আবেগের বশে যাই করি তাই তো শিল্প হয় না। অবন ঠাকুরের (Abanindranath Tagore) কথায়, ‘অনেকদিনের পরে বন্ধুর সঙ্গে হঠাৎ দেখা, আনন্দের উচ্ছ্বাসে তার গলা জড়িয়ে কত কথাই বলা হল, কিন্তু সেটা কাব্যকলা কি নৃত্যকলা দুয়ের একটাও হল না। কিন্তু বন্ধুর আসবার আশায় ভাবে ডগমগ হয়ে যেন মন নৃত্য করছে, তার জন্য ফুলের মালা গাঁথছি, নিজে সাজছি ঘর সাজাচ্ছি—নিজের আনন্দ নানা খুঁটিনাটি কাজে, এটা-ওটা জিনিসে ছড়িয়ে যাচ্ছে—এই হল শিল্পের দেখা দেবার অবসর। অতৃপ্তির মাঝে মন দুলছে-এই দোলাতেই শিল্পের উৎপত্তি।’
কামনার তীব্র আবেগ এবং তার চরিতার্থতা—এ দুয়ের মাঝে যে একটা প্রকাণ্ড বিচ্ছেদ, সেই বিচ্ছেদের শূন্য ভরে উঠছে নানা কল্পনায়, নানা ক্রিয়ায়, নানা ভাবে, নানা রসে। মনের আবেগ সেখানে ঘনীভূত হয়ে প্রতীক্ষা করছে প্রকাশকে। মনের এই উন্মুখ অথচ উৎক্ষিপ্ত নয়, অবস্থাটিই হচ্ছে শিল্পের জন্মাবার অনুকূল অবস্থা। এসময় মানুষ সুন্দর-অসুন্দর বেছে নেবার সময় পায়, যেমন-তেমন করে একটা কিছু করবার চেষ্টাই থাকে না। হঠাৎ যদি বাঘ এসে সামনে পড়ে তবে তার গায়ের চিত্রবিচিত্র ছাপ, তার গঠনের সৌন্দর্য, এ-সব কিছুই চোখে পড়ে না; ভয় এবং পালানো তখন এতই কাছাকাছি আসে যে সৌন্দর্য বোধ করবার অবসর মন পায় না বললেই হয়। কিন্তু খাঁচার ওদিকে বাঘ এদিকে আমি, কিম্বা দূরে বাঘ লাফিয়ে চলেছে, তখন আবেগ আর ক্রিয়ার মাঝে অনেকটা অবসর; সেখানে বাঘের নানা সৌন্দর্য চোখে পড়ে। এই পরিপ্রেক্ষিতেই একটি ঘটনার কথা এখানে বলবো। ঘটনাটি এইরকম-
মাস্টারমশাই অবনীন্দ্রনাথকে একটি ছবি দেখাতে এনেছে তাঁর প্রিয় ছাত্রটি। দেবী উমার (Uma) ছবি। ছবি জুড়ে হালকা-হালকা গেরুয়া রঙ। তা দেখে মাস্টারমশাইয়ের প্রতিক্রিয়া- ‘ছবিতে একটু রঙ দিলে না?… উমাকে একটু সাজিয়ে দাও। কপালে একটু চন্দন-টন্দন পরাও, অন্তত একটি জবাফুল।’ ছাত্র ফিরে গেল। কিন্তু শিক্ষক রাতভর জেগে রইলেন। মন কেবলই অস্থির হয়ে উঠছে। ভাবেন, প্রিয় ছাত্রটি হয়তো তপস্বিনী উমার অন্য রূপ দেখেছে–পাথরের মতো দৃঢ়, রংহীন এক রূপ। রংহীন সে রূপে না-ই থাকতে পারে চন্দন, ফুল!
ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই শিক্ষক মোটর নিয়ে ছুটলেন ছাত্রের কাছে। এদিকে মন তোলপাড় হয়ে চলেছে, রাতেই বুঝি ছবিতে রং চাপিয়ে ফেলেছে ছাত্রটি। তবে তখন ছাত্রটি প্যালেটে রং গুলে ভাবনাচিন্তা করছে। এমন সময় হঠাৎ দরজায় কড়া নাড়া। দরজা খুলে দেখেন, দাঁড়িয়ে রয়েছেন মাস্টারমশাই। বললেন, ‘থামো থামো, কি ভুলই আমি করতে যাচ্ছিলুম, তোমার উমা ঠিকই আছে। আর হাত লাগিয়ো না।’
সেই ছবিটি হল- ‘উমার তপস্যা’। ছাত্র, নন্দলাল বসু (Nandalal Bose)। নন্দলালের উমাকে দেখে অবন ঠাকুর তখনই উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন, যখন নন্দলাল ফিরে গিয়েছিলেন। আবেগ আর ক্রিয়ার মাঝে যে অবসর, সেই অবসরই তাঁকে রংহীন উমাকে প্রত্যক্ষ করিয়েছিল এবং শেষত তিনি বুঝতে পেরেছিলেন প্রিয় ছাত্রটির কাজের গুরুত্ব। অন্যদিকে, শিক্ষকের কথা অনুযায়ী বাধ্য ছাত্রের মতো নিজের আঁকা ছবি পাল্টে না ফেলে, ঘরে ফিরে এসে গভীরতার সূক্ষতম জায়গায় পৌঁছে ছবিটি নিয়ে ভেবেছিলেন নন্দলাল, কিন্তু ছবিটিতে হাত ঠেকাননি। নিজের অবস্থান আর চেতনাকে এতটুকুও অবিশ্বাস করেননি তিনি। অবসর সময় বৃথা যেতে দেননি তিনিও।
*নন্দলাল বসুর আঁকা ‘উমার তপস্যা’ ছবিটি পাওয়া যায়নি। প্রচ্ছদে নন্দলাল বসুর সঙ্গে কোলাজে ব্যবহৃত হয়েছে তাঁরই আঁকা- ‘মহিষাসুরমর্দিনী’।
তথ্যসূত্রঃ
বাংলার ব্রতকথা, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর
আনন্দবাজার পত্রিকা