পশ্চিমবঙ্গের খাল, বিল, নদী, নালা, মাঠ, ঘাট, পুকুর, দীঘি নিয়ে নানা ধরনের গল্প ও উপকথা ছড়িয়ে আছে। বর্ধমান সদরঘাটে নদী পেরিয়ে আরামবাগ রোড যে গেছে, সেই রোড ধরে ক্রোশ তিনেক দক্ষিণে গেলে পরে আমিলার দীঘি।  গাঁয়ের নাম আমিলাবাজার।  লোকমুখে আমিলা  আমলে হয়েছে। আমলের দীঘি ওই অঞ্চলে বেশ প্রসিদ্ধ একটি দীঘি। পূর্বে দীঘিটি বৃহৎ ও বৃত্তারকার ছিল। তো এই আমলের দীঘি নিয়েও একটি উপকথা এই আমারবাগ রোড ধরে বর্ধমানের দিকে চলে গেছে। যেতে যেতে প্রাচীন মানুষদের সংখ্যা কমে যাবার মতো আস্তে আস্তে মিলিয়ে গেছে। আমলে এখন শুনেছি বেশ বর্ধিষ্ণু গ্রাম । সেই সব প্রাচীন প্রবীণ মানুষদের সংখ্যা নেহাৎ হাতে গোনা। গাঁ ঘরে লোকমুখে প্রচলিত উপকথাটি লোককথায় রূপান্তরিত হয়ে গেছে। প্রাচীন মানুষ, জঙ্গল, খাল ,বিল, নদী, পুকুর কমে আসার সঙ্গে সঙ্গে আজকাল উপকথা, লোককথাগুলিও লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে এবং একদিন বিলুপ্ত হয়ে যাবে।

 ছোটবেলায় আমার ঠাকুমার গঙ্গাজলসই একবার আমাদের বাড়ি এসেছিলেন , ঠাকুমা সঙ্গে অনেককাল পরে দেখা করতে। আমার ঠাকুমা দশ বৎসর বয়সে বিয়ে হয়ে যখন বদরতলায় গঙ্গার ধারে শ্বশুর ঘরে আসেন তখনকার সময়ের পাতানো সই। আমি আমার মেয়েবেলায় যখন তাঁকে দেখেছি , তিনি তখন খুনখুনে বুড়ি, আমার ঠাকুমার থেকেও বুড়ি। সে সময় লোডশেডিং ছিল রোজকার সঙ্গী এবং আমার বাড়িটি ছিল বেহালা শীলপাড়া পেরিয়ে জঙ্গলে। গরমে সন্ধ্যায় লোডশেডিং হলে উঠোনে কি ছাদে হ্যারিকেন বা লম্পের আলোয় পড়তে হত অথবা কাকা আবৃত্তি শেখাতেন। নিতান্তই বেশি রাতে ঠাকুমা বা পিসিদের মাঝে ছাদে শুয়ে তারকা খচিত আঁধার রাতে ভূতে গল্প, রূপকথা, উপকথা , লোককথা বা ঠাকুমা পিসি বাবাকাকার ছোট বেলার গল্প। তো এমনই এক গ্রীষ্মের ছুটির রাতে ছাদে বসে বসে সেই খুনখুনে বুড়ির কাছে আমলের দীঘি নিয়ে গল্প শুনে ছিলাম। তোমরা শুনবে সেই গল্প? 

যে সময়ের গল্প, সেসময় রাঢ়অঞ্চলের বহুলাংশ ছিল দুর্গম বনবেষ্টিত। দিনেমানেও লোকজন আসতে ভয় পেত। কলকাতার চৌরঙ্গী এসপ্লেনেড , পার্কস্ট্রিট ইত্যাদি ডাকসাইটে এলাকা তখন কোথায়? সেসব তখন গভীর অরণ্য! সেই অরণ্য সেই যে শুরু ছিল, তার বিস্তার আমলে, সেহারা, মোগলমারী, বুলচাঁদ , একলক্ষ্মী , আরামবাগ, গরমান্দারণ ছাড়িয়ে সেই অরণ্য ক্রমে মহারণ্যে পরিণত হয়েছিল। অরণ্যের সঙ্গে সঙ্গে এসব জায়গায় খালবিল, পুকুর , দীঘির সংখ্যাও ছিল সমান ভাবে। তেমনি একটি দীঘি হল আমলের দীঘি। 

একবার কোথা থেকে এক ফকির এসে হাজির হল আমলেতে। আমলের দীঘির পাশে জমি দখল করে পীরের থান হিসাবে আস্তানা দিল।

বসন্তের শেষ দিকে কোনো এক পূর্ণিমা রাত্রে সেই ডেরায় শুয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করছে। রাত্রি তখন প্রায় এক প্রহর। আকাশে চাঁদ গোল রূপোর থালার মতো হয়ে বসন্ত রাত্রি চন্দ্রমালোকিত করে তুলেছে।  চন্দ্রলোকের প্রতিফলিত আলোরশ্মি দীঘির কালোজলে পড়ে কম্পিত হয়ে উঠছে। দূরে কোথাও একটা কোকিল আর চোখগেল পাখি ডাকছে। আমলের দীঘি ঘিরে আমের মুকুল, পলাশ, কাঞ্চন, কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া ফুলেরা যেন আমোদ জুড়েছে। হঠাৎ ফকির দেখল চন্দ্রালোকিত দীঘির জলে ছোট ছোট ঢেউ উঠল, আর একটি সোনার ষাঁড় সোম জ্যোতিকে ম্লান করে দিয়ে চারিদিক আপন আলোয় আলোকিত করে উঠে এল দীঘি গর্ভ থেকে। 

ঝড়ে কাক মরা দেখলেও ফকির তো এমন অলৌকিক ঘটনা কোনোদিন দেখে নি আগে। তার সারা গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। ফকির বিস্মিত চোখে স্বর্ণষন্ডটিকে দেখতে লাগলেন। এদিকে ষন্ডটি দীঘি থেকে উঠে এসে ঘাটের চারিদিক বিচরণ করতে লাগল। সারারাত্রিব্যাপী সোনার বরণ ষাঁড় আমলের জঙ্গলে ঘুরে , ঘাস পাতা খেয়ে ঠিক চার প্রহরের পরে আবার দীঘির জলে ডুবে গেল। 

এসব অলৌকিক ব্যাপার দেখে ফকিরের আর ঘুম হল না।  আশ্চর্য , বিস্মিত ফকির হতভম্ব হয়ে বসে রইল। সব কিছু যেন মনে হল জাগ্রত অবস্থায় স্বপ্নের মতো। 

পরের রাত্রিতেও ফকির পুনরায় অপেক্ষা করতে লাগল বিগত রাত্রের ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয় না কিনা দেখার জন্য। প্রতিপদের আকাশে চন্দ্রদেব আপন মহিমায় বিরাজ করছেন। তাঁর আলোকে আমলের দীঘি ও জঙ্গল জোৎস্ন স্নান করছে। আবার রাত্রি এক প্রহর, ষন্ড পুনরায় দীঘির গর্ভ হতে উঠে এলো। মনের আনন্দে আমলের ঘাট, অরণ্য আলোকিত করে বিচরণ করতে লাগল।

ফকির অবাক হয়ে অপলক দৃষ্টিতে দেখতে লাগল। 

এভাবে প্রত্যহ রাত্রি একপ্রহরে সেই সোনার ষন্ড আমলের দীঘির কালো জলের গর্ভ থেকে উঠে বিচরণ করত। এমন ভাবে সেই ষন্ড বিচরণ করত , যেন আমলের দীঘি, ঘাট, বনভূমি কেবল ও কেবলমাত্র তার রাজত্ব। সেখানে কারও প্রবেশের অধিকার নেই। প্রতি রাত্রের চতুর্থ প্রহর অতিক্রান্ত হলে পুনরায় দীঘির জলে নিমজ্জিত হয়। 

এদিকে আমলের দীঘির জমিতে থান বেঁধে বসা সেই ফকির দিনে ঘুমিয়ে রাত্রি জেগে থাকতে লাগল কেবলমাত্র সোনার ষাঁড়কে প্রত্যক্ষ করার জন্য। ক্রমে ক্রমে তার মনে লোভের সৃষ্টি হল। দিবারাত্রি তার কেবলমাত্র এক চিন্তা হল , “কি করে ওই সোনার ষাঁড়কে লাভ করা যায়? একবার যদি লাভ করা যায় , তবে কি আর ফকির জীবন , কি বা মুর্শিদের আদেশ ? ওই সোনার ষাঁড় বিক্রি করব। আমলের জমি আমার দখলে হবে! আমিই হব তখন অতুল সম্পদের মালিক এবং আমলের কর্তা।” 

কিন্তু দৈব বস্তু লাভ করব বললেই কি লাভ করা সম্ভব? সেই সোনার ষন্ডকে ধরা কি এতই সহজ? 

তখন ফকির কি করল? দৈব বস্তুকে কি আদৌ লাভ করতে পারল? 

লোককথার পরের অংশ আগামী পর্বে ….

©দুর্গেশনন্দিনী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.