নাগরিকপঞ্জি নিয়ে অসমবাসীদের মধ্যে আবেগ এবং আশঙ্কা স্বাভাবিক। সাংবিধানিকভাবে অসমে নাগরিকপঞ্জির কাজ ১৯৫১ সালের আদমশুমারির পরে শুরু হলেও এর বীজ বপন হয় আরও আগে। তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার আর্থিকভাবে দুর্বল অসমকে মজবুত ভিতের উপর দাঁড় করানোর প্রয়াসে, অপেক্ষাকৃত উন্নত এবং সমৃদ্ধ সিলেট জেলাকে বঙ্গপ্রদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে অসম প্রদেশে জুড়ে দেয় ১৮৭৪ সালে। এর ফলে আর্থিক ক্ষেত্রে কিছুটা গতি এলেও, জনবিন্যাসের উপর এর প্রভাব পড়ে। অসমীয়রা বাংলাভাষীদের কাছে গরিষ্ঠতা হারায়। এমনকী ব্যবসা-বাণিজ্যে পূর্ববঙ্গ এবং সিলেটের মানুষের কাছে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ে। ফলে ঈর্ষা এবং ক্ষোভ বাড়তে থাকে। তার প্রতিফলন ঘটে, ব্রিটিশ প্রতিনিধিদের কাছে অসমের প্রধানমন্ত্রী (স্বাধীনতার পূর্বে মুখ্যমন্ত্রীদের পদের নাম) গোপীনাথ বরদলইর সিলেটকে বঙ্গপ্রদেশে ফিরিয়ে দেওয়ার সুপারিশে– অসমীয়দের অস্তিত্বের সঙ্কট মোচনের উদ্দেশ্যে।
১৮৭৪ সালের পর অসমীয়দের জাত্যভিমানের উপর দ্বিতীয় আক্রমণ আসে ১৯০৫ সালে কার্জনের বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্তের মাধ্যমে অসম প্রদেশকে পূর্ববঙ্গে জুড়ে দিয়ে। পূর্ববঙ্গে অন্তর্ভুক্ত হয় ১৫টি জেলা এবং অসম বাকি জেলাগুলির সঙ্গে ওড়িশা এবং বিহারকে নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশ হয়। নবগঠিত পূর্ববঙ্গে মোট ৩ কোটি ১০ লক্ষ জনসংখ্যার ১ কোটি ৮০ লক্ষ মুসলমান সম্প্রদায়ভুক্ত অর্থাৎ মুসলমান গরিষ্ঠতা। ব্রিটিশ সরকার বঙ্গ ভাগের ঘোষিত নীতির প্রেক্ষিতে যতই প্রশাসনিক সুবিধার কথা বলুক না কেন— আসল উদ্দেশ্য ছিল devide and rule। আর সেকথা কার্জন সাহেব চেপেও রাখেননি। ঢাকায় কার্জন পরিষ্কার করে বলেন, মুসলমানদের হৃত গৌরব পুনরুদ্ধারের জন্য আলাদা প্রদেশ রচনাই তাঁর লক্ষ্য। শুধু কি তাই, নামমাত্র সুদে ঢাকার নবাব সলিমুল্লাকে ১ লক্ষ পাউন্ড ধার দেন। যে টাকা খরচ করে ১৯০৬ সালে ঢাকায় মুসলিম লিগের জন্ম হয়। তবে মুসলিম লিগ পাকিস্তান হাসিল করতে পারলেও কিন্তু বঙ্গভঙ্গ রদ ঠেকাতে পারেনি। মুসলমান নেতাদের সমর্থন পেলেও বাঙ্গালি হিন্দু এবং মধ্যবিত্তদের চাপ এবং স্বদেশীদের ব্রিটিশ দ্রব্য বর্জন এবং চরমপন্থীদের প্রতিরোধের মুখে ব্রিটিশ সরকার বাধ্য হয় ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ করতে। অসম পূর্ববঙ্গ থেকে মুক্তি পায়, তবে সঙ্গে সেই সিলেট। ওই বছরই কলিকাতা থেকে ভারতের রাজধানী দিল্লি স্থানান্তরিত হয়।
আগেই বলা হয়েছে সিলেট অসমের গলার কাঁটা। আর এই কাটা ছাড়ানোর সুযোগ এল ৭ জুলাই ১৯৪৭ সালে, স্বাধীনতার অব্যবহিত পূর্বে। সিলেটে গণভোট, উদ্দেশ্য তারা ভারতে না পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হতে চায় সেটা ঠিক করা। সিলেট ছাড়া উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশেও গণভোট হয়েছিল। কারণ ওখানের মুসলমান প্রধানমন্ত্রী পাকিস্তানে যোগ দেওয়ার বিরোধী ছিলেন। এমনকী দ্বিজাতিতত্ত্বকে তিনি ইসলাম বিরোধী। বলেছেন। দুটি ক্ষেত্রেই গণভোটের রায় যায় পাকিস্তানের পক্ষে। তবে সিলেটের ক্ষেত্রে অসমের প্রধানমন্ত্রী বরদলইর ভূমিকা রাজনৈতিক বিশ্লেষকদেরও বিমূঢ় করেছে। সিলেটকে ঘাড় থেকে নামানোর জন্য, মুসলিম লিগকে ভোটে সন্ত্রাসের সুযোগ করে দিয়েছে। এছাড়া ৮ হাজার চা শ্রমিকদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে দেওয়া হয়নি বহিরাগত এই অজুহাতে। জানা গেছে, মুসলিম লিগ ভোটে সন্ত্রাসের আশ্রয় নিতে বিহার, দিল্লি উত্তরপ্রদেশ থেকে মস্তান এনেছে। ফলে ভারত হারাল সিলেটের মতো একটি সমৃদ্ধ জেলা। এক্ষেত্রে কেউ কেউ তপশিলি নেতা যোগেন মণ্ডলের ভূমিকাও আংশিক দায়ী বলে মনে করেন।
অসমীয় মনস্তত্ত্বে বাঙ্গালি আধিপত্যের ভয় এতটাই বাসা বেঁধেছিল যে বাঙ্গালিদের ন্যায্য দাবি বাংলাভাষাকে সরকারি ভাষার মর্যাদা দিলেও, বাংলাকে দ্বিতীয় সরকারি ভাষার স্বীকৃতি পেতে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় দাঙ্গায় ৯ জন হিন্দু বাঙ্গালি এবং বরাক উপত্যকায় (শিলচরে) পুলিশের গুলিতে ১১টি তাজা প্রাণ আত্মাহুতি দিতে হয়। অথচ এই বাংলাভাষার স্বীকৃতির আন্দোলনে অসমের মসুলমান সম্প্রদায়ের কোনো ভূমিকা ছিল না তারা কোনোভাবেই হিন্দু বাঙ্গালিদের আন্দোলনের সঙ্গী হতে চাননি। এর বড়ো কারণ অসম-সহ উত্তর পূর্বের বিভিন্ন রাজ্যে বাংলাদেশের মুসলমান অনুপ্রবেশকারীরা স্থানীয়দের ভাষা সংস্কৃতি আয়ত্ত করেছে, এমনকী বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে নিজেদের তাদেরই একজন করে নিয়েছে। এক্ষেত্রে তাদের ধর্ম সাহায্য করেছে, হিন্দুদের ক্ষেত্রে তার সম্পূর্ণ বিপরীত। অসমে বাংলাদেশি মুসলমানরা মূল স্রোতে মিশে গিয়ে নিজেদের অহমীয় পরিচয় দিচ্ছে। ফলে অসমীয়দের রোষ এবং ঈর্ষা মূলত হিন্দু বাঙ্গালি কেন্দ্রিক।শিলিগুড়ি, জলপাইগুড়িতে অসম থেকে বিতাড়িত হিন্দুদের সঙ্গে কথা বললে সহজেই এর যথার্থতা জানা যাবে। অসমে বাঙ্গালি খেদাও আন্দোলন বা বাঙ্গালি বিদ্বেষের অভিমুখ কখনো মুসলমানরা ছিল না—একমাত্র ব্যতিক্রম ১৯৮৩ সালে নেলীর হত্যাকাণ্ড। সাম্প্রতিককালে সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে জাতীয়তাবাদী রাজনীতির উত্থান তথা সন্ত্রাসবাদী বিভিন্ন মুসলমান সংগঠনের ভারতের বিরদ্ধে জেহাদ, অসমের যুবশ্রেণীকে বাঙ্গালি (হিন্দু) বিরোধিতা থেকে বিরত করেছে।
২০১৮-র জুলাইয়ে প্রকাশিত NRC রিপোর্টে প্রায় ৪০ লক্ষ মানুষের নাম জায়গা না পেলেও, ২০১৯-এর ৩১ আগস্ট সে সংখ্যাটি কমে দাঁড়িয়েছে ১৯ লক্ষ ৬ হাজার। এছাড়াও রয়েছে ২ লক্ষ ৪৮ হাজার DVoters। NRC কর্তৃপক্ষ বাদ যাওয়া নাম অন্তর্ভুক্ত করার জন্য আরও ১২০ দিন সময় দিয়েছেন। কারণ বিভিন্ন মহল থেকে অভিযোগ এসেছে অনেক ভারতীয় নাগরিকের নাম বাদ পড়েছে। তাদের মধ্যে প্রায় ২ লক্ষ ভূমিপুত্রের নাম বাদ পড়েছে। বলে দাবি করেছেন অসমের প্রভাবশালী অর্থমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা। তিনি এও বলেছেন, উদ্বাস্তুদের রিফিউজি সার্টিফিকেটের মান্যতা দেওয়া হয়নি। এমনকী জনপ্রতিনিধি-সহ সেনাকর্মী এবং অনেক বিশিষ্টদের নাম বাদ পড়েছে। এ থেকে মনে হতে পারে, এন আর সি কর্তৃপক্ষের যে গুরুত্বের সঙ্গে নথিগুলি তৈরি করা উচিত ছিল সেখানে গাফিলতি ছিল। দেখতে হবে যাতে প্রকৃত ভারতীয় একজন মানুষেরও নাম বাদ না পড়ে। আর এটা নিশ্চিত করার দায়িত্ব মিঃ প্রতীক হাজেলার। সময়সীমা ধরে রিপোর্ট বের করার থেকেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ নির্ভেজাল রিপোর্ট। কারণ এটি একজন নাগরিকের কাছে। জীবন-মরণ সমস্যা। ২০১৩-তে অসমে কংগ্রেস আমলে এন আর সি প্রক্রিয়া শুরু হলেও এর অভিঘাত বর্তমান সরকারের উপর বর্তাবে। শোনা যাচ্ছে, ভুল লিগাসির (পরম্পরা) মাধ্যমে অনেক অনুপ্রবেশকারী নাম তুলেছে। তবে একথা ঠিক এন আর সি চালু হওয়ায় বহিরাগত যে মুসলমান সম্প্রদায় সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে আশঙ্কা করা হয়েছিল, তাদের প্রতিক্রিয়া কিন্তু আক্রমণাত্মক নয়। এমনকী, মুসলমানদের রাজনৈতিক সংগঠন AIUDF এবং ছাত্র সংগঠন AAMSU এই রিপোর্টে সন্তোষ ব্যক্ত করেছে।
এন আর সি থেকে নাম বাদ যাওয়া বাংলাদেশ থেকে বিতাড়িত উদ্বাস্তুদের বিষয়টি খুবই স্পর্শকাতর। কারণ বাংলাদেশের ভিটে-মাটি মুসলমান প্রভাবশালী এবং দালালদের দখলে। তাছাড়া । বাংলাদেশ সরকার স্বীকার করেন ওরা বাংলাদেশের নাগরিক। আর বাংলাদেশ থেকে মুসলমান অনুপ্রবেশের ঘটনা বাংলাদেশ একদম মানবেনা। অথচ অসমের ২৭টি জেলার মধ্যে সীমান্তের ৯টি জেলা ইতিমধ্যেই মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। ২০১৮-র জুলাইয়ের রিপোর্ট প্রকাশের পরে এক প্রতিবেদনে বলেছিলাম—বাদ পড়া নাম হয়তো ৪০ লক্ষ থেকে ৯-১০ লক্ষে দাঁড়াবে, আজকের গতি প্রকৃতি দেখে মনে হচ্ছে। আমার অনুমান সত্য হতে চলেছে। সংখ্যাটি যতই হোক, একথা ঠিক বাংলাদেশ একজন মানুষকেও ফিরিয়ে নেবেনা। সুতরাং সর্বশেষ বাছাইয়ের পরে বাদ পড়া মানুষজনকে ভোটাধিকার বঞ্চিত করে হয় অসম বা অন্য কোথাও পুনর্বাসিত করতে হবে। কেননা বিদেশিদের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করতে দেওয়া যায় না। এমনিতেই অনুপ্রবেশের কারণে জনবিন্যাস (Demographic balance) প্রভাবিত হচ্ছে। ফলে নানা ধরনের সামাজিক ও ধর্মীয় অপ্রীতিকর পরিস্থিতির উদ্ভব হচ্ছে। এর প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা অবশ্যই গ্রহণ করবে সরকার। নিদেনপক্ষে, ভবিষ্যতে অনুপ্রবেশকারীরা ভারতে ঢোকার আগে যাতে দু’বার ভাবে, তার ব্যবস্থা নিতে হবে সরকারকে।
প্রসঙ্গত, পশ্চিমবঙ্গ-সহ ভারতের অন্য রাজ্যেও এন আর সি চালু করার দাবি উঠেছে। একথা ঠিক, দেশের নানা প্রান্তে অনুপ্রবেশ একটি বড়ো সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আইন শৃঙ্খলার অবনতির পিছনে অনেক ক্ষেত্রে অনুপ্রবেশকারীরা জড়িত রয়েছে বলে বিভিন্ন তদন্তকারী সংস্থা মত প্রকাশ করেছে। এমতাবস্থায়, দেশবিরোধী শক্তিকে কিছুতেই উৎসাহিত করা যায় না। বলে অন্য রাজ্যে এন আর সি চালু করার ব্যাপারে ধীরে চলার নীতি নিলেই ভালো অসমের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নেওয়াই শ্রেয়। তাছাড়া, বাংলাদেশ বা পাকিস্তান থেকে বিতাড়িত হিন্দুদের ভারতে আশ্রয় দানের ২০১৫ সালের ৭ সেপ্টেম্বরের সরকারি ঘোষণা মোতাবেক প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী প্রতিশ্রুত নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল আইনে পরিণত হওয়ার আগে, পশ্চিমবঙ্গের মতো স্পর্শকাতর রাজ্যে এন আর সি নিয়ে বাড়াবাড়ি হিতে বিপরীত হতে পারে।
কে. এন. মণ্ডল
(লেখক ভারতীয় স্টেট ব্যাঙ্কের অবসরপ্রাপ্ত মুখ্য প্রবন্ধক)
2019-09-27