দু’দশক আগে হলে, এই সময় মানে এই ভরা চৈত্রে গড়িয়াহাট, ধর্মতলা, হাতিবাগান চত্বরে পা বাড়ানোর আগে মানুষ দু’বার ভাবতো। আমরা সকলেই জানি, সে ছবি আর নেই। চৈত্র সেল ছাড়া নতুন বছর! এককালে ভাবতে পারতো না বাঙালি। সময়ের বেনোজলে উদযাপনের ধারা যেমন বদলেছে, তেমনই বদলে গেছে চৈত্র সেলের ধরন। কেউ কেউ বলবেন, জীবন সহজ হয়েছে, প্রযুক্তি এসে সময় বাঁচিয়েছে ঢের। কেউ আবার সামান্য অন্যমনস্ক হয়ে ফিরতি পথে সেই জৌলুস হারানো চৈত্র সেলেই যাবেন। শপিং মলের স্ট্যাটাস, ই-কমার্স মার্কেট, লকডাউন – অনেক ঝঞ্ঝা পেরিয়ে সাধারণের, ফুটপাথের চৈত্র সেল মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে কীভাবে?
চৈত্র সেল নয় এখন ‘এন্ড অফ সিজন সেল’-এর যুগ। একটু একটু করে শপিং মল গিলতে থাকল, প্রথমে শহরকে, তারপর মফঃস্বলকে। এখন সারা বছরেই নানা ডিস্কাউন্ট। সময়ে সময়ে ঠাসাঠাসি ভিড় হয় বটে, কিন্তু এর গায়ে ওর ঘাম লেগে যাওয়া নেই, এসি আছে যে! সেখানে বিকল্পও বেশি। জামা গায়ে আঁটছে কিনা, দেখার জন্য ট্রায়াল রুম, ঝকঝকে আয়না সব আছে। হাতে সময় কম থাকলে অনলাইন শপিং আছে, যদিও অনলাইন শপিং-এর ব্যবস্থা এখন সর্বত্রই। টাকা মেটানোর জন্য লাইনে দাঁড়ানোর ঝক্কিটুকু পর্যন্ত নেই।
তবে, এই যুগেও, শপিং মল, অনলাইনে সারাবছরই কারণে-অকারণে অফারের স্রোতে হাবুডুবু খাওয়া বাঙালি বাদে কেউ কেউ (বিশেষত শ্রমজীবী সাধারণ মানুষ, স্মৃতিবিধুর মানুষ) এখনও ভুলতে পারেননি তাঁদের ছা-পোষা ‘চৈত্র সেল’-কে। যাদবপুর স্টেশন রোডের দুধারে এখনও চোখে পড়ার মতো চৈত্র সেলের ভিড় জমে। একটি দোকানে বেডকভারের দরদাম করছিলেন সোনালি দাস। মগরাহাট থেকে যাদবপুর অঞ্চলে নিত্যদিন আসেন পরিচারিকার কাজে। “অনেকদিন ধরে ভেবে রেখেছিলাম এবার সেলে ২টো বিছানার চাদর কিনবো। কিন্তু কাজের বাড়ি থেকে বেরোতে কদিন এত দেরি হচ্ছিল, ট্রেনের সময় হয়ে যাচ্ছিল। বছরে একবার একটা জিনিস কিনবো, একটু সময় নিয়ে দেখেশুনে না কিনলে হয়!”
গড়িয়াহাট চত্বরের ছবিটা আবার আলাদা। এখানে সারা বছর যেমন কেনাকাটা চলে, তেমনই। আহামরি কিছু চোখে ঠেকলো না। চৈত্র সেল ‘ভাইবস’ এখানে এপ্রকার অনুপস্থিতই বলা চলে। ফুটপাথের পাশে ছোটো কয়েকটি দোকান বাদে বড়ো বড়ো দোকান্গুলোতেই দেখা গেল ‘চৈত্র সেল’ ব্যানার, ফ্লেক্স, স্টিকার। তবে, সেসব দোকানে চোখে পড়লো না ক্রেতাদের ভিড়। ভর দুপুরে ‘রিডাকশন সেল’-এর জুতো কিনতে এসেছিলেন প্রবাল অধিকারী। বললেন, “আমার অফিস কাছেই। এই পথ দিয়েই একটা কাজে যাচ্ছিলাম। দেখলাম সেল চলছে, তাই দাঁড়িয়ে পড়লাম। চৈত্র সেলে কিছু না কিছু তো কিনিই। অবশ্য আগের মত সপরিবারে কেনাকাটা করি না এই সময়, ওটা পুজোর সময় হয়। বাজারের যা অবস্থা… ”।
হাতিবাগান চত্বরের ছবি গড়িয়াহাটের মতোই। ভিড় তুলনায় বেশি। দোকানে বড়ো বড়ো করে লেখা সেল! আর তা দেখেই উৎসাহী চোখের ভিড় দোকানের দিকে! কি নেই! জামা থেকে জুয়েলারি, জুতো থেকে কসমেটিক সবেতেই ডিসকাউন্টের বোর্ড ঝুলছে। চৈত্রের শেষে আসন্ন নববর্ষে নতুন জামাকাপড় পরার প্রথা চলে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। তবে করোনার বাড়বাড়ন্তে তাতে কিছুটা ভাটা পড়েছিল। গত বছরের তুলনায় এবারের সেলে বেজায় খুশি ব্যবসায়ীরাও। হাতি বাগানের একটি শাড়ির দোকানের মালিকের কথায়, পেট্রোল ডিজেলের দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দাম কিছুটা চড়েছে। তবে ক্রেতাদের ভিড় যথেষ্টই চোখে পড়ছে। সন্ধ্যা নামতেই গোটা রাস্তায় কার্যত জনজোয়ার। অন্য এক দোকানি বিকাশ বর্মণের কথায়, ভিড় হচ্ছে এটা ঠিক কিন্তু সেভাবে ভিড় অনুপাতে বেচা কেনা হচ্ছে না। তাঁর কথায়, “হয়ত পরিবারের একজন একটা শাড়ি বা জামা নেবেন তার সঙ্গে ভিড় করে আছেন আরও দু-পাঁচ জন।”