বীরত্বের দিব্যরূপই তাঁর স্বরূপ, সংকটমোচন হনুমানে তাই আস্থা শ্রীরামচন্দ্রের।

উদীয়মান বলার্কের মতো কান্তিমান পবননন্দন, বানর শিরোমণি হনুমান। তাঁর বর্ণ অশোক ফুলের মতো, তাঁর চোখ সোনার মতো, তিনি বিপুল এবং বিশাল। শ্রীরামচন্দ্রের পক্ষে দূত হয়ে তিনিই গিয়েছিলেন লঙ্কায়। বীর্য ও ধৈর্য্যের আধার তিনি; তিনি প্রভুভক্ত, বানরোত্তম, বলবীর্যশালী দৈব্যসত্তা। জনকদুহিতা সীতাদেবীর খবর নিয়ে আসতে তিনি সক্ষম ছিলেন। শতযোজন সাগর অতিক্রম করতেও তিনি কৃতবিদ্য। তাই তিনি লঙ্কা অভিমুখে গমন করলেন। সাগর গোষ্পদ বিবেচনা করে তিনি কৃতকার্যও হলেন।

লঙ্কায় অশোক-কাননে সীতাদেবীর দর্শন পেলেন তিনি। শ্রীরাম বিরহে-চিন্তনে সতত নিমগ্ন সীতা; শোকাতুরা, একবেণী হয়ে বসে আছেন। চারিদিকে শক্তিশালী রাক্ষসীর দল ঘিরে রয়েছে তাঁকে৷ সময় উপযুক্ত বুঝে বৃক্ষে উপবেশন করেই সংস্কৃত ভাষায় সীতাদেবীর শ্রবণ-গোচরের জন্য মধুর বচনে শ্রীরাম কাহিনি বিবৃত করতে লাগলেন। হনুমানের ভয়ঙ্কর রূপ দর্শনে প্রথমে সীতাদেবী মূর্চ্ছা গেলেন। পরে জ্ঞান ফিরলে আশ্বস্ত হয়ে কথোপকথন হল। হনুমান জানালেন, তিনি শ্রীরামচন্দ্রের দূত, তিনি বানর রাজ সুগ্রীবের সচিব। প্রমাণস্বরূপ শ্রীরাম-প্রদত্ত অঙ্গুরীয় সীতাদেবীকে দেখালেন। বললেন, কমললোচন রাম সীতাদেবীর সংবাদ পেলেই যক্ষ ও বানরসৈন্য সমেত লঙ্কায় উপস্থিত হবেন। সীতাদেবীকে উদ্ধারও করবেন তিনি। দু’জনের সাক্ষাতের প্রমাণস্বরূপ আপন শিরোরত্ন কাপড়ের মধ্যে থেকে বার করে শ্রীরামচন্দ্রকে প্রদান করতে হনুমানকে অর্পণ করলেন সীতা। সেই সঙ্গে শোনালেন, চিত্রকূট পর্বতের উপবনে সংঘটিত রাম-সীতার একান্ত গোপন এক ঘটনা, যা শুনে রামচন্দ্র বুঝতে সমর্থ্য হবেন, সত্যিই হনুমানের সঙ্গে সীতাদেবীর সাক্ষাৎ হয়েছে।

সীতাদেবীকে নিজের পৃষ্ঠে স্থাপন করেই রামচন্দ্রের নিকট সমর্পণ করতে সক্ষম ছিলেন পবননন্দন৷ কিন্তু তাতে শ্রীরামের যশোহানি ঘটতো। গমনের বেগে সীতাদেবী সমুদ্রে পড়ে যেতেও পারতেন। রাক্ষসগণও পশ্চাদ্ধাবন করে সীতাদেবীকে আক্রমণ করতেও পারতো। যেহেতু যুদ্ধে জয়-পরাজয় সুনিশ্চিত নয়। তাই বিবেচনা করে সীতা একলা হনুমানের সঙ্গে যেতে রাজি হলেন না। বললেন, রাবণ ও অন্যান্য রাক্ষসবধ করেই যেন শ্রীরামচন্দ্র তাঁকে উদ্ধার করে নিয়ে যান।

সীতাদেবীর সাক্ষাৎ পাবার পর অতিরিক্ত কার্য হিসাবে প্রবল পরাক্রমে ভয়াবহ মূর্তিতে লঙ্কানগরীকে ত্রস্ত করে তুললেন হনুমান। শত্রুপক্ষের বল যাচাই করতে গেলে বল প্রয়োগ করেই দেখে নেওয়া উচিত। এই বিবেচনা করেই রাক্ষস-সংহারে নামলেন তিনি। সংগ্রামের সময় শত্রুর সামর্থ্য কীরূপ, তা তো জানা দরকার! তখন রাবণের প্রমোদ-কানন অশোক-বন বিনষ্ট করতে উদ্যত হলেন। শুরু হল বিশাল বৃক্ষ উৎপাটন এবং বৃক্ষভঙ্গের সহস্র ঘটনা। তাতে রাক্ষসীদের নিদ্রা গেলো টুটে। খবর গেলো রাবণরাজার কাছে। ভয়ঙ্কর ক্রোধে চিতার আগুনের মতো জ্বলে উঠলেন রাবণ। এদিকে হনুমান উচ্চকণ্ঠে উচ্চারণ করছেন, রঘুবীরের জয়, মহারাজ সুগ্রীবের জয়, “জয়ত্যতিবলো রামো লক্ষ্মণশ্চ মহাবলঃ।/ রাজা জয়তি সুগ্রীবো রাঘবেনাভিপালিতঃ।।”

হনুমান লঙ্কাকাণ্ড ঘটিয়েছেন। কখনও লৌহ-তোরণ খুলছেন, তো কখনও লৌহ-পরিখা! কী না করছেন! প্রবল প্রহারে কিঙ্করবধ করে চলেছেন। কখনও স্তম্ভ উৎপাটিত করছেন, কখনও প্রাসাদ দগ্ধ করে দিচ্ছেন। রথযুদ্ধে ধাবমান জম্বুমালীকে সহজেই নিহত করলেন। তাঁর সঙ্গে যুদ্ধ করতে আসা মন্ত্রীপুত্রদের সসৈন্যে বধ করলেন। গিরিশৃঙ্গ উৎপাটন করে বধ করলেন বিরূপাক্ষ, যূপাক্ষ, দুর্ধর্ষ, প্রঘস, ভাসকর্ণ নামক পঞ্চ সেনাপতিকে। ঘোড়া দিয়েই ঘোড়া মারছেন, হাতি দিয়েই হাতি। সৈন্য দিয়ে সৈন্যদের মারছেন এক এক করে। আর নবোদিত সূর্যের মতো কান্তিময় রাবণপুত্র অক্ষের চরণদ্বয় দৃঢ়ভাবে ধরে সহস্র-ঘুর্ণন সম্পন্ন করে নিক্ষিপ্ত করলেন দূরে, সঙ্গে সঙ্গে চূর্ণ হয়ে গেলো কুমারের দেহ। তার আগেই চপেটাঘাতে বধ করেছেন কুমারের অষ্ট অশ্ব। এবার রাবণের আহ্বানে ইন্দ্রজিৎ যুদ্ধরথে চড়ে এলেন। তার ব্রহ্মাস্ত্রে অবশেষে নিশ্চেষ্ট হবার ভাণ করলেন হনুমান। তখন বল্কলরজ্জুতে বেঁধে কটূক্তি করতে করতে রাক্ষসেরা তাঁকে রাবণের সভায় নিয়ে গেলো।

রাবণ ভয়ঙ্কর ক্রুদ্ধ। তিনি অনতিবিলম্বে হনুমানকে বধ করতে চান। কিন্তু দূতকে প্রাণদণ্ড দেওয়া যায় না! এ নীতি বিরুদ্ধ কাজ, সতর্ক করলেন বিভীষণ। কিন্তু অন্য দণ্ড তো দেওয়া যেতে পারে! তাই রাবণ আদেশ দিলেন, হনুমানের লেজে কার্পাস বস্ত্র জড়িয়ে জ্বালানি তেল ঢেলে অগ্নিসংযোগ করতে। এ শাস্তি কিন্তু লঙ্কানগরীর পক্ষে আদৌ সুখকর হল না। দেহ পরিবর্ধন করে জ্বলন্ত লেজ দিয়েই তিনি গোটা লঙ্কা ছাড়খাড় করে ছাড়লেন। গৃহ পুড়ছে, রাক্ষসের মরছে, চারিদিকে উচ্চ-রোদন। প্রসাদ-তোরণ দগ্ধ। তার মধ্যেই সীতাদেবী রক্ষা পেয়েছেন। আর সীতাদেবীরই ইচ্ছায় ও প্রার্থনায় হনুমানের লেজ আগুনে দগ্ধ হল না৷ লঙ্কাকাণ্ড করে অবশেষে তিনি সমুদ্রে ডুবিয়ে লেজের আগুন নেবালেন৷

এবার তিনি লম্ফ দিয়ে সাগর লঙ্ঘন করে ফিরবেন। তাই উঠেছেন সূর্যকিরণে উজ্জ্বল অরিষ্ট পর্বতে৷ ত্রিশ যোজন উচ্চ এবং দশ যোজন বিস্তৃত সেই পর্বত। তখন কেমন লাগছে তাকে? যেন পর্বতের বনরাজি হয়েছে তাঁর বসন, যেন পর্বত শৃঙ্গে সম্পৃক্ত অভ্ররাজি তাঁর উত্তরীয়, যেন পর্বত-গাত্রে নির্ঝর-ধৌত ধাতব-শিলা হয়েছে তাঁর চোখ। ক্রমশ তাঁর দেহ বাড়িয়ে তুলছেন প্রস্তুতি নিয়ে। সেই চাপ পর্বতের সইতে পারা সহজ কথা নয়! শিলাস্তর চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। শিলাবাসী প্রাণিসকল মহাত্রাসে রসাতলে যাচ্ছে। গুহাবাসী সিংহ-গর্জন মনে হচ্ছে যেন মহা-আর্তনাদ। পর্বতবাসী গন্ধর্ব, কিন্নর, যক্ষ, বিদ্যাধরবৃন্দের অবস্থাও তথৈবচ। তাঁরা অন্তরীক্ষে সাময়িক আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন এ যাত্রায়। সমগ্র পর্বত ভূতলে প্রবিষ্ট হতে বাকী নেই। এবার তিনি মহালম্ফ দিয়ে উচ্চ আকাশে উঠলেন৷ তিনি নিজেও যেন এক সপক্ষ-পর্বত। কী অসীম শক্তি! এদিকে গগনতলে সাগরের অসীমতা। ওদিকে আকাশে নানা বর্ণের মেঘ। এই শোভন-সাগরের উপরে অভ্র-জালিকা ভেদ করে মহাবেগে বীর হনুমান এগিয়ে চলেছেন৷ সেই ঘন মেঘ জালিকার মধ্যে কখনও তাঁর দৃশ্যরূপ, কখনও অদৃশ্য। মধ্য পথে মৈনাক পর্বত ছুঁয়ে তিনি মহেন্দ্র পর্বত দেখতে পেলেন। সমুদ্রের উত্তর কিনারে তারই জন্য প্রতীক্ষারত জাম্ববান প্রভৃতি বানরবাহিনি। তাদের দেখে তিনি মেঘের মতো গর্জন করছেন। পর্বতগুহার মধ্যে প্রবলবেগে প্রবিষ্ট বায়ু যে শব্দ সৃষ্টি করে, এ তেমনই গর্জন। এ হর্ষ নিনাদ! এ নিনাদ কৃতকার্যে সফলতার বার্তা, বুঝতে পেরে বানরকূল আনন্দে আত্মহারা হলেন। তারা বৃক্ষশাখা থেকে শাখান্তরে, শৃঙ্গ থেকে শৃঙ্গান্তরে লম্ফঝম্প করে তাদের আনন্দ-অনুভূতি প্রকাশ করে লাগলেন। হর্ষে, প্রতি হর্ষে চারিপাশ পরিপূর্ণ। এমনই আনন্দ-গর্জনের মধ্যে মহেন্দ্র পর্বতের ঝরণামালায় আকাশ থেকে পতিত হলেন পবননন্দন। বানরেরা আনন্দিত। সেই রমণীয় বনপ্রদেশের মধ্যে তারা বৃক্ষশাখা চয়ন করে পেতে দিলেন আসন, ভোজনের জন্য উপহার দিলেন সুস্বাদু ফলমূল। বানরকূলের আনন্দ-অন্তর দেখে কে! তারপর ….

(আরও জানতে পরবর্তী পর্বের জন্য আপনাদের সকলকে আমন্ত্রণ)

ড. কল্যাণ চক্রবর্তী । ছবি এঁকেছেন শীর্ষ আচার্য

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.