ব্রিটিশ কর্নেলের হাতে লাঞ্ছিত হয়ে ঋষি বঙ্কিমচন্দ্রের কলমে অগ্নি বর্ষিত হল- তিনি লিখলেন মহামন্ত্র বন্দেমাতরম্

[ “বন্দে মাতরম” এর উদ্ভবের কথা জানেন আপনারা? না না আপনারা নয়! সমস্ত বুদ্ধিজীবী ব্যক্তি এবং গুগল বাবা আপনারা কি জানেন……?

ক্রিকেট মাঠে তোলপাড়ই কি বন্দেমাতরমের উৎপত্তি? প্রায় ১৪৫ বছর আগে ব্রহ্মপুর অর্থাৎ বহরমপুর খেলার মাঠের ব্যারাক স্কোয়ারে (বর্তমানে স্কোয়ার ফিল্ড) একটি বচসার সূচনা হয়েছিল , যার ফলে বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রতিশোধ নিয়ে বন্দেমাতরম দেশাত্মবোধক গানটি রচনা করেছিলেন। এই মহাসঙ্গীতই পরবর্তী কালে মহাকাব্য উপন্যাস আনন্দমঠের অংশ হয়।


ক্রিকেটের মাঠে ব্রিটিশ কর্নেলের হাতে লাঞ্ছিত হয়ে ঋষি বঙ্কিমচন্দ্রের কলমে অগ্নি বর্ষিত হল। তিনি লিখলেন বন্দেমাতরম্।

১৮৭৩ সাল নাগাদ বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুরে ডেপুটি কালেক্টর হিসাবে নিযুক্ত ছিলেন । ১৮৭৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর বহরমপুর সেনানিবাসের কমান্ডিং অফিসার কর্নেল ডাফিনের নেতৃত্বে স্কয়ার ফিল্ডে ব্রিটিশ সৈন্যদের মধ্যে একটি ক্রিকেট ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়। সেই ১৫ ডিসেম্বরের শীতল সন্ধ্যায় যখন মুর্শিদাবাদ জেলার ডেপুটি কালেক্টর বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, একটি পালকিতে চড়ে বাড়ি ফিরছিলেন। দ্রুত সন্ধ্যা নামায় পালকি বহনকারীরা রাস্তার পরিবর্তে স্কয়ার মাঠ পেরিয়ে যেতে শুরু করে। তবে এ ব্যাপারে বঙ্কিমচন্দ্র কিছু জানতেন না। এদিক ক্রিকেট মাঠের মধ্যে একটি বড় পালকি হুন হুনা করতে করতে এসে পড়ায় ব্রিটিশদের খেলায় বাধা সৃষ্টি হয়। ফলত, বেহারা,লেঠেলদের সঙ্গে লালমুখোদের বচসা ও হাতাহাতি লেগে যায়।

কর্নেল ডাফিন ক্ষিপ্ত হয়ে পালকি থামিয়ে বঙ্কিমবাবুকে পালকি থেকে নামিয়ে চার-পাঁচটি ঘুষি মারে। বঙ্কিমচন্দ্রের নাক থেকে রক্ত ঝড়তে থাকে। তাঁকে ব্ল্যাক নেটিভ ইন্ডিয়ান বলে থুতুও ছেটায়। এই ঘটনায় বঙ্কিমচন্দ্র চরম অপমানিত হন। সেই সময় মাঠে তৎকালীন কিছু স্বনামধন্য দর্শকদের সামনে অপ্রীতিকর ঘটনাগুলি ঘটতে থাকে। সেই সম বিখ্যাত ব্যক্তিদের মধ্যে ছিলেন প্রিন্সিপাল রবার্ট হ্যান্ড, রেভারেন্ড বারলো, বিচারক বেনব্রিজ, লালগোলার রাজা যোগীন্দ্র নারায়ণ রায়, দুর্গাচরণ ভট্টাচার্য, কয়েকজন ব্রিটিশ অফিসার এবং কয়েকজন স্থানীয় অভিজাত। এঁরা সকলে ম্যাচ দেখার জন্য আমন্ত্রিত ছিলেন।


ক্রিকেট মাঠের এই অপমান বঙ্কিমচন্দ্রের খ্যাতি ক্ষুন্ন করেছিল কারণ তিনি দায়িত্বরত ডেপুটি কালেক্টর ছিলেন। পরের দিন, অর্থাৎ ১৬ ডিসেম্বর, ১৮৭৩ তারিখে, তিনি কর্নেল ডাফিনের বিরুদ্ধে মিস্টার উইন্টারের আদালতে একটি মামলা দায়ের করেন। এই মিস্টার উইন্টার ছিলেন মুর্শিদাবাদের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট। মামলার অভিযোগ শুনে ম্যাজিস্ট্রেট শীঘ্রই সকল প্রত্যক্ষদর্শীকে সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য ডাকলেন।

প্রিন্সিপাল রবার্ট হ্যান্ড সংঘর্ষের কথা স্বীকার করলেও অধিকাংশ প্রত্যক্ষদর্শী সংঘর্ষের কথা অস্বীকার করেন। রাজা যোগীন্দ্র নারায়ণ রায় এবং দুর্গাচরণ ভট্টাচার্য বঙ্কিম বাবুর পক্ষে সাক্ষ্য দেন। তবে বিচারক বেনব্রিজ বলেন যে , তাঁর দৃষ্টিশক্তি বড়ই দুর্বল , অতটা দূরে হাতাহাতি দেখেছেন , তবে সবই আবছা। এই মর্মে তিনি একটি ডাক্তারি সার্টিফিকেটও পেশ করেন। তদুপরি, মুর্শিদাবাদের সমস্ত আইনী প্রতিনিধি বঙ্কিমচন্দ্রকে সমর্থন করেছিলেন। ফলে বাধ্য হয়ে কর্নেল ডাফিনকে তার পক্ষ রক্ষার জন্য কৃষ্ণনগর, নদীয়ার একজন নেটিভ আইনজীবীকেই নিয়োগ করতে হয়েছিল। এদিকে, আদালত পরবর্তী শুনানির তারিখ ১২ জানুয়ারি, ১৮৭৪ তারিখ ধার্য হয়।

১২ ই জানুয়ারী সকালে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে দৃশ্যটি ছিল হতবাক করার মতো। সেদিন মুক্ত আদালতে প্রায় হাজার হাজার কৌতূহলী অধৈর্য দর্শক মামলার রায় জানার জন্য উপস্থিত হয়েছিলেন। সেখানে যেমন ছিলেন স্থানীয় লাঞ্চিত বাঙ্গালী , তেমনি ছিল প্রভুত্বকারী ইউরোপীয়রা। সেদিন প্রথমে বিচারক বেনব্রিজ আদালতে হাজির হন এবং ম্যাজিস্ট্রেটকে অনুরোধ করেন – “মিস্টার উইন্টার! কিছু মনে করবেন না। দয়া করে যদি চেম্বারে আসেন। “
কয়েক মিনিট পরে, কর্নেল ডাফিন এবং বঙ্কিমচন্দ্রকে বিচারক বেনব্রিজের চেম্বারে তলব করা হয়। সেখানে বঙ্কিম বাবুকে মামলাটি প্রত্যাহারের জন্য অনুরোধ করা হয়। স্বাভাবিক ভাবেই বঙ্কিমরচন্দ্র বিষয়টি প্রত্যাখ্যান করেন। এরপর বারংবার তাঁকে অনুরোধ করা হলো। শেষ অবধি বঙ্কিমবাবু রাজি হলেন, কিন্তু একটা শর্ত দিয়ে। – তিনি খোলা আদালতের সামনে কর্নেল ডাফিনকে তাঁর নিকট ক্ষমা চাইতে বলেন। ডাফিন দেখে, যদি সে ক্ষমা না চায় তবে মামলাটি তার জন্য বেশ জটিলতর আকার ধারণ করবে। ফলত,কর্নেল ডাফিন নিঃশর্ত ক্ষমা চাইতে রাজি হয়।

১৫ ই জানুয়ারী, ১৮৭৪ – অমৃত বাজার পত্রিকায় একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় – সেখানে লেখা ছিল, ” সেদিন খোলা আদালতে বঙ্কিমবাবুএবং কর্ণেলকে দেখে এটা মনে হয়েছিল যে , কর্নেল এবং বঙ্কিমচন্দ্র একে অপরের জন্য সম্পূর্ণ অপরিচিত ছিলেন এবং কর্ণেল ডাফিন হয়তো নিজেও জানত না যে আদৌ বঙ্কিমবাবু কে ছিলেন যখন তাঁকে অপমান করছিল। বঙ্কিমবাবুর অবস্থান সম্পর্কে পরে অবহিত হওয়ার পর, কর্নেল ডাফিন নিজের কৃতকর্মের জন্য ক্ষোভ প্রকাশ করে এবং ক্ষমা চাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করে। সেদিন উন্মুক্ত আদালতে যথাযথভাবে ক্ষমা চাওয়া হয়েছিল। সেখানে স্থানীয় এবং ইউরোপীয় মিলে প্রায় ১০০০ দর্শক উপস্থিত ছিলেন।”

কোর্টরুমের ঘটনাটি অন্যান্য ইউরোপীয়দের সাথে কর্নেল ডাফিনকে আরও ক্ষুব্ধ করে। একজন নেটিভ ইন্ডিয়ানের নিকট মুক্ত আদালতে ক্ষমা চাওয়া অর্থ সম্পূর্ণ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের অপমান। ফলত, তারা বঙ্কিমচন্দ্রকে গুপ্ত হত্যা করার ষড়যন্ত্র করতে শুরু করে।  ইতিমধ্যে ষড়যন্ত্রের কথা রাজা যোগীন্দ্র নারায়ণ রায় কোনোভাবে জানতে পেরেছিলেন  এবং বঙ্কিমচন্দ্রকে বাঁচানোর জন্য রাজমশায় তাঁকে লালগোলায় আমন্ত্রণ জানান।

 মাঠের ঘটনা বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মানসিকতার উপর গভীরভাবে প্রভাব ফেলেছিল, তারপরে আইন আদালতের কার্যক্রমে বিরক্তি এবং অবশেষে জীবনের হুমকিও ছিল।  তিনি এককথায় রাজার আমন্ত্রণ গ্রহণ করেন এবং ১৮৭৪ এ  সালের জানুয়ারিতেই লালগোলা চলে যান।  যদিও বঙ্কিমবাবুর  চাকরির রেকর্ডে বলা হয়েছে যে তিনি 3 ফেব্রুয়ারি থেকে ২ মে, ১৮৭৪ - এই তিন মাস ছুটিতে ছিলেন, তবুও তিনি তাঁর ছুটি মঞ্জুর হওয়ার অনেক আগেই বহরমপুর ত্যাগ করেন।

লালগোলায় রাজার নিকট তিনি কয়েকটি হিন্দু মন্দির বেষ্টিত একটি অতিথিশালায় বাস করতে শুরু করেন।  জগদ্ধাত্রী, দুর্গা এবং কালী মহামায়ার এই তিনরূপের মন্দির ছিল সেখানে । সারা সন্ধ্যা তিনি ধ্যান, গ্রন্থপাঠ ইত্যাদিতে ব্যস্ত থাকতেন।  তিনি ক্রমশঃ আধ্যাত্মিক হয়ে ওঠেন, অবিদ্যা স্বরূপ মায়ার জগৎ ছেড়ে বিদ্যা স্বরূপ মহামায়ার জগতের কাছে নিজেকে সমর্পণ করেন। কিন্তু তিনি মাঠের ঘটনা ভুলতে পারছিলেন না।  ইংরেজদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে বঙ্গ তথা ব ভারতবর্ষকে একটি ‘মন্ত্র’ দিয়ে উদ্বুদ্ধ করার চিন্তা করতে থাকেন।


অবশেষে ১৮৭৪ সালের ৩১ জানুয়ারি  'মাঘী পূর্ণিমার" রাত্রিতে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় দ্বাদশঅক্ষরের সেই অমোঘ মন্ত্রের সূচনা করেন - 'বন্দেমাতরম্" । সেই মন্ত্র শোষিত , নিষ্পেষিত ভারতবাসীকে পুনরায় যোদ্ধা মন্ত্র দীক্ষিত করল। 

বঙ্কিমচন্দ্র ছুটি শেষ না হওয়া পর্যন্ত তিনি লালগোলায় থেকে যান এবং কখনও বহরমপুরে ফিরে আসেননি, পরিবর্তে তিনি মালদহে চলে যান এবং পরে তিনি হাওড়া জেলায় চাকুরির স্থানান্তর করেন।  এদিকে, আনন্দমঠের একটি ভগ্নাংশ প্রথম বঙ্গদর্শন পত্রিকায় (খণ্ড ৭) ১৮৮১ সালে প্রকাশিত হয়, কিন্তু তার মহাকাব্য উপন্যাস আনন্দমঠ ১৮৮২ সালের এপ্রিল মাসে প্রকাশিত হয়।

গ্রন্থ প্রকাশের পরপরই, ব্রিটিশরা তাকে মানসিক নির্যাতন শুরু করে, তাকে উপন্যাস থেকে উপাদান পরিবর্তন করার জন্য চাপ দেয়। অবশেষে, বঙ্কিম বাবু চাপ সহ্য করতে পারেননি এবং ১৮৮৫- ৮৬ সালের মধ্যে কোনো একসময় স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণ করতে বাধ্য হন।

১৪৫ বছর পরেও, সেইজাতীয় সঙ্গীতমন্ত্র আমাদের শক্তি প্রদান করে ​​​ - 'বন্দে মাতরম'!
©দুর্গেশনন্দিনী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.