একজন প্রাক্তন,অপরজন বর্তমান। কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই উপাচার্যর বিরোধ মাত্রা ছাড়িয়েছে। ফলে সমস্যা দেখা দিয়েছে সেখানে। আর এতে ইন্ধন যুগিয়েছে বনধে হাজিরার ব্যাপারে সরকারি সিদ্ধান্ত রূপায়ণে উপাচার্যের কড়া ভূমিকা।
অশান্তির নেপথ্যে প্রতিষ্ঠানের প্রাক্তন উপাচার্য তথা তৃণমূল কংগ্রেসের শিক্ষক সংগঠনের এই বিশ্ববিদ্যালয় শাখার আহ্বায়ক ডঃ সজল ভট্টাচার্যকে প্রকাশ্যেই দায়ী করলেন বর্তমান উপাচার্য ডঃ সাধন চক্রবর্তী। সজলবাবু অবশ্য এই অভিযোগ ভিত্তিহীন বলে দাবি করে পাল্টা একগুচ্ছ অভিযোগ এনেছেন। সব মিলিয়ে ওই প্রতিষ্ঠানে তুমুল অশান্তি। বুধবার স্থানীয় থানায় ডায়েরি করেছেন সাধনবাবু। অন্যদিকে শেষ দেখার অঙ্গীকার করেছে বিরোধী গোষ্ঠী। দু’পক্ষই রাজ্যে শিক্ষার ঊর্দ্ধতম পর্যায়ে অভিযোগ করেছেন।
বুধবার সাধনবাবু এই প্রতিবেদককে জানান, “২০১৫ সালে কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্বর্তীকালীন উপাচার্য ছিলেন ইংরাজী বিভাগের অধ্যাপক সজল ভট্টাচার্যে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এসে তাঁর হাত থেকে উপাচার্যের দায়িত্বভার নিই। এর পর থেকেই এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পঠনপাঠন, গবেষণা ও প্রশাসন যাতে সুষ্ঠুভাবে চলে তার জন্য চব্বিশ ঘণ্টা নিরলস পরিশ্রম ক’রে চলেছি।
অনেক শিক্ষক, আধিকারিক ও শিক্ষাকর্মী এই বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নের লক্ষ্যে পৌঁছনোর জন্য সামিল হ’য়েছেন। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের উত্তরোত্তর বৃদ্ধি ঘ’টে চলেছে। কিন্তু মাঝে মধ্যেই সজলবাবু কিছু শিক্ষক, শিক্ষাকর্মী ও বহিরাগতদের নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করার চেষ্টা ক’রে থাকেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান পরিস্থিতি তার কারণেই সৃষ্টি হ’য়েছে।
যে রেজিস্ট্রারকে বরখাস্ত করা হ’য়েছে, যার বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ঢোকার অধিকার নেই। অথচ তাঁকে সঙ্গে নিয়ে সজলবাবু বিশ্ববিদ্যালয়ে তান্ডব চালাচ্ছেন। এই অধিকার উনি কী ক’রে পান? মূল বিষয় হচ্ছে তিনি শিক্ষকদের বলছেন যে শিক্ষকদের বিশ্ববিদ্যালয়ে উপস্থিতি নথিভুক্ত করার প্রয়োজন নেই। শিক্ষাকর্মী বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুপস্থিত থাকলে তাদের বেতন কাটা যাবে, কিন্তু শিক্ষক অনুপস্থিত থাকলেও তার বেতন কাটা যাবে না।
এটা কী ধরণের দাবি? ‘শিক্ষক’ হ’য়ে উনি এই অশিক্ষসুলভ দাবি করেন কী ক’রে? ওঁর কি ন্যায্যতা বোধের লেশমাত্র নেই? কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় একটি তথ্যপ্রযুক্তিসমৃদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয়। অনলাইনে উপস্থিতি নথিভুক্ত করাই বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম। সজলবাবু এবং তাঁর দ্বারা অনুপ্রাণিত কিছু শিক্ষক ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির জন্য এই নিয়ম না মানলে বিশ্ববিদ্যালয় কি তা বরদাস্ত করতে পারে?
নিয়মমাফিক প্রয়োজনীয় সমস্ত কাজ করাই এই বিশ্ববিদ্যালয়ের দস্তুর। কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে নিযুক্ত বেশিরভাগ কর্মী এভাবেই চলতে অভ্যস্ত। যাঁরা এখনও এই কর্মযজ্ঞে সামিল হ’তে পারেননি তাঁরাও শীঘ্রই সামিল হবেন এটাই কাঙ্খিত।”
উপাচার্য জানান, গত ২১ ফেব্রুয়ারি এবং মার্চ মাসের ১০ তারিখ সরকারি কর্মীদের কর্মবিরতি ছিল। ওই দিনগুলিতে কর্মীদের হাজিরা নিয়ে রাজ্য অর্থ দফতরের তরফ থেকে বিশেষ নির্দেশিকা পাঠানো হয়েছিল। তাতে বলা হয়েছিল, যে সব কর্মী এই দিনগুলিতে উপস্থিত থাকছেন না, তাঁদের বেতন কিছুটা কাটা যাবে। কিন্তু সরকারি নির্দেশনামা লঙ্ঘন করে ওইদিন অনুপস্থিত দুই কর্মীকে চুক্তির ভিত্তিতে নিযুক্ত এই রেজিস্ট্রার পুরো বেতন দিয়েছেন। এমনকী কর্মবিরতির দিন অধ্যাপকদের হাজিরা সংক্রান্ত তথ্য দেওয়া নিয়ে টালবাহানা করছেন। যার ফলে এই তথ্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানোর প্রক্রিয়া থমকে রয়েছে।
প্রশ্নের উত্তরে সাধনবাবু এই প্রতিবেদককে বুধবার জানান, শিক্ষামন্ত্রী/ শিক্ষাসচিবকে বিষয়টি জানিয়েছেন। নতুন রেজিস্ট্রার নিয়োগ সম্পর্কে জানতে চাইলে উপাচার্য বলেন, “রেজিস্ট্রার নিয়োগ বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব ব্যাপার।” এদিন এ নিয়ে কোনও বৈঠক হয়েছে কিনা প্রশ্ন করলে বলেন, “আমার জানা নেই।”
সজলবাবু এই অভিযোগ দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করে এই প্রতিবেদককে বলেন, “বর্তমান উপাচার্যের বিরুদ্ধে দুর্নীতির এবং স্বেচ্ছাচারিতার নানা অভিযোগ উঠেছে। সেগুলোর মোকাবিলা করতে না পেরে সাধনবাবু অসার যুক্তি সাজাচ্ছেন। যেমন, ১) রাজ্যের সরকারপোষিত কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের হাজিরা খাতায় সই করতে হয় না। উপাচার্য নির্দেশ দিলেই তো হবে না, শিক্ষা দফতর সার্বিকভাবে নির্দেশ দিলে তবেই সেটা কার্যকরী হবে। ২) রাত ১২ টার পর তিনি ফোনে এক সহকর্মীকে হুমকি দিয়েছেন। ৩) রেজিস্ট্রার এবং এফও (অর্থ পরামর্শদাতা) কে অন্যায় নির্দেশ দিচ্ছেন। ৪) একাধিক নির্দিষ্ট তহবিলে অনিয়ম আছে প্রভৃতি। উনি দুদিন ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসছেন না। আজ সকালে আমাকে ফোন করেছিলেন। আমি ধরিনি।”
অন্যদিকে উপাচার্যর বক্তব্য, “আমার বিরুদ্ধে দুর্নীতির যে সব অভিযোগ আনা হয়েছে সবই মিথ্যা। বরং ইংরেজি বিভাগের ওই অধ্যাপকের সঙ্গে জোট বেঁধে বিক্ষোভের নামে সুষ্ঠুভাবে সরকারি নীতি রূপায়ণের কাজে বাধা দিচ্ছেন রেজিস্ট্রার।” তাই বাধ্য হয়েই রেজিস্ট্রারকে বরখাস্তের নোটিস ধরিয়েছি।
দুই ডক্টরেট সাধন-সজলের ক্রমবর্ধমান বিরোধের নিষ্পত্তির কোনও পথ দেখছেন না বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কর্মীরা। তবে, দু’জনেরই বক্তব্য, পঠনপাঠন ও পরীক্ষা যাতে নির্বিঘ্নে হয়, তার সব রকম ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।