ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের যে ছবি আমরা সচরাচর দেখি, বর্ণপরিচয়ের প্রচ্ছদে, গ্রন্থাবলীর পাতায়— বেশ গম্ভীর, বেশ রাশভারী মনে হয় মানুষটিকে। সেই মানুষটিই যে দারুণ রসিক আর ভোজন রসিক, সে কথা আমরা ক’জন জানি!

বাবার সঙ্গে বীরসিংহ গ্রাম থেকে কলকাতায় এসে ঈশ্বর উঠলেন বাবার বাসায়। বয়স তখন পাঁচ বছর। সেই বয়সেই হাতে তুলে নিলেন রান্নার ভার। বাসন মাজা, মসলা বাটা, বাজার করা। সেই বাজার করার অভ্যেসটি এমন মজ্জায় ঢুকল যে, সেটা তাঁর প্রাত্যহিকতার অঙ্গ। বাবা-মা প্রৌঢ় বয়সে কাশীবাসী হলেন, তখন তিনি মাঝে মাঝেই সেখানে গিয়ে নিজের হাতে মনের মতো থলে ভর্তি বাজার করে করতেন। যাইহোক, পাঁচ বছর বয়স থেকেই রান্না করতে করতে তিনি রান্নাটাকে একেবারে শিল্পের মতো ভালোবেসে ফেললেন, রান্নায় তাঁর হাত হয়ে  উঠল যেন একেবারে সাক্ষাৎ অন্নপূর্ণার হাত। তা, ছোটবেলায় তিনি কি রান্না করতেন?

অভাবের সংসারে রান্নায় তেমন ঝামেলা থাকত না। যেমন জুটত, তেমন খাওয়া। বেশির ভাগ দিনই অবশ্য জুটত না। যেদিন জুটত, সেদিন পটল-আলু কিনে একখানা পদ করতেন। আর মাছ জোটাতে পারলে ঝোল। প্রথম দিন ঝোল দিয়ে ভাত খেতেন। মাছ তুলে রেখে দিতেন পরের দিনের জন্য। পরের দিন ঝোলের মাছ তো টকে যেত, তাতে উনি আর এক প্রস্থ টক মিশিয়ে মাছের অম্বল বানিয়ে ফেলতেন। এমন ধারা তখন তাঁর দিন চলত। মাছ খেতে খুব ভালোবাসতেন, একবার হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর বাড়িতে ব্রাহ্মণ হয়েও কায়েত বন্ধুর পাত থেকে মাছের মুড়ো কেড়ে খেয়েছিলেন। সেই জাতজালিয়াতির যুগে এমন অনাচ্ছিষ্টি কাণ্ড নিয়ে সেকালে কী হুলুস্থূলটাই না হয়েছিল! হরপ্রসাদের তখন বছর পাঁচ বয়স।

মিষ্টি খেতে খুব ভালোবাসতেন, স্কুলের মাসিক বৃত্তির পুরো টাকাটাই মিষ্টির দোকানির ক্যাশ বাক্সে ঠাঁই পেত। আর ভালোবাসতেন বাসি লুচি খেতে। তিনি বৃদ্ধ বয়সে যখন কারমাটাড়ে সাঁওতালদের মাঝে জীবন কাটাচ্ছেন, তখন একবার হরপ্রসাদ শাস্ত্রী তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন। সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন লুচি, কলাপাতায় মুড়ে। পথ ছিল তিন দিনের। তাই লুচিও হল তেবাসি। সে লুচি দেখে বিদ্যাসাগরের ভারি আনন্দ। রোদে দিয়ে কাঁচা কলাপাতার গন্ধ ঘুচিয়ে বেশ আয়েশ করে খেয়েছিলেন সে লুচি। মানুষটা ভোজন রসিক ছিলেন বলেই বন্ধুদের নিয়ে যৌবনে ‘ভোজন সমিতি’ তৈরি করেছিলেন। সমিতির কাজ ছিল, এক একজনের বাড়িতে যেচে নেমন্তন্ন আদায় করে সাটিয়ে আহার করা। এই দৌরাত্ম্য অবশ্য বেশিদিন চালানো যায়নি, নিমন্ত্রণকারীদের উন্নাসায় ভেঙে গিয়েছিল। এবং আপদ ঘুচেছে বুঝে তাঁরা বেশ নিশ্চিন্ত হয়েছিলেন।

বিদ্যাসাগর খেতে যে ভালোবাসতেন, তাতে খাবারের কোন বাছ বিচার ছিল না। যখন তাঁর খুব নাম হয়েছে, কিছু টাকাকড়ি হয়েছে, তখনও সেই দারিদ্র্যের দিনগুলো তিনি ভুলতে পারেননি। তাই মাঝেমাঝেই তিনি নুন ভাত খেতেন। যাতে জীবনে আবার দারিদ্র্য এলে, সেই জীবনে ফিরতে কষ্ট না হয়। খেতে তিনি যেমন ভালোবাসতেন, তেমনি ভালোবাসতেন খাওয়াতে। তাঁর একটি বিশেষ শখ ছিল, একসঙ্গে অনেক রকমের আম নিজের হাতে কেটে অতিথিকে খাওয়ানো। সেই আপ্যায়ন থেকে অবশ্য বাড়ির চাকরবাকরেরাও বঞ্চিত হত না। আমের মরশুমে আম কিনতেই তাঁর বরাদ্দ থাকত মাসে পাঁচশো টাকা। সেই সময়ে পাঁচশো মানে অনেক টাকা, ভাবা যায়!

পাঁঠার মাংস খুব ভালো রান্না করতেন। দুই সাহিত্যিক ভাই বঙ্কিমচন্দ্র ও সঞ্জীবচন্দ্রকে বাড়িতে নেমন্তন্ন করে একবার পাঁঠার ঝোল, ভাত আর পাঁঠার মেটের অম্বল খাইয়েছিলেন। তাঁরা সেই উপাদেয় দুই পদ খেয়ে আঙুল চেটে আর আহাউহু করে একশা! বঙ্কিম স্বীকার করেছিলেন, বিদ্যাসাগরের হাতের পাঁঠার অম্বল একেবারে ইউনিক, অতুলনীয়! সবাই জানেন, বিদ্যাসাগর একরোখা মানুষ, খাওয়ানোর সময়ও তাঁর সেই একরোখামি এক শর্ত ছিল, তিনি নিজের হাতে যা রাঁধবেন তাই খেতে হবে, অন্য কারও রান্না করা পদ তাতে ঢুকবে না। তাঁর হাতের রান্না যাঁরা একবার খেয়েছেন, তাঁদের অবশ্য এই শর্ত মানতে অসুবিধে ছিল না। অতিথি যতক্ষণ খেতেন, বিদ্যাসাগর পাশে বসে থাকতেন, নিজের হাতে পরিবেশন করতেন, আর যিনি খাচ্ছেন তাঁর তৃপ্ত মুখ দেখে সবচেয়ে বেশি তৃপ্ত হতেন তিনি।

পার্থসারথি পাণ্ডা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.