অয়নের বাড়িতে ভিড় হত ডাক্তারের চেম্বারের মতো! থানায় অভিযোগের পরও নিয়োগে দাপট কমেনি

লক্ষ লক্ষ টাকা প্রতারণার অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও, পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করেনি। এমনকি, ২০১৯ সালে যখন অয়ন শীলের নামে লিখিত অভিযোগ দায়ের হয়েছিল, তখন তিনি অন্তরালেও যাননি। বরং আগাম জামিন নিয়ে দাপিয়ে বেড়িয়েছেন উত্তর ২৪ পরগনার একের পর এক পুরসভায়। নিয়োগ দুর্নীতির মামলায় অয়ন গ্রেফতার হওয়ার পর উঠে আসছে এমনই অভিযোগ। এ-ও অভিযোগ, চাকরি না পেয়ে টাকা ফেরত চাইলেই অয়নের থেকে মিলত প্রাণনাশের হুমকি!

সূত্রের খবর, ২০১৯ সালে চুঁচূড়া থানায় অয়নের নামে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন কলকাতার বাসিন্দা এক তরুণী এবং বলাগড় ও মল্লারপুরের বাসিন্দা দুই যুবক। তার প্রেক্ষিতে ৪২০ (প্রতারণা), ৪০৬ (বিশ্বাসভঙ্গ) এবং ১২০বি (অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র) ধারায় মামলা দায়ের হয়। কিন্তু গ্রেফতার হননি অয়ন। বরং হুগলি থেকে চলে এসে থাকছিলেন কামারহাটি পুরসভার উল্টো দিকের একটি আবাসনের ফ্ল্যাটে। যেটি অয়নের ‘বান্ধবী’ শ্বেতা চক্রবর্তীর ফ্ল্যাট বলেই জানা যাচ্ছে। হুগলির পুলিশের কাছে যখন এমন মামলা রয়েছে, তখন দমদম, উত্তর ও দক্ষিণ দমদম, বরাহনগর, কামারহাটি সহ অন্য পুরসভায় দ্বিতীয় বারের নিয়োগের পরীক্ষার বন্দোবস্ত করেছেন অয়ন। প্রশ্ন হল, কত বড় প্রভাবশালী সহায় হলে অভিযোগের পরেও নতুন করে দুর্নীতির ফাঁদ কেউ পাততে পারে?

অয়নকে টাকা দিয়ে চাকরি না পাওয়া ভুক্তভোগীদের কথায়, ‘‘ওঁর মারাত্মক হম্বিতম্বি ছিল। আমাদের সামনেই ফোনে কোনও মন্ত্রী বা বড় নেতার নাম করে দাপট দেখিয়ে কথা বলতেন।” হুগলির বাড়িতেই ছিল অয়নের কার্যালয়। প্রতি দিন সকাল থেকে সেখানে ডাক্তারের চেম্বারের মতো ভিড় জমত। অয়নের সহযোগীদের কাছে নাম লিখিয়ে কাগজপত্র জমা দিয়ে অপেক্ষা করতে হত। তার পরে এক এক করে ডেকে পাঠাতেন অয়ন। কাগজপত্র খতিয়ে দেখে কোথায় কোন পদে চাকরির ব্যবস্থা করা যাবে এবং তার জন্য কত টাকা দিতে হবে তা জানানো হতবলেই অভিযোগ।

২০১৫ সালে স্কুল সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে গ্রুপ-সি-তে চাকরির জন্য দুই লক্ষ টাকা দিয়েছিলেন মানিকতলার বাসিন্দা এক তরুণী। বৃহস্পতিবার তিনি বলেন, “একটা তালিকায় আমার নাম দেখানো হয়েছিল। তার পরে আরও তিন লক্ষ দিয়েছিলাম। কিন্তু নিয়োগের ডাক আসছিল না।” ওই তরুণী আরও বলেন “এক দিন শুনলাম যাঁর মাধ্যমে প্রথমে টাকা দিয়েছি, তিনি আত্মহত্যা করেছেন। আবার, অয়নের অফিসে যে যুবক কাজ করতেন, প্রতিবাদ করায় তাঁকে বেধড়ক মারধর করা হয়েছে। এ সব শুনে আমরা চুঁচুড়া থানায় লিখিত অভিযোগ দায়ের করি।” সূত্রের খবর, ওই মামলার চার্জশিটও জমা পড়েছে। হুগলির বাসিন্দা আর এক যুবক স্কুল শিক্ষকের চাকরির জন্য ১০ লক্ষ টাকা দিয়ে প্রতারিত হয়েছিলেন। তাঁর কথায়, “জেলা পরিষদের এক সদস্যের মাধ্যমে অয়নের কাছে গিয়েছিলাম। সকাল থেকে ওঁর বাড়ির সামনে ভিড় উপচে পড়ত। অনেকেই শুনতাম পুরসভাতে চাকরির জন্যও কাগজপত্র জমা দিয়েছেন।”

জানা যাচ্ছে, অন্য পুরসভার সুপারিশেই পানিহাটি পুরসভায় প্রবেশ অয়নের। অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই স্থানীয় প্রভাবশালী এক নেতার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ হয়ে যান। অভিযোগ, ওই নেতার বাড়িতে নিয়োগের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হত। রফা হয়েছিল যত জন নিয়োগ হবে, তার ২০ শতাংশ থাকবে অয়নের হাতে। জানা যাচ্ছে, ২০১৭-তে যে সব আবেদনপত্র পুরসভায় জমা পড়েছিল, তা গাড়িতে তাঁর অফিসে পাঠানো হয়েছিল। তবে পানিহাটি পুরসভায় বোর্ড না থাকায় ওই পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের তালিকাকে অনুমোদন দেয়নি ডিএলবি। অভিযোগ, পানিহাটি পুরসভায় প্রশাসকমণ্ডলী দায়িত্বে আসার পরেই ওই প্রভাবশালী নেতা ফের নিয়োগ নিয়ে নাড়াচাড়া শুরু করলে অয়নের মাধ্যমেই ৪০ জন মজদুরের তালিকা তৈরি হয়েছিল। চেয়ারম্যান মলয় রায় বলেন, “কোনও নিয়োগই হয়নি। দুর্নীতির প্রশ্নই নেই।”

আরও অভিযোগ, অয়নের হাত ধরেই ২০১৭ সালে বরাহনগর পুরসভার বেশ কয়েক জন চেয়ারম্যান পারিষদ, কাউন্সিলরদের কারও ছেলে, নাতনি, ভাইপো, মেয়েরা ইঞ্জিনিয়ার, পুরসভার স্কুলের শিক্ষক, অ্যাসেসমেন্ট বিভাগের করণিক-সহ বিভিন্ন পদে চাকরি পেয়েছেন। কারও ভাইপো ও মেয়ে আবার চাকরি পেয়েছেন পাশের পুরসভায়। আবার রাজ্য পুরকর্মী সংগঠনের প্রভাবশালী নেতার নিকটাত্মীয়ও চাকরি পেয়েছেন ওই পুরসভায়। অভিযোগ, ২০১৭-তে অয়নের সংস্থার মাধ্যমে চাকরি পাওয়া ১৮-২০ জন দীর্ঘ দিন অনুপস্থিত থাকলেও তাঁদের বেতন হচ্ছে। চেয়ারপার্সন অপর্ণা মৌলিক বলেন, “কেউ কারও আত্মীয় হতেই পারেন। তিনি যোগ্যতা অনুযায়ী পরীক্ষা দিয়ে চাকরি পাওয়ায় অন্যায়ের কিছু নেই। আর যাঁরা মাঝেমধ্যেই অনুপস্থিত হচ্ছেন, তাঁদের শো-কজ় করা হয়েছে।”

এ দিনই কামারহাটি পুরসভায় কাজে ফের যোগ দেন শ্বেতা চক্রবর্তী। সূত্রের খবর, কোনও কোনও সময় তাঁকে মাথায় হাত দিয়ে মুখ নিচু করে বসে থাকতে দেখা গিয়েছে। চেয়ারম্যান গোপাল সাহা বলেন, “শনিবার মাঝপথেই চলে গিয়েছিলেন। তিন দিন পরে আবার কাজে যোগ দিয়েছেন।” আর শ্বেতার কথায়, “আমি অবশ্যই স্বাভাবিক জীবনযাপন করব। কেন করব না বলুন তো?”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.