ছেলেবেলার দুর্গাপূজার কিছু স্মৃতি

মেদিনীপুর জেলার ঘাটাল মহকুমার দাসপুর থানার অন্তর্গত গোমকপোতা গ্রামে আমার জন্ম। আমাদের বাড়ির সামনেই একটি প্রাথমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে প্রতিবছর দুর্গাপূজা হয়ে আসছে। পূজার এক-দেড় মাস আগে থেকেই প্রতিমা তৈরির কাজ আরম্ভ হতো। তখন থেকেই আমার মনের মধ্যে পুজোর আনন্দ-অনুভূতি জাগত। স্কুলের পড়াশোনার ফাকে আমরা স্কুলের বন্ধুরা মিলে ঠাকুর তৈরি দেখতাম আর ভাবতাম কবে পূজার দিনটি আসবে।
তারপর দেখতে দেখতে অবশেষে সেই আনন্দের দিনটি এসে যেত। পুজোতে প্রায় একমাস স্কুল ছুটি থাকত। সেইজন্য পড়াশোনার তেমন কোনো চাপ থাকত না। পুজো প্রাঙ্গণে মনোহারি, তেলেভাজা, মিষ্টি এবং আরও অনেককিছু দোকান বসত। এককথায় বলা যায় একটি গ্রামের মেলা যেমন হয়। মা-বাবার সঙ্গে ওই পুজোর মেলাতে আসতাম। আমার মা অষ্টমী পুজোর ব্রত করতো, আমাকেও সঙ্গে করে মণ্ডপে নিয়ে আসত। আমি মায়ের কাছে বসে পুজো দেখতাম। ঢাক, কাঁসর, ঘণ্টা বাজত আর ধূপ-ধুনোতে সারা মণ্ডপ ভরে উঠত। একটা কথা আমার খুব মনে পড়ে-মা আমাকে বলত, ওই মায়ের মূর্তির দিকে দেখ, ওই মূর্তির মধ্যে সত্যিকার মা-দুর্গা এসে বিরাজ করবে। আমি তখন অধীর আগ্রহে দুর্গামায়ের মূর্তির দিকে তাকিয়ে থাকতাম। তখন মায়ের ওই কথা শুনে আমার মনে কী যে আনন্দ অনুভব হতো সেটা এখনো ভাষায় প্রকাশ করতে পারছি না। তারপর পুজো শেষ হলে মায়ের সঙ্গে বাড়ি ফিরে আসতাম।
আমাদের ওই পুজোতে সন্ধ্যার পর পর্দায় ভ্রাম্যমান বাংলা ছায়াছবি দেখানো হতো। পুজোর চারদিন একটি করে ছায়াছবি দেখানো হতো। আমাদের গ্রামের ও আশপাশের গ্রামের লোকজন ছায়াছবি দেখার জন্য আসত। দুটো করে শো-এর মাধ্যমে দেখানো হতো। প্রচুর মানুষের সমাগমে পূজো প্রাঙ্গণ ভরে উঠত। তখন আমার মনের মধ্যে আনন্দের স্রোত বয়ে যেত। এর ফাঁকে দোকানে খাবার কিনে খাওয়া এবং জিনিসপত্র কেনাকাটা চলত।
এর আগের একটা কথা মনে পড়ে—পুজোর আটদিন আগে মহালয়া। ওইদিন ভোর চারটে থেকে শুরু হতো মহালয়া।তখন তো টেলিভিশন আসেনি, রেডিওতে চণ্ডীপাঠ শোনার জন্য রাতে ঘুম আসত না, ভোরে উঠতে হবে এই ভেবে। আমার বাবা-কাকা সবাই উঠত ভোরে মহালয়া। শোনার জন্য। তাদের সঙ্গে একসঙ্গে বসে মহালয় শোনার যে আনন্দ-অনুভূতি আজও আমি ভুলতে পারিনি।
আর একটা আনন্দ ছিল পুজোতে। আমার নতুন জামা-প্যান্ট-জুতো কিনে দিত আমার দাদারা। আমরা তিন ভাই। আমি ছিলাম সবার ছোটো। দাদারা কলকাতায় চাকরি করতো। তারা কিনে দিত আমার সবকিছু। সেই নতুন জামা-প্যান্ট-জুতো পরে পুজোর মেলাতে আসতাম। সেই মেলাতে নানারকম জিনিস কিনতাম, অনেক কিছু খেতাম। অবশ্য দাদারাই আমাকে মেলা দেখার জন্য পয়সা দিত। তখন সেই আনন্দ-অনুভূতি যে আমার মনের মধ্যে কীভাবে ফুটে উঠত তা আমি বলে বেঝাতে পারব না।
এইভাবে পুজোর চারটি দিন পার হয়ে যেত। অবশেষে এসে যেত দশমীর দিনটি। তখন মেলার অনুষ্ঠান শেষে বিসর্জনের পালা। ওই কয়দিন আনন্দের পরে এসে যেতো বিষাদের ছায়া। তখন মনটা খুব ভারাক্রান্ত হয়ে উঠত। বিসর্জনের একটা ঘটনা আমার এই মুহূর্তে মনে পড়ে গেল। আমাদের বাড়ির কিছুটা দূরেই ছিল কংসাবতী নদী। ওই নদীতে প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া হতো। নৌকাতে প্রতিমাকে তুলে বেশ কিছুক্ষণ ভ্রমণ করে তারপর বিসর্জন দেওয়া হতো। সেই সময় হঠাৎ বৃষ্টি আরম্ভ হয়ে যায়। তখন এখনকার মতো পিচ দেওয়া রাস্তাঘাট ছিল না, মাটির কঁচা রাস্তা ছিল। সেই বৃষ্টিতে ভিজে কাদামাটি লেগে নতুন জামা-প্যান্ট একেবারে নাস্তানাবুদ অবস্থা। কিছু করার তো নেই কী আর করা যাবে। এই অবস্থাতেও মনের মধ্যে কোনো কষ্ট ছিল না। এতেও যেন একটা আলাদা আনন্দ-সুখ-দুঃখ সবমিলিয়ে যে অনুভূতি পেয়েছিলাম তা আজও মনের মধ্যে দাগ কাটে।
এখন আমি চাকরি সূত্রে কলকাতায় বসবাস করছি। এখানেও দুর্গাপূজা দেখছি, এখানে কত আলোর কারুকার্য, প্যান্ডেলের চাকচিক্য দেখতে পাওয়া যায়। তবুও আমার ছেলেবেলার গ্রামের দুর্গাপূজার স্মৃতি আজও মনকে আনন্দে ভরিয়ে দেয়।
শিশির কুমার গাতাইত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.