একাদশ শতাব্দীতে ভারতীয় গণিতের শাস্ত্রগুলির অনুবাদ পার্সিয়া হয়ে আরবে পৌঁছায় ‘হিসাব-আল-হিন্দ’ নামে অর্থাৎ হিন্দের হিসাব।হিসাব বা গণনা কোনো বিশেষ স্থানের হয় না, গণিতের নিয়মগুলো স্থান-কাল-পাত্র নিরপেক্ষ এবং শাশ্বত। তাহলে কেনো অনুবাদক ‘হিন্দ’ বিশেষ্য ব্যবহার করেছিলেন? কারণ ; এই জ্ঞানের জন্ম হয়েছে যে মাটিতে, সেই সংস্কৃতিকে চিহ্নিত করাই উদ্দেশ্য ছিল।

আলবিরুণী ভারতবর্ষের ইতিহাস ও সংস্কৃতি সম্পর্কে বিশ্বকে পরিচিত করাতে ‘হিন্দ’ শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন তার ‘তারিখ-আল-হিন্দ’ গ্ৰন্থে।

বহিরাগত আক্রমণকারী হোক বা পরিব্রাজক সবাই এই দেশকে ‘হিন্দুস্তান’ বলে বিশেষিত করেছে আর অধিবাসীদের ‘হিন্দু’ হিসেবে। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় ভারতবর্ষের রসায়ন বিজ্ঞানের ইতিহাস জানাতে গিয়ে লিখলেন ‘হিন্দু রসায়ন’ — সে শুধু ভারতবর্ষের রসায়ন বিজ্ঞানের ইতিহাস নয় , বরং বিশ্বের রসায়ন বিজ্ঞানের ইতিহাস। বিজ্ঞান, সাহিত্য, শিল্প , ভাষার ইতিহাস লিখতে গেলে প্রথম অধ্যায়েই ভারতবর্ষের নাম আসাটা অনিবার্য আর সেই জ্ঞানের জন্মদাতা সংস্কৃতি হিসেবে ‘হিন্দু’ বিশেষ্য। বিজ্ঞানের ইতিহাস আলোচনায় তাই ভারতবর্ষের প্রসঙ্গ না আসাটা অসম্ভব।
‘হিন্দু’ তাই নামবাচক শব্দ থেকে পরিণত হয়েছে ‘গুণবাচক’ শব্দে অর্থাৎ বিশেষণে। কি গুণ ?
হিন্দু অর্থে বোঝায় এমন একটি সভ্যতার সূচনাকারী জাতি যারা ‘বিজ্ঞান’ কে জীবনপদ্ধতির অংশ করেছে আর বিশ্বকে ব্যবহারিক জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে বিজ্ঞানকে স্থান দেওয়ার শিক্ষা দেওয়ার কাজ এখনো বাকি বিশ্বজননী ভারতবর্ষের।

কালপঞ্জী , আমাদের সকলের জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ। দৈনন্দিন জীবনে কালপঞ্জী ছাড়া একটি দিন যাপন কল্পনার বাইরে।আমরা বর্তমানে যে কালপঞ্জী ব্যবহার করি তাকে ‘গ্ৰেগরিয়ান ক্যালেন্ডার’ বলা হয় পোপ গ্ৰেগরির নামানুসারে। কিন্তু, এই ক্যালেন্ডারটি কি বিজ্ঞানসম্মত ? ইংরেজিতে ‘ডেকা’ শব্দের অর্থ দশ কিন্তু ‘ডিসেম্বর’ বছরের দ্বাদশতম মাস ; ইংরেজিতে ‘অক্টো’ কথার অর্থ আট কিন্তু অক্টোবর কি ইংরেজি ক্যালেন্ডারের অষ্টম মাস ?
মাসের দিনসংখ্যা কখনো ৩০ , কখনো ৩১ আবার কখনো ২৮ বা ২৯। ফেব্রুয়ারী মাস থেকে ১ দিন কেটে জুলাই মাসে দেওয়া হয়েছিল রোমান সম্রাট জুলিয়াস সিজারের আবদারে।আবার পরের মাস অগাষ্ট ৩১ করতে ফেব্রুয়ারি মাসেই কোপ মারেন অগাষ্টাস সিজার। কোথায় বিজ্ঞান ? কোথায় কোনো যুক্তিসম্মত ব্যাখ্যা। ‘দৈনন্দিন জীবনে বিজ্ঞান’ বা ‘বিজ্ঞানমনস্কতা’র কয়েক পাতা জুড়ে রচনা পড়ানোর সময় দৈনন্দিন জীবনে এতো বড় অবৈজ্ঞানিকতা ছোটো থেকে আমাদের নজর এড়িয়ে গেছে।
বিজ্ঞান খুঁজতে হলে দেখতে হবে ভারতীয় কালপঞ্জীকে। মাসের নাম বৈশাখ কেনো ? কারণ সেই মাসে পূর্ণিমার চাঁদ থাকে বিশাখা নক্ষত্রের কাছে। উৎসবের নামের উল্লেখ থেকে বোঝা যায় সেই দিনে চাঁদের দশা , যেমন– রামনবমী , গুরুপূর্ণিমা , দোলপূর্ণিমা , শিবচতুর্দশী , অরণ্যষষ্ঠী।
বছরের দিনসংখ্যা , মাসের দিনসংখ্যার সঙ্গে চন্দ্র-সূর্যের পর্যাবৃত্ত গতির গাণিতিক গণনা আছে।
একটি জাতি বৈদেশিক শক্তিকে পরাজিত করে শাসন ক্ষমতা দখল করলেই সেই জাতিকে ‘স্বতন্ত্র’ বলা যাবে না যতক্ষণ না তাঁর সমাজ তাঁর নিজের পদ্ধতিতে চলছে বা ‘স্ব’ তন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে।প্রয়োজনে বিদেশ থেকে শিক্ষা ও পদ্ধতি নেওয়া যেতেই পারে কিন্তু যুক্তি দিয়ে বিচার না করে নয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন “আমরা অনেক আচার, অনেক আসবাব য়ুরোপের কাছ থেকে নিয়েছি–সব সময়ে প্রয়োজনের খাতিরে নয়, কেবলমাত্র সেগুলো য়ুরোপীয় বলেই। য়ুরোপের কাছে আমাদের মনের এই যে পরাভব ঘটেছে অভ্যাসবশত সেজন্যে আমরা লজ্জা করতেও ভুলে গেছি।”
কালগণনা একটি জনগোষ্ঠীর ‘সভ্যতা’ হিসেবে গণ্য হওয়ার অন্যতম শর্ত।যে পুরাতন সভ্যতাগুলির ক্ষেত্রে কালগণনার কোনো ইতিহাস জানা যায়, তাদের মধ্যে এখন শুধুমাত্র ভারতবর্ষই টিকে আছে।
মায়া, ইনকা, মিশরীয় সভ্যতা এখন ইতিহাসের পাতাতেও হারিয়ে যেতে বসেছে। একটিমাত্র মত,একটিমাত্র পথ, একটিমাত্র উপাস্যের ধারণা থেকে জন্ম নেওয়া ‘Civilization’ এর ধারণা প্রাচীন সংস্কৃতির গভীরে লুকিয়ে থাকা বিজ্ঞানমনস্কতাকে বুঝতে পারে নি বা চায় নি।

প্রাচীন ভারতের সম্পদশালী হওয়ার পেছনে দুটো কারণ ছিল , এক কৃষি ও অন্য বৈদেশিক বাণিজ্য।
এই দুই ক্ষেত্রেই সফলতার জন্য একটি ভালো কালপঞ্জীর প্রয়োজন ছিল। কৃষিক্ষেত্রে বর্ষাকাল নির্ণয়ের জন্য এবং বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সমুদ্রযাত্রার উদ্দেশ্যে নেভিগেশনের জন্য। ভারতবর্ষের সমৃদ্ধশালী অতীত প্রমাণ করে যে এইদেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে এগিয়ে ছিল। কারণ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ছাড়া একটি ভালো কালপঞ্জি নির্মাণ করা সম্ভব হতো না আর ভালো কালপঞ্জি ছাড়া কৃষি ও বাণিজ্য ক্ষেত্রে সফলতা অলীক কল্পনা ছিল। যদিও পাশ্চাত্যের ঐতিহাসিকরা এই সাধারণ বুদ্ধির প্রয়োগ কোনোদিন করেননি। তাইতো তাদের লেখায় বিশ্ব ভারতবর্ষের কাছে কতটা ঋণী তা প্রকাশ পায় না।
ভারতবর্ষ অনেক বড় দেশ।তাই অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমাংশ অনুযায়ী কালপঞ্জিকা পরিবর্তন করতে হতো আর তাই ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রদেশে একাধিক কালপঞ্জিকা ছিল।
মিশর থেকে গ্ৰীস আর গ্ৰীস থেকে রোমানরা যে ক্যালেন্ডার পেয়েছিল সেই ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ইস্টারের সঠিক দিন নির্ণয়ে সমস্যা দেখা দিলে পোপ গ্ৰেগরি ক্যালেন্ডার সংশোধনে উদ্যোগী হন।

ইউরোপের বহির্বিশ্বের সঙ্গে বাণিজ্যের মাধ্যমে সমৃদ্ধশালী হওয়ার স্বপ্ন সঠিক ন্যাভিগেশন এর পদ্ধতি ছাড়া এতদিন অধরাই ছিল। ন্যাভিগেশন এর প্রথম পদক্ষেপ হলো সমুদ্রে অক্ষাংশ নির্ণয়ের পদ্ধতি জানা।
১৭০৭ সালে এক সামুদ্রিক অভিযানে ব্রিটেনের ২০০০ জন নিখোঁজ হয়ে যায়।১৭১৪ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ন্যাভিগেশন এর সঠিক পদ্ধতি আবিষ্কারের জন্য পুরস্কার ঘোষণা করে।
ভাস্কো-দা-গামা(Vasco da Gama) ও কলম্বাস(Columbus) তা জানতো না।ভাস্কো কে একজন ভারতীয় নাবিক কনক(Kanaka) সমুদ্র পথ দেখিয়ে ভারতে এনেছিলেন এবং কলম্বাস ভারতের উদ্দ্যেশ্য যাত্রা শুরু করে আমেরিকায় পৌঁছে গিয়েছিল।এই হচ্ছে সেই সময়কার ইউরোপের বিজ্ঞান এর উৎকর্ষতা!
তাই পোপ গ্ৰেগরির ক্যালেন্ডার সংশোধনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করার পেছনে অন্যতম কারণটি হলো সমুদ্রে সঠিক অক্ষাংশ নির্ণয়ের মাধ্যমে বাণিজ্যে ইউরোপকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া।
কিন্তু সেই ক্যালেন্ডার সংশোধনের জন্যেও যে গণিতের জ্ঞানের প্রয়োজন ছিল তার হদিশ ভারতবর্ষ থেকেই পেতে হয়েছিল পোপ গ্ৰেগরিকে , তার এক জেসুইট গুপ্তচর ক্লভিয়াসের মাধ্যমে।
স্বাধীনতার পর ‘স্বতন্ত্রতা’র লক্ষ্যে যাত্রা শুরু হয়েছিল কিন্তু তার গতি ছিল মন্থর।১৯৫২ সালে জ্যোতির্বিজ্ঞানী ডঃ মেঘনাদ সাহার নেতৃত্বে Calendar Reform Committee কমিটি গঠিত হয়।তার আগে ডঃ মেঘনাদ সাহা ১৯৩৯ সালে ‘Science & Culture’ পত্রিকায় “Need to Reform the Indian Calendar” শিরোনামে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন।
২২ শে মার্চ , ১৯৫৭ সালে ভারত সরকারের নির্দেশে ‘শক-সম্বত'(Saka Sambat) কে ভারতবর্ষের জাতীয় ক্যালেন্ডার হিসেবে স্বীকার করা হয় এবং যে কোনো সরকারি নির্দেশ , পার্লামেন্টের আইন এ গ্ৰেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের তারিখের সাথে শক-সম্বত এর তারিখ উল্লেখ করার আদেশ দেওয়া হয়।
ভারতবর্ষে নক্ষত্র বর্ষ(Sidereal Year) ব্যবহার করে বিভিন্ন কালপঞ্জিকার প্রচলন আছে।এর মধ্যে বিভিন্ন রাজ্যে সৌর মাসের উপর ভিত্তি করে আঞ্চলিক কালপঞ্জিকা প্রচলিত।চান্দ্র মাসের উপর ভিত্তি করে দুটি জনপ্রিয় কালপঞ্জিকা হল বিক্রম সম্বত ও শক সম্বত।
বিক্রম সম্বত এর সাল গণনা শুরু হয় উজ্জয়িনীর রাজা চন্দ্রগুপ্তের(যিনি বিক্রমাদিত্য উপাধি ধারণ করেছিলেন) সময় থেকে (৫৭ খ্রীষ্ট-পূর্বাব্দ) আর শক সম্বত এর গণনা শুরু হয় শক রাজত্বের সময় থেকে।
শকরা মধ্য এশিয়া থেকে ভারতবর্ষে প্রবেশ করেছিল এবং ভারতীয় সংস্কৃতির সঙ্গে অপরিচিত ছিল। বিক্রমাদিত্য শকদের পরাজিত করার পর ‘বিক্রম সম্বত’ কালপঞ্জী শুরু করেন। তাই ‘বিক্রমসম্বত’ পদ্ধতির সঙ্গে ভারতবর্ষের গৌরবময় ইতিহাস জড়িয়ে আছে।ভারতবর্ষের জাতীয় ক্যালেন্ডার ‘শকসম্বত’ এর প্রতি মাসের দিনসংখ্যার সঙ্গে চাঁদের দশার কোনো সম্পর্ক নেই। অর্থাৎ বর্তমানে প্রচলিত ‘শকসম্বত’ এ ভারতীয়ত্বের ছোঁয়া নেই বললেই চলে।
অন্যদিকে বিক্রম সম্বত এর প্রতি মাসের দিনসংখ্যা চাঁদের দশার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত যা ভারতবর্ষের প্রাচীন পদ্ধতি।আর বিক্রম সম্বত অনুযায়ী বছরের প্রথম দিন চৌত্র শুক্ল প্রতিপদের সঙ্গে বিক্রমাদিত্যের রাজ্যভিষেক, শ্রীরামচন্দ্রের রাজ্যভিষেক এর মত ভারতীয় ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা জড়িয়ে আছে।
তাই ‘বিক্রমসম্বত’কে ‘হিন্দু নববর্ষ’ হিসেবে পালন করার মাধ্যমে ভারতীয় সংস্কৃতির বৈজ্ঞানিক জীবনপদ্ধতি ও অপরাজেয় সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পায়।
আধুনিক বিশ্বে ‘বিজ্ঞান’কে সভ্যতার মানদণ্ড হিসেবে ধরে নিলেও শুধুমাত্র যন্ত্রনির্ভরতাকেই বিজ্ঞানমনস্কতা হিসেবে মেনে নেওয়ার কারণ নেই।
আধুনিক বিজ্ঞানের প্রয়োগে পশ্চিম বিশ্ব এগিয়ে থাকলেও জীবনপদ্ধতিতে বিজ্ঞানকে স্থান দেওয়ার ক্ষেত্রে ভারতবর্ষ এগিয়ে আর তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ কালপঞ্জি। মৌলিক বিজ্ঞানের এমন কোনো শাখা নেই যার জন্য পশ্চিম বিশ্ব ভারতবর্ষের কাছে ঋণী নয়।এখন শুধুমাত্র ইউরোপ-আমেরিকার বৈভব যদি, সবক্ষেত্রেই আমাদের পরাণুকরণে অভ্যস্ত করে তাহলে তা ভারতীয় হয়েও ‘ভারতীয়ত্ব’কে চিনবার ব্যর্থতা।
রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ চৈত্র শুক্ল প্রতিপদে ‘হিন্দু নববর্ষ’ বা ‘বর্ষ প্রতিপদ’ উৎসব পালনের মধ্য দিয়ে ভারতবর্ষের সনাতন প্রবৃত্তিকেই সদাজাগ্ৰত রাখতে চায় যা ভারতীয় হিসেবে আমাদের বিজ্ঞান সাধনা ও উৎসবের মাধ্যমে বৈজ্ঞানিক জীবনপদ্ধতিকে প্রচারিত করার প্রয়াস।

????????

পিন্টু সান্যাল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.