নিজের নাম প্রসঙ্গে স্বয়ং দেবী দুর্গা (শ্রীশ্রী চণ্ডীতে) বলেছেন- সেই সময় (শাকম্ভরী রূপে) আমি যখন ‘দুর্গম’ নামের মহাসুর বধ করব তখনই আমি ‘দুর্গাদেবী’ নামে খ্যাত হব।
তত্রৈব চ বধিষ্যামি দুর্গামাখ্যং মহাসুরম্।
দুর্গাদেবীতি বিখ্যাতং তন্মে নাম ভবিষ্যতি। ১১|৫০
দ্ + উ + র + গ + আ এই বর্ণগুলিকে পাওয়া যায় দুর্গা শব্দটি বিশ্লেষণ করলে। তাঁর স্বরূপের ব্যাখ্যা রয়েছে প্রতিটি বর্ণের মধ্যেই।
অর্থাৎ দ-কার দৈত্য বিনাশের, উ-কার বিঘ্ননাশের, র-কার সর্বরোগের বিনাশের, গ-কার পাপনাশের এবং আ-কার শোক দুঃখাদি জগৎ ও সর্বশত্রু বিনাশের সূচনা করে।
দৈত্যনাশার্থ বচনো দকারঃ পরিকীৰ্ত্তিতঃ
উকারো বিঘ্ননাশস্য বাচকো বেদসম্মতঃ।
রেফো রোগঘ্ন বচনোগশ্চপাপঘ্নবাচকঃ
ভবশত্রুঘ্নবচনশ্চকারঃ পরিকীৰ্ত্তিত।
আবার ব্যাকরণগত ব্যাখ্যায় তিনি—
দুঃখেন গম্যতে যা, যা দুর উপসর্গ গম্ ধাতোর স্ক্রিয়া আপ বা ঈ ইতি দুর্গা বা দুর্গি শব্দ ব্যুৎপত্তিঃ।
যাঁকে দুঃখের দ্বারা প্রাপ্ত হওয়া বা জানা যায়, তিনিই দুর্গা। এই হলো দুর্গা শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ। এখন দুর্গাশব্দ সচরাচর শোনা যায়, কিন্তু দুর্গি শব্দের প্রয়োগ কোথায় ? কিন্তু না, তাও পাওয়া যায় তৈত্তিরীয় আরণ্যকের যাজ্ঞিকা উপনিষদে দুর্গার গায়ত্রীতে ‘কাত্যায়নায় বিদ্মহে কন্যাকুমারীং ধীমহী, তন্নো দুর্গি প্রচোদয়াৎ। বেদের ভাষ্যকার সায়নাচার্যের মতে দুর্গা ও দুর্গি অভেদ।
এখন প্রশ্ন হলো এই দুর্গা কে?
আদ্যা প্রকৃতির নামই দুর্গা। শক্তি নিরাকার, কর্মদ্বারা শক্তি অভিব্যক্ত হয়। আমাদের জ্ঞানে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সেই কর্ম। অতএব দুর্গা বিশ্বরদপা। জড় ও শক্তি একই পদার্থ, এটা আধুনিক ভূতবিদ্যাবেত্তা পরীক্ষা দ্বারা প্রতিপন্ন করেছেন। কল্পনার দ্বারা অগ্নি ও এর দাহিকা শক্তি পৃথক ভাবতে পারি। কিন্তু বস্তুত পৃথক করতে পারি না।
আধ্যাত্মিক অর্থে দুর্গা বিশ্বরূপা মহাশক্তি। আধিভৌতিক অর্থে পঞ্চভূতের মধ্যে দুর্গা অগ্নিরূপা।আধিদৈবিক অর্থে দুর্গা রুদ্রদেবের শক্তি।রুদ্রদেবেরশক্তি; রুদ্রযজ্ঞীয়াগ্নি। যে অগ্নি নানারূপে খ্রিস্টপূর্ব ৪৫০০ অব্দ হতে পূজিত হয়ে আসছে।
যে প্রত্যহ প্রভাতে ‘দুর্গা দুর্গা’ এই অক্ষরদ্বয় বিশিষ্ট দুর্গানাম স্মরণ করে, সূর্যোদয়ে অন্ধকারের ন্যায় তার সকল বিপদ নষ্ট হয়।
প্রভাতে যঃ স্মরেন্নিত্যং দুর্গা দুর্গারদ্বয়ম্।
আপদস্তস্য নশ্যন্তি তমঃ সূয্যোদয়েযথা।
চঞ্চলচিত্তে অধিকক্ষণ সমাধি (সবিকল্প) স্থায়ী হয় না। ছাদ হতে যেমন নিম্ন সোপানে অবতরণ হয়, ঠিক তেমন ব্রহ্ম ভাবনা হতে সংসারে অবতরণ হয়। তখন প্রথমত বিপদ-আপদের কথা মনে আসে। বিপদ-আপদ ঘটলে তো ধর্ম-অর্থ-কাম-মোক্ষ কিছুই সিদ্ধ হয় না, সেজন্য দুর্গার স্মরণ। দুর্গা ব্রহ্মের ইচ্ছাশক্তি সেই ভগবতী সংসার অথাৎসৃষ্টির আদিকত্রী ও অধিষ্ঠাত্রী দেবী। সুতরাং প্রথমেই তাঁর স্মরণ। শাস্ত্রে দুর্গানাম স্মরণের কথা বলা হয়েছে। তাঁর রূপ তো দেখবার বা ভাববার শক্তি নাই, নাম করতে করতে এই একান্ত ভক্তির উদয় হলে তিনিই তাঁর রূপ দেখান।
বৈদিক যুগেও দেবীর এই রূপ সম্বন্ধে ইঙ্গিত পাওয়া যায়— কেনোপনিষদের ঋষির চোখে বহু পূর্বে সুরলোকে দেবাসুর সংগ্রামে গর্বিত দেবতাদের সম্মুখে ‘উমা’, ‘হৈমবতী’ রূপে তাঁর প্রথম প্রকাশ।শক্তি সচেতন বায়ু, অগ্নি প্রমুখ দেবগণব্রহ্মপুরুষের সামনে শক্তিপ্রদানে যখন ব্যর্থ, তখনইহঠাৎনীল আকাশের বুকে বিদ্যুত্বর্ণা উমার আবির্ভাব—
স তস্মিন্নেবাকাশে স্রিয়মাজগাম।
বহু শোভমানাম উমাম্ হৈমবতীম্॥
এই দেবী (বাক্ নাম্নী দেবী) ব্রহ্মকে স্বীয় আত্মারূপে অনুভব করে ঋক্ মন্ত্রে আত্মপরিচয় ঘোষণা করেন।
‘অহং রুদ্রেভিবভিশ্চরাম্যহম্…’।
দুর্গার্সপ্তশতী বা দেবীমাহাত্ম্য মূলত বেদভিত্তিক। এর তিনটি চরিত্রের প্রথমটি ঋগ্বেদস্বরূপা, মধ্যম চরিত্রটি যজুর্বেদস্বরূপা, উত্তর চরিত্রটি সামবেদ স্বরূপা।
বাল্মীকি রামায়ণে শারদীয়া দুর্গাপূজার কথা উল্লেখ না থাকলেও কৃত্তিবাস তাঁর বাংলা রামায়ণে দেবী দুর্গার আবাহনের ঘটনাটি কারণ সহ তুলে ধরেছেন। কিন্তু না, রামচন্দ্র রাবণ বধের জন্য দেবীর অকালবোধন করেন, তা কৃত্তিবাসের কপোল কল্পিত নয়। কারণ, এই ঘটনাটির পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছেন দেবীর বোধন পূজায় এই মন্ত্রটি।
‘ওঁ ঐ রাবণস্য বধার্থায়, রামস্যানুগ্রহায়চ..।
বৃহন্নারদীয় পুরাণে সেই দেবী উমা, শক্তি, লক্ষ্মী ইত্যাদি নামে উক্ত হয়েছেন— ‘উমেতি কেচিদাহুস্তাম্, শক্তি লক্ষ্মীং তথাপরে..।
ইতিহাসও দুর্গা সম্বন্ধে বাঙ্ময় ছিল। মহাভারতে একাধিকবার দুর্গা স্মরণের উল্লেখ আছে। অজ্ঞাতবাসের সাফল্যের জন্য বিরাটপর্বের ষষ্ঠ অধ্যায়ে যুধিষ্ঠির দেবী দুর্গার স্বরচিত স্তব পাঠ করেন। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের প্রারম্ভে যুদ্ধজয়ের জন্য শ্রীকৃষ্ণের নির্দেশে অর্জুন (স্বরচিত) দুর্গার স্তোত্র পাঠ করেন। বৌদ্ধধর্মের মারীচি দেবীও দশভুজা।
শ্রীমদ্ভাগবতে বলা হয়েছে, ব্রজবালারা ব্রজের অধিষ্ঠাত্রী কাত্যায়নী দুর্গার কাছে তাঁদের কাতর প্রার্থনা জানিয়েছেন, নন্দগোপসুত শ্রীকৃষ্ণকে পতিরূপে পাওয়া জন্য।
‘…নন্দগোপসুতং দেবি পতিং মে কুরুতে নমঃ।’
শ্রীশ্রীচণ্ডীতে মেধা ঋষির স্তুতিতে ইনি—
‘দেবী, আপনি সর্ব কার্য ও কারণ স্বরূপিণী, সর্বেশ্বরী, সর্বশক্তিময়ী দুর্জ্ঞেয়। সর্বস্বরূপে সর্বেশে সর্বশক্তি সমন্বিতে…’। ইনি (দেবী) সর্বজ্ঞা ও সর্বস্থিতা (She is omniscient and omnipresent)। দেবতাদের স্তুতিতে এই চিচ্ছক্তি, চেতনা বুদ্ধি-নিদ্রা-ক্ষুধা-ছায়া-শক্তি-তৃষ্ণা-ক্ষান্তি–জাতি-লজ্জা-শান্তিশ্রদ্ধা-কান্তি-লক্ষ্মী-বৃত্তি-স্মৃতি-দয়া-মাতা-তুষ্টি-ভ্রান্তিরূপে সর্বজীবে বিরাজমানা।
‘যা দেবী সর্বভূতেষু…।
বৃহন্নন্দিকেশ্বর পুরাণের মতে প্রাকৃতিক নয়টি ভেষজেব্রহ্মাণী প্রমুখ নয়টি দেবীর অবস্থান। সম্মিলিত রূপেযিনিনবপত্রিকা (কলা বউ) বাসিনী নবদুর্গারূপে খ্যাতা। আবার দেবীর ধ্যানে (জটাজুট সমাযুক্তাং..)-র একেবারে শেষভাগে বলা হয়েছে— উগ্রচণ্ডা, প্রচণ্ডা প্রমুখ অষ্টশক্তিগণে যিনি সর্বদা পরিবেষ্টিতা সেই ধর্ম-অর্থ-কাম -মোক্ষদাত্রী জগতের ধাত্রী সর্বদা চিন্তনীয়া। এই অষ্টশক্তি পরিবৃতা ভগবতী নবদুর্গারূপে প্রকাশমানা।
প্রসঙ্গত বলা যায়, বিজ্ঞানের পরিভাষায় যাকে শক্তির বিকেন্দ্রীকরণ বলে সেটিই এখানে ঘটেছে। অথাৎ দেবী দুর্গার শক্তি এই অষ্টশক্তির মধ্যে বিকেন্দ্রীকৃত।
এখন দেখা যাক তন্ত্রের দৃষ্টিতে ইনি কেমন। বিশ্বসারোদ্ধার তন্ত্রে দেবী প্রকৃত অর্থেই ত্রাণকী, এখানে বলেছে, “তুমি (দেবী) নিরাশ্রয়, দীন, তৃষ্ণার্ত, ক্ষুধার্ত, ভীত ও বদ্ধজীবের একমাত্র গতি ও নিস্তারকারিণী। মুণ্ডমালা তন্ত্রে দেবীর পরস্পরবিরোধী চরিত্র তথা রূপগুলি দেখা যায়। এখানে তিনি সাকারা আবার নিরাকারাও, অব্যক্তা আবার ব্যক্তরূপাও।
ভগবান শঙ্করই (শিব) যাঁর একমাত্র আরাধ্য দেবতা সেই শিবগত প্রাণ আচার্য শঙ্কর (শঙ্করাচার্য) তাঁর দেব্যপরাধক্ষমপণ স্তোত্র দেবীর উদ্দেশে বলছেন, “… এখনও যদি আমার প্রতি দয়া না কর হে লম্বোদর জননী। নিরাশ্রয় আমি আর কার শরণ নেব?’
‘… নিরালম্বো লম্বোদর জননি কং যামি শরণম্।’
নির্বিঘ্নে গ্রন্থসমাপ্তির জন্য মহাকবি কালিদাস এই দেবীর (তিনি। অবশ্য শিব শিবানীর) শরমাগত— ‘জগতঃ পিতরৌ বন্দে পার্বতী পরমেশ্বরেী। রঘুবংশ ১/১।
সাধক কবি রামপ্রসাদ সেন দেবীকে দেখেছিলেন বাঙ্গালি ঘরের একেবারে আটপৌরে কন্যার চোখে। তাঁর আগমনী গানে লিখলেন ‘এবার উমা এলে আর উমাকে পাঠাব না…।
একইভাবে বিদ্রোহী কবি নজরুলও গাইলেন ‘এবার নবীন। মন্ত্রে হবে, জননী তোর উদ্বোধন। নিত্যা হয়ে রইব ঘরে, হবে না। তোর বিসর্জন…’।
ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র দেশমাতৃকাতে বিশ্বমাতৃকার (দশপ্রহণধারিণী দুর্গার) রূপ আরোপ করেছেন ‘বাহুতে তুমি মা শক্তি, হৃদয়ে। তুমি মা ভক্তি। তোমারই প্রতিমা গড়ি মন্দিরে মন্দিরে। ত্বং হি দুর্গা দশপ্রহরণধারিণী। ঋষি অরবিন্দ দেশের ঘোর সঙ্কটকালে দেবীকে প্রার্থনা জানালেন কাতরভাবে ‘মাতঃ দুর্গে! স্বার্থে ভয়ে ক্ষুদ্রাশয়তায় ম্রিয়মান ভারত। আমাদের মহৎ কর, মহৎ প্রয়াসী। কর, উদারচেতাকর, সত্যসঙ্কল্প কর। আর অপ্লাশী, নিশ্চেষ্ট, অলস, ভয়ভীত যেন না হই।
গুরুদেব রবীন্দ্রনাথের ভাবনায়ও জগন্মাতা ও দেশমাতা মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছেন। তাই তাঁর কণ্ঠে ধ্বনিত হলো ‘ও আমার দেশের মাটি তোমার ‘পরে ঠেকাই মাথা। তোমাতে বিশ্বময়ী, তোমাতে বিশ্বমায়ের আঁচল পাতা…’।
আবার প্রাতঃস্মরণীয় পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের চিন্তা চেতনায় জগদম্বা, গর্ভধারিণী তথা সমগ্রমাতৃজাতির (তাঁর জাগতিক নারী কল্যাণমূলক কাজই নিদর্শন স্বরূপ) মধ্যেই অন্তর্লীনা।
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে বিদ্যাসাগর মহাশয়ই হলেন এই চিন্ময়ী শক্তির প্রকৃত সাধক। ঋষি বঙ্কিম, বিদ্যাসাগর, সাধক রামপ্রসাদ ও রবীন্দ্রনাথ প্রমুখের মাতৃবন্দনাকে বিজ্ঞানের কথায় Transformation of power বাশক্তির রূপান্তর বা রূপান্তরিত শক্তির সাধনা বলা যায়।
সংস্কৃত কবি মাঘ তাঁর ‘শিশুপাল বধ’ মহাকাব্যে নারদের স্বর্গ থেকে অবতরণের দৃশ্যটি একটি শ্লোকের মাধ্যমে অবতারণা করেন—‘চয়স্তিমিত্যবধারিতং পুরা…’। সমগ্র শ্লোকটির অর্থ— শ্রীকৃষ্ণ প্রথমে তেজপুঞ্জ’ বলে নিশ্চয় করলেন পরে আকৃতি দেখে ‘শরীরধারী’ বলে মনে করলেন তারপরে পৃথক পৃথক ভাবে মুখ হাত-পা প্রভৃতি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ শ্মশ্রু-গুম্ফ (গোঁফ-দাড়ি) দেখে পুরুষ বলে স্থির করলেন ক্রমে ওই ব্যক্তিকে ‘নারদ’ বলে জানতে পারলেন।
ঠিক একইভাবে বলা যেতে পারে, ‘দুর্গাভাবনা : বেদ থেকে বর্তমান প্রসঙ্গে, যে দেবী প্রথমে নীলবর্ণ আকাশের বুকে বিদ্যুত্বণা (তেজঃ পুঞ্জ নিজেকে প্রকট করেছিলেন মাত্র। ক্রমে ক্রমে পুরাণ তন্ত্রে যাঁর মুখ-হাত-পা (ক্রিয়াকলাপ) অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সকল প্রকাশ পেল বর্তমান কবি-সাহিত্যিক সাধকগণের লেখনিতে (ভাবনায়) তিনিই আমাদের একান্ত আপন উমারূপীকন্যা। ক্রমে তাঁর পূর্ণতা ঘটল বঙ্কিম-কলমে দেশমাতৃকারূপিণী সৃষ্টি-স্থিতি-সংহারকারিণী ‘দেবী দুর্গা।
হে ব্রহ্মস্বরূপা পরমা জ্যোতিরূপাসনাতনি দেবী ! হেমাদুর্গে! তোমার শ্রীচরণে নিখিল বিশ্বজনগণের সমবেত প্রার্থনা হোক গুরুদেবের (রবীন্দ্রনাথের) ভাষায়—
‘বরিষ ধরার মাঝে শান্তির বাণী
কেন এ হিংসাদ্বেষ? কেন এ ছদ্মবেশ? কেন এ মান-অভিমান?
বরিষ ধরা মাঝে শান্তির বারি…।’
অধ্যাপক জয়ন্ত কুশারী
2019-10-03