#পর্ব_৫
আজ রণ-রঙ্গিণী জগৎমাতার দেখ্ মহারণ,
দশদিকে তাঁর দশ হাতে বাজে দশ প্রহরণ!
পদতলে লুটে মহিষাসুর, মহামাতা ঐ সিংস-বাহিনী জানায় আজিকে বিশ্ববাসীকে–
শাশ্বত নহে দানব-শক্তি, পায়ে পিষে যায় শির পশুর!
'নাই দানব নাই অসুর,– চাইনে সুর, চাই মানব!'–
বরাভয়-বাণী ঐ রে কার শুনি, নহে হৈ রৈ এবার!
ওঠ্ রে ওঠ্, ছোট্ রে ছোট্! শান্ত মন, ক্ষান্ত রণ!–
খোল্ তোরণ, চল্ বরণ করব্ মা'য়; ডর্ব কায়?
ধরব পা'য় কার্ সে আর, বিশ্ব-মা'ই পার্শ্বে যার.....
ক্ষমতাবান রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বগন তাঁদের প্রিয় মানুষজন দিয়ে সদয় ইতিহাসকে পরিবর্তন করেছেন। ফলে প্রকৃত সামাজিক বিবর্তনের ইতিহাসকে উদঘাটন করতে গিয়ে হিমশিম অবস্থায় পড়তে হয়। কিন্তু আমরা যাঁরা ক্ষমতাহীন মানে আম জনতা মানে ম্যাংগো পিপিল তাঁরা ঐতিহ্য অনুসরণ করতেই। ভালোবাসি। সেগুলি বিভিন্ন ক্ষেত্রে দেখা দেয় নানা আচার, নিয়ম ,রীতি পালন হিসাবে। জংলাকীর্ন পাহাড়িয়া, বাগদি, মাল , ঢিকারো ইত্যাদি জনজাতি অধ্যুষিত অঞ্চলে বীর রাজা তাঁর রাজ্য পাট গড়ে তুলেছিলেন। তাই একটা সময়ের পর সব নিয়ম , আচার, কানুন মিলে মিশে এক হয়ে গেছে।
ধর্মমঙ্গলকে রাঢ় অঞ্চলের জাতীয় মহাকাব্য বলা হয়। সেখানে লাউসেনের পাশে আমরা পাই কালু ডোমকে। একটা সময় কিন্তু যুদ্ধ , মাতৃভূমি রক্ষা ইত্যাদি বহুক্ষেত্রে জনজাতিগন অগ্রনী ভূমিকা পালন করেছিলেন। সেই যে একটা ছড়া আছে, আমরা ছোট থেকে বলি-
আগডুম বাগডুম ঘোড়াডুম সাজে।
লাল মিরগেল ঘাঘর বাজে॥
বাজতে বাজতে এল ডুলি।
ডুলি গেল সেই কমলাপুলি॥
কমলাপুলির বিয়েটা।
সূয্যিমামার টিয়েটা॥
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ বলেছেন , “আগডুম বাগডুম ঘোড়াডুম সাজে’–এই ছত্রটির কোনো পরিষ্কার অর্থ আছে কি না জানি না; অথবা যদি ইহা অন্য কোনো ছত্রের অপভ্রংশ হয় তবে সে ছত্রটি কী ছিল তাহাও অনুমান করা সহজ নহে। কিন্তু ইহা স্পষ্ট দেখা যাইতেছে, প্রথম কয়েক ছত্র বিবাহযাত্রার বর্ণনা। দ্বিতীয় ছত্রে যে বাজনা কয়েকটির উল্লেখ আছে, তাহা ভিন্ন ভিন্ন পাঠে কতই বিকৃত হইয়াছে। আবার ভিন্ন স্থান হইতে আমরা এই ছড়ার আর-একটি পাঠ প্রাপ্ত হইয়াছি, তাহাতে আছে–আগ্ডম বাগ্ডম ঘোড়াডম সাজে।
ডান মেকড়া ঘাঘর বাজে॥
বাজতে বাজতে পড়ল টুরি।
টুরি গেল কমলাপুরি॥
ভাষার যে ক্রমশ কিরূপে রূপান্তর হইতে থাকে, এই-সকল ছড়া হইতে তাহার প্রত্যক্ষ দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়।”
যাহোক , তাই বীর রাজা যখন তাঁর রাজ্যে দুর্গা পূজা শুরু করলেন তখন তার সঙ্গে স্থানীয় বহু নিয়ম, সংস্কৃতি যুক্ত হল। তবে এটাই সব নয়। দুর্গা পূজা, শক্তি উপাসনা, প্রকৃতির আরাধনা তার শিকড় যে মাটির অনেক গভীরে অবস্থান করে।
সময়ের বিবর্তনে ঘটে চলা নানা পরিবর্তন সামাজিক ও লৌকিক নানা রীতি নীতির বদল ঘটায় মাত্র। বীরভূমের মাটিতে ঘটে চলা একের পর এক ঘটনা কখন কিভাবে কেমন পরিবর্তন এনেছিল তার কোনো প্রমাণ সংগ্রহ করা একপ্রকার অসম্ভব। বীরসিংহের প্রতিষ্ঠা- জনজাতির আধিক্য- উড়িষ্যার রাজবংশের রাজত্ব – বৌদ্ধ এবং জৈন মতের প্রবেশ – সনাতনী তন্ত্রের সঙ্গে বৌদ্ধ বজ্রযানের এক হয়ে যাওয়া – জঙ্গল ময় রুক্ষ অঞ্চলে তান্ত্রিক সাধনা- পাঠানদের দীর্ঘ শাসন- সহজিয়া মতের প্রবেশ – শ্রী চৈতন্যদেব- নিত্যানন্দের প্রভাব – কালাপাহাড়ের আক্রমন – তন্ত্র সাধক বিরূপাক্ষের যন্ত্র পূজার প্রভাব – জেলার দারিদ্র – শাক্ত বৈষ্ণব মতের সহাবস্থান – সাঁওতাল বিদ্রোহ – ইংরেজ শাসন – দুর্ভিক্ষ ইত্যাদি বিষয়গুলি বিভিন্ন সময় , বিচিত্র সময় কাল ধরে ঘটে চলা এক একটি অভিঘাত মাত্র। এর মধ্যে কোনটি ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছে এবং কোনটি করে নি তা নির্নয় করা বেশ কঠিন।
পূর্বেই বলেছি ডক্টর আদিত্য মুখপাধ্যায় মহাশয় বীরভূমে পটের দুর্গা পূজা প্রচলনের জন্য আর্থিক কারনকেই অধিক দায়ী করেছেন। কিন্তু পটের পুজার প্রধান পরিবার গুলিকে দেখলে এটা মনে হতেই পারে যে মাত্র কয়েক টাকার জন্য প্রতিমা কি একেবারেই অসম্ভব ছিল? মহোদরী গ্রামের সেন পরিবার বা গনপুরের চৌধুরী পরিবার যথেষ্ট অবস্থাপন্ন। হঠাৎ পাওয়া বিত্তে সংগতি সম্পন্ন হয়ে এনারা পূজা শুরু করেন। হেতমপুরের মুন্সীবাড়িও তাই।কংসনারায়নের পরিবারও যথেষ্ট অবস্থা সম্পন্ন। তাহলে?
খটঙ্গা গ্রামে বীর রাজার পরিবারের মতোই অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায় পরিবারে কুলদেবতা হিসাবে রয়েছেন অন্য কোনো বিগ্রহ বা সিংহবাহিনী মূর্তি।পরিবারের অন্য বিগ্রহ থাকা- পটের পূজার একটি কারণ অবশ্যই সে কথা আমি পূর্বে বলেছি। তবে এ কারনই একমাত্র কারন নয়। যেমন- সিউড়ির নিকটস্থ সিঙ্গুর মল্লিকপুরের চট্টোপাধ্যায় পরিবারের দুর্গার কাহিনী অন্য রকম ….
এই সিঙ্গুর গ্রামেই রয়েছে তন্ত্র সাধক বিরূপাক্ষের পাট । সিঙ্গুর গ্রামের পট দুর্গার পূজার সঙ্গে জড়িত রয়েছে সাধক বিরূপাক্ষ গোস্বামীর নাম। বিরূপাক্ষ গোস্বামী তন্ত্রমতে মহাসাধক ছিলেন। এনারই পুত্র হলেন প্রবাদ প্রতিম কবি ও সত্যনারায়ণের পাঁচালি লেখক রামভদ্র গোস্বামী। একটি প্রবাদ প্রচলিত আছে বিরূপাক্ষের নামে – #কালাপাহাড়ের_কাটা_বিরূপাক্ষের ফাটা।
বিরূপাক্ষ তপস্যান্তরে দেবীর দর্শন লাভ করেছিলেন। তাঁর সাধনার আসনটি #আদ্যাযন্ত্র নামে বিখ্যাত। তাঁর পরিবারে আজও এটির পূজা হয়। বিরূপাক্ষের আদি নিবাস ছিল কাটোয়ার নিকট বামনকান্দা গ্রাম। তৎপরে সিউড়ির দুইমাইল দক্ষিনে জামালগ্রামবাসী কোনো ব্রাহ্মণ শিষ্য কৃতক আনীত হয়ে সিঙ্গুর গ্রামে এসে বাস শুরু করেন। এখানেই কবি রামভদ্রের জন্ম হয়। সেই থেকে আজও এই গোস্বামী বংশ সিঙ্গুরে বাস করছেন। তাঁদের ভরদ্বাজ গোত্র , সমুদ্রগোলগাঞি, বর্তমান উপাধি ভট্টাচার্য।
জানা যায় পূর্বে এখানে মৃন্ময়ী মূর্তির পূজা হত। কিন্তু পরে সাধক সিদ্ধিলাভ করলে ও আদ্যাযন্ত্র প্রাপ্ত হলে পট পূজা সূচিত হয়।
বিরূপাক্ষের এই পাটবাড়ি পরবর্তীকালে তিনটি ভাগে বিভক্ত হয়।
১. বড় বাড়ি
২. ছোট বাড়ি
৩. খামার বাড়ি।
যদিও এখন খামার বাড়ি লুপ্ত। তবে পূজা হয় তিনটি। ২ টি নিয়মিত পূজা এবং একটি পূজা ৩ বছর হয় , ৩ বছর হয় না। লক্ষ্মী ঠাকরুন বাড়ির ৩ শরিক থাকেন। দুই শরিক পূজা করেন ও এক শরিক করেন না।
পট আসে সিউড়ির মালিপাড়া ।
পূজার নির্দিষ্ট পদ্ধতি রয়েছে। বংশের অন্যতম ব্যক্তি নকুড়চন্দ্র সম্পাদিত পুঁথির নিয়মানুসারে নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে পূজা হয়। কেউ পূজা নিজেরা করেন কেউ পুরোহিত দিয়ে করান।
পটপূজার পরই বিসর্জন হয় না। রাখা থাকে মন্দিরে । পরের বছর দুর্গা পূজায় বিসর্জন হয়।
বিরূপাক্ষের প্রভাব শুধুমাত্র সিঙ্গুর গ্রামে নয় , আশেপাশের অনেক গ্রামেই পড়েছিল বলে মনে করা হয়। সেই জন্যই কোমা, গাঙটে, ইন্দ্রাগাছা, তাপাইপুর ইত্যাদি সংলগ্ন গ্রামগুলিতেও কিন্তু পটের পূজাই প্রাচীনত্ব দাবি করে।
রাজনগর বৃত্তেও নাকাশ, লোকপুর, জামিরা , নওডিহা ,খটঙ্গা, চোরমুড় ,কড়িধ্যা, সিউড়ি ইত্যাদি অঞ্চলেও পটের দুর্গা পূজা প্রাচীনতম। যদিও খটঙ্গা, নওডিহা, চোরমুড় , গ্রামের পটের পূজাগুলি এক সূত্রে বাঁধা। এঁরা সবাই বীর রাজার বংশধর।বর্তমানে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হলেও পারিবারিক পটপূজার ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন।
নগরীতে অবশ্য পট পূজা নয় মৃন্ময়ী দুর্গার পূজা হয় ধুমধাম সহকারে।তবে সেটাও এক ইতিহাস। আদিতে দেখলে দেখা যায় এঁরা ছিলেন বীর রাজার বংশধরদের অন্যতম নিহাল রায়ের উত্তর পুরুষ । নিহাল রায়, নেপাল রায়, নকুল রায় প্রথমে নওডিহাতে এসে বসতি স্থাপন করেন। পরে নিহাল রায় সন্তান লাভ করার জন্য নগরী গ্রামের ঠিক বাইরে , যে স্থান এখনও লিয়ালির ঢিবি নামে পরিচিত সেখানে এসে সস্ত্রীক বাস শুরু করেন।
পরবর্তী সময়ে সন্তান লাভ করলেও তিনি নগরীতেই বসবাস স্থাপন করেন। তাঁরা ছিলেন পট পূজার সমর্থক। বংশে আছেন শালগ্রাম শীলা। তিনি ৮ মাস নওডিহা এবং ৪ মাস নগরীতে অবস্থান করেন। এখন যে মৃন্ময়ী মূর্তি পূজা হয় তা নগরীর রায় পরিবারের নয়। তাঁতী পাড়া গ্রামে চক্রবর্তী ব্রাহ্মনদের প্রবর্তিত পূজাটি তাঁরা চালাতে অসমর্থ হওয়ায় রায় পরিবার পূজাটি গ্রহণ করেন।
অদল বদল অথবা বিক্রি অথবা দিয়ে দেওয়ার উদাহরন বেশকিছু লক্ষিত হয়। আলুন্দা অঞ্চলের শিমুলিয়া গ্রামের দুর্গা পূজায় দেখা যায় মা দুর্গা চতুর্ভূজা । ময়ূরাক্ষী নদী পার হয়ে পূজায় যোগদান করতে মানুষের সমস্যা হওয়ার নিমিত্ত নদী পারের গ্রাম হতে মায়ের মূর্তির কিছু অংশ এনে পূজা সূচনা করেন।কথা হয় তোমাদের ছয় হাত থাকুক আমরা চার হাত নিচ্ছি।সেই হতে শিমুলিয়ার মায়ের মূর্তির চারিটি হাত।
ইন্দ্রাগাছার চট্টোপাধ্যায় পরিবারের পটের দুর্গা পূজার বয়স প্রায় ৩০০ থেকে ৪০০ বছর। শোনা যায় আদিতে মূর্তি পূজা হতো। কিন্তু ১০০ থেকে ১৫০ বছর আগে তাদের পারিবারিক সংগতি সংকট জনক হলে গড়ন্ত মূর্তি সহ ৬০ বিঘা সম্পত্তি পুরন্দ্রর দত্তের নিকট বিক্রি করা হয়। জনশ্রুতি আছে যে সেরাতেই বাড়ির কর্তা স্বপ্নাদেশ পান। মায়ের নির্দেশেই তালপাতা ঘেরা ঠাকুর স্থানে স্বল্প ভাবে পূজার সূচনা করেন। কিন্তু মূর্তি দত্তদের দেওয়ার জন্য তাঁরা পটের দুর্গা পূজার সূচনা করেন।
সিউড়ির পাশে আছে সাহাপুর গ্রাম। সেখানে মাতৃরূপে খুঁটি পূজা হয়। কোনো এক সঙ্কট জনক অবস্থায় মায়ের খুঁটি বা দারু নির্মিত সিংহাসনটি পূজা হতে শুরু করে।
ত্বং কালী,তারিণী,দূর্গা-ষোড়শী,ভুবনেশ্বরী,
ধুমাবতী,ত্বং বগলা,ভৈরবী ছিন্নমস্তকা,
ত্বং অন্নপূর্ণা বাগদেবী,ত্বং দেবী কমলালয়া |
সর্বশক্তি স্বরূপা ত্বং সর্বদেবময়ী তনু ||
কে জানে মা তোমার মর্ম,তুমি যোগী যোগধর্ম,
অন্তকালে শমন জ্বালা দিও না সহিতে ||
তারা তুমি কত রূপ জানো ধরিতে………….
#ক্রমশঃ
#দুর্গেশনন্দিনী
তথ্যঃ ১. পটের দুর্গা : বীরভূম
২.পট : বিমলেন্দু চক্রবর্তী