‘সোনা’ বলতে কী বুঝি? সোনা মানে ‘উত্তম’, সোনা মানে ‘শ্রেষ্ঠ’৷
চর্যাপদে পাচ্ছি — “সোনা ভরিতী করুণা নাবী/রূপা থোই নাহিক ধাবী।” আমার সোনায় নৌকো ভরেছে, রূপার জন্যও আর স্থান নেই।
আমরা বলি ‘সোনার ছেলে’, ‘সোনার মেয়ে’। ছড়ায় শিশু হয়ে যায় ‘সোনা’। সেরকমই সোনার মাটি, সোনার ফসল, সোনার গৌর। “হৃদ্ মাঝারে রাখবো ছেড়ে দেবো না।” তেমনই ‘সোনার দেশ’, ‘সোনার ভারত’। এক সমৃদ্ধ ভারত, জগৎ সভার এক শ্রেষ্ঠ আসন লাভ।
এই সোনার দিব্যানুভূতি বুঝতে গীতাঞ্জলির ‘কৃপণ’ কবিতার আশ্রয় নেবো —
“আমি ভিক্ষা করে ফিরতেছিলেম
গ্রামের পথে পথে,
তুমি তখন চলেছিলে
তোমার স্বর্ণরথে।
অপূর্ব এক স্বপ্ন-সম
লাগতেছিল চক্ষে মম–
কী বিচিত্র শোভা তোমার,
কী বিচিত্র সাজ।
আমি মনে ভাবতেছিলেম,
এ কোন্ মহারাজ।”
স্বর্ণরথে চলেছেন তিনি। ভাবলাম আজ আমার কী ভাগ্য! তিনি ধনধান্য ছড়িয়ে দেবেন, আর আমি কুড়িয়ে নেবো। আমাকে দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করতে হবে না। আমার কাছে এসে সেই রথ থেমে গেল। দেবতা নামলেন। ‘আমায় কিছু দাও গো’ বলে হাত বাড়িয়ে দিলেন। আমি মাথা নিচু করে রইলাম। কারণ বাংলাকে গুজরাট হতে দেবো না। বাংলাকে সমৃদ্ধ হতে দেবো না। বরং বাংলা সুভিক্ষ স্থান হোক, বাংলা ভর্তুকির আতুরঘর হোক৷
@ নরেন্দ্র, তোমার কী-বা অভাব? কোন দীনতা? অগত্যা ঝুলি থেকে ছোট এক কণা তুলে দিলাম তাঁকে। তারপর ঘরে ফিরলাম।
“যবে পাত্রখানি ঘরে এনে
উজাড় করি– এ কী!
ভিক্ষামাঝে একটি ছোটো
সোনার কণা দেখি।
দিলেম যা রাজ-ভিখারীরে
স্বর্ণ হয়ে এল ফিরে,
তখন কাঁদি চোখের জলে
দুটি নয়ন ভরে–
তোমায় কেন দিই নি আমার
সকল শূন্য করে।”
এবার ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের আবহে চিত্রকল্পটি স্মরণ করুন। এক সন্ততুল্য রাষ্ট্রনায়ক উন্নয়নের দিগ্বিজয়ের রথ নিয়ে বিশ্ব ভ্রমণ করে রাজ্যে রাজ্যে প্রবেশ করেছেন। উন্নয়নহীন ‘বিশ্ববাংলা’-য় এসে ১০০ দিনের ভিক্ষা পাওয়া বাঙালি, চালের ভিক্ষার ঝুলি ভরানো বাঙালি, পরিযায়ী শ্রমক্লিষ্ট বাঙালি চালচোরেদের দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। উন্নয়ন না করে বাংলার শাসক ভিখারী বানানোর তোড়জোড় করেছে। রাজ্যে শিক্ষা নেই, উন্নয়ন নেই, কর্মসংস্থান নেই, শিক্ষান্তে চাকরি নেই, শিল্প নেই, সংস্কৃতি নেই, ঘুষের দামে মেধার মূল্য নেই। বেকারি, বে-রোজগারের অন্ধ ভিখারিরা চারিদিকে গিজগিজ করে বেড়াচ্ছে। চোখে ‘জয় বাংলা’ হয়েছে মানুষের। আক্রান্ত চোখে সত্যকে দেখতে না পেয়ে ন্যাবা রোগ ধরেছে রাজ্যকে। ঘুষপেটি রোহিঙ্গার দল আগাছার মতো ঢুকেছে মালঞ্চে। কুসুমোদ্যানে অবৈধ অনুপ্রবেশে ছারখার বঙ্গভূমি। চারিদিকে ভয়ানক জতুগৃহ, ফতোয়ার ফন্দি। খাগড়াগড় বিস্ফোরণ, দেগঙ্গা, উস্থি, মন্দিরবাজার, কালিয়াচক, জুরানপুর, হাজিনগর, ধূলাগড়, অসংখ্য নাম। মা-বোনেদের লাঞ্ছনা। রাজ্যের মানুষ অজানার ভয়ে ভীত সন্ত্রস্ত। এমনই ভিক্ষালব্ধ ধনে প্রতিপালিত হতে বাধ্য হওয়া চারিদিকে ভিখারি-নাগরিক। বাংলার ভিখারি ভাবছে, ভর্তুকির স্বর্ণরৌপ্য মুঠো মুঠো ছড়িয়ে দেবেন গোল্ডেন চ্যারিওটের সেই দেবতা, নরেন্দ্র। ‘স্টিকার দিদি’ বাংলার নামে নিজের লেবেল বসিয়ে কাউকে কাউকে উপঢৌকন দেবেন। ভিখারি বিনা আয়েসে, খেলামেলার সরকারের দাক্ষিণ্য কুড়িয়ে নেবে বঙ্গভূমে বসেই।
কিন্তু না! সেই ঐশীরথ ভিখারির পাশে এসে থেমে গেল। সাধু নামলেন। বিশ্ববরেণ্য নেতার পদে আসীন তিনি। সাংগঠনিক শক্তির অপরূপ সৌকর্য, মনের সৌন্দর্য তাঁর মধ্যে। রাজভিখারী নরেন্দ্র এসে বাংলার বোধ হারানো, বিবেক হারানো, বিকিয়ে যাওয়া মনের কাছে ভিক্ষা চাইলেন। দেশ গড়ার ভিক্ষা, উন্নয়নের যজ্ঞ সংঘটিত করার ভিক্ষা। অন্যায় অবিচার দূর করার ভিক্ষা। অপশাসন দূর করার ভিক্ষা।
এটাই কী ভোট ভিক্ষা! যদি মনে করেন সমগ্র দেশের সঙ্গে বাংলাকেও রিকনস্ট্রাকশন করার ভিক্ষা, তবে তাই! যদি মনে করেন বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকা বাঙালি প্রজাতির দিল্লি যাত্রার শুল্ক, তবে তাই! অন্তরকে পুরোপুরি দান না করলে সোনার ভারত হবে না। সোনার বাংলাও হবে না। অন্তর উজার করে সবটুকু দিতে না পারলে দেশ সোনার হয় না। জয় বাংলার জীবাণুতে আক্রান্ত চোখ নিয়ে এই ভিক্ষার সংজ্ঞা-স্বরূপ-বৈশিষ্ট্য ধরতে পারবো না। বুঝতে পারবো না স্বর্ণবঙ্গ করে দেবার জন্যই আমার কাছে হাত পেতেছেন ভারত-সম্রাট। ২০২১-এ আমরা ভিক্ষা দিই নি। তার ফল আমরা হাতে গরম পেয়েছি। ক্ষণিকের দ্বিধায়, কুড়ি টাকার পাউচের নেশায়, ৫০০ টাকার ভিক্ষাশ্রীতে, ভোটপর্বের ডিম্ভাতে যদি আকুল হই, তবে ভুল হয়ে যাবে আমার জীবন, আমার পরবর্তী প্রজন্ম, আমার উত্তরাধিকার, আমার ঐতিহ্য, আমার লোকসংস্কৃতি।
তাই চাকরি চুরি, কয়লা চুরি, গরুচুরির রাজ্যে ২০২৪-এর লোকসভা ভোটে সমস্ত ভিক্ষাকণাগুলি অর্থাৎ আমাদের মতদানগুলি সোনা করে নেবার সুযোগ আমি হাতছাড়া করবো না। সরকার গড়তে দিল্লিগামী-শকটে আমার সাংসদ, আমার সামর্থ্য, আমার অন্তরাত্মা, আমার আকাঙ্খা, আমার শক্তি যোগদান করবে ভারত-নির্মাণে। আর এটাই হবে প্রকৃত ‘যোগদান মেলা’। রাজা নরেন্দ্র উন্নয়নের এক নাম।
কল্যাণ গৌতম।