সন্ধ্যারতির প্রসাদ সাত হাজার চন্দ্রপুলি

দেখুন এ বাড়ি দেখে মনে হয় পুজো, অনুষ্ঠান মিলনক্ষেত্র ইত্যাদির জন্যেই যেন তৈরি।
নীলাঞ্জনা : হা এই বাড়ি তৈরি করেছিলেন আমার দাদা শ্বশুর স্বর্গীয় অমরেন্দ্রনাথ রায় ১৯৩২ সালে। তিনি ছিলেন ভারত সরকারের এ জি। এই যে রাস্তা রায় বাহাদুর রোড সেটি তাঁর পিতা অম্বিকাচরণের নামে। এ বিষয়ে একটু পিছিয়ে গিয়ে বলব, এই রায় পরিবার (আদিতে চট্টোপাধ্যায় মোঘল সম্রাট জাহাঙ্গিরের দ্বারা রায়চৌধুরী ও রাজা খেতাব পান)। আদিনিবাস মধ্যমগ্রাম থেকে ১৭৫৬-য় তৎকালীন গ্রামাঞ্চল বেহালায় এসে বসবাস শুরু করেন ও দুর্গাপুজোর পত্তন করেন। কালক্রমে পরিবার বড়ো হয়ে আশপাশে ছড়িয়ে পড়লেও পালা করে দুর্গোৎসবটি চলতে থাকে। অম্বিকাচরণ ছিলেন ইংরেজি ছাড়াও আরবি ও ফারসি ভাষায় পারদর্শী। তিনি ইংরেজ প্রশাসকদের অনুবাদক হিসেবে সফল হন ও রায় বাহাদুর উপাধি-সহ প্রভূত সম্মান পান।তিনি তার উপার্জিত অর্থে দুর্গাপূজা চালু রাখতে একটি অছি পরিষদ গঠন করে যান। যার বর্তমান অছি আমার স্বামী ও দেবর সুবীর ও গৌতম রায়। হ্যা, বাড়ির কথায় বলা যায় এখানে নাটমন্দির ও ঠাকুর দালানকে ঘিরে তিন দিকের যে বড়ো দালান দেখছেন সেখানে একসঙ্গে দু’সারি লোক এক সময় বসে আহার করতেন। মাঝখান দিয়ে হতো পরিবেশন।
বিশেষ কোনো বিধি নিয়ম বা রীতি?
নীলাঞ্জনা : হ্যা, মহালয়ার পরের দিন প্রতিপদ থেকে ষষ্ঠী পর্যন্ত আমাদের এখানে প্রতিদিন নারায়ণ পুজো ও চণ্ডীপাঠ হয়। বোধন ঠাকুরদালানেই হয়।নবপত্রিকা স্নান গঙ্গায় হয় না। ঠাকুরদালানেই বড়ো গামলায় জল রেখে নবপত্রিকা দাঁড় করিয়ে স্নান হয়। সেই জল কিন্তু পরিবারের যে যেখানে যায় সেখান থেকে নিয়ে আসে। সে জল সমুদ্রের হতে পারে, নদীর হতে পারে, যে কোনো তীর্থ বারি হতে পারে, যেমন ধরুন এবার আমি ‘লে’ গেলাম সেখান থেকে নিয়ে এলাম সিন্ধুনদের জল। আবার পুষ্কর গঙ্গাসাগর থেকেও আনা হয়েছে জল। সেইসংগৃহীত জলে নানা রকমের সুগন্ধি মিশিয়ে স্নান সম্পন্ন হয়। হ্যা, বাড়ির জ্যেষ্ঠ পুত্রবধূ হিসেবে এ কাজটি আমারই বরাদ্দ। পুজো হয় কালিকা পুরাণ মতে।
পুরোহিত বা কামার, কুমোর—এরাও কি দীর্ঘদিন ধরে পুজোয় যুক্ত?
নীলাঞ্জনা :হ্যা, এখন যিনি পুজো করছেন রণদেব ভট্টাচার্য তার বাবাও দীর্ঘদিন করেছেন। তার আগে বেহালা পণ্ডিত সমাজের এক আচার্য এই পুজো করতেন। ঢাকি ঢুলিরাও বংশানুক্রমিক ভাবেই পুজোয় অংশ নেয়। পুরনো যৌথ পরিবারে ছাগবলির রেওয়াজ থাকলেও এই বাড়িতে ১৯৭৬ সাল থেকে বরাবরই আনাজ বলি হয়। বলি দেওয়ার কামারও বংশানুক্রমেই নিযুক্ত। আর একটা বিষয়, দুর্গাপুজোয় সন্ধি পুজোর গুরুত্ব অসীম, সেখানে সাধারণত বিশেষ ভোগান্নের ব্যবস্থা হয়। আমাদের এখানে কিন্তু শুধু মাত্র শুকনো ভোগ দেওয়ার রীতিই দীর্ঘকাল ধরে প্রচলিত। সেই ভোগের পরিমাণ কিন্তু বিশাল। সেই পাত্রটির আকার প্রায় একটি গোরুর গাড়ির চাকার মতো। সন্ধি পুজোতেই মায়ের উদ্দেশে ছাতা, পাদুকা, শয্যার সঙ্গে একটি নতুন বেনারসি কাপড়ও উৎসর্গ করার রীতি আছে। শুকনো নৈবেদ্য থাকে। ৭ কেজি চাল, ২৮টি ডাব, নাড়ু, পাঁচ কড়াই ইত্যাদি।
আপনাদের তো প্রাচীন পরিবার পাড়াপড়শীর অংশগ্রহণ, উৎসাহ কেমন?
নীলাঞ্জনা : আমাদের পুরনো পাড়া প্রতিবেশীরা অধিকাংশই এখানে অঞ্জলি দিতে আসেন। আরতির সময়ও লোক সমাগম হয়। আগে বেহালা যখন মূলত গ্রামাঞ্চল ছিল সেই ৭০/৮০ বছর আগে সমস্ত গ্রামবাসীরাই পুজোর তিন দিন মধ্যাহ্ন ভোজ এমনকী রাতের আহারও পুজোবাড়িতে (পুরোনো) সেরে যেতেন। তবে এখন বেহালার রূপ তো পালটেছে। আগের মতো গভীর রাত অবধি খাওয়া-দাওয়া না চললেও সপ্তমী ও নবমীতে প্রধানত মধ্যাহ্নভোজে প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন, পুরনো বেহালাবাসীদের একটা বড়ো অংশ আমন্ত্রিত হন। হ্যা, দুবেলা পাত পেড়ে খাওয়ানো সম্ভব না হলেও প্রতিদিন সন্ধ্যারতির প্রসাদ হিসেবে ৭ হাজার চন্দ্রপুলি দর্শনার্থীদের মধ্যে বিতরিত হয়।
বিশেষ জনসমাগমে পূজা প্রাঙ্গণ যখন মুখরিত হয়ে ওঠে, তখন বারোয়ারি পুজোর ভিড়ের সঙ্গে ফারাক লুপ্ত হয়ে যায়। এখনকার বেহালায় আশপাশে অনেক বড়ো বড়ো ক্লাবের পুজো হয়। কিন্তু আমাদের বাড়ির ঠাকুর দেখতেও বড়ো লাইন পড়ে। ভিড় সামলাতে এজেন্সি থেকে আমাদের নিরাপত্তারক্ষী অবশ্যই রাখতে হয়। তবে খুবই আনন্দের কথা আমাদের পাড়ার পরিচিত লোকেরাও শুভার্থী হিসেবে একাজে যোগ দেন। আর একটা বিশেষত্ব হচ্ছে অনেক দর্শনার্থীই এই শ্বেতপাথরের দালানে বসে শুয়ে দীর্ঘক্ষণ জিরিয়ে নেন। বাড়ির মূল ফটক প্রায় রাত ১২টা অবধি খোলা থাকে তখনও অনেককে অনুরোধ করে বাড়ি পাঠাতে হয়। দীর্ঘদিনের পরিবারের কাজে যুক্ত কর্মীরাও ভিড় সামলান। সমগ্র দালানগুলি মূল্যবান পুরাতাত্ত্বিক জিনিসপত্রে ঠাসা থাকায় একটা সময় দরজা বন্ধ করতেই হয়। আর একটা বিষয় বলতে ভুলেই গেছি সন্ধি পুজোয় শুকনো ভোগ হলেও পুজোর তিন দিনই দেবীকে মাছ দেওয়া হয়। সেখানেও বৈচিত্র্য আছে। সপ্তমীতে পোনা ও পার্শ্বে মাছ, অষ্টমীতে চিংড়ি আর ভেটকি, নবমীতে ইলিশ মাছের আমিষ ভোগই প্রচলিত। আর দশমীতে পান্তা।
আগেকার কথা যতটা প্রাচীনাদের মুখে শুনেছেন বা আপনি যা দেখেছেন তাতে বিশেষ কোনো পরিবর্তন এসেছে?
নীলাঞ্জনা : এসেছে বইকী। যে নৈবেদ্য ঘর দেখলেন সেখানে এক সময় পরিবারের দুর সম্পর্কের আত্মীয়রাও সানন্দে সদলবলে বসে পুজোর জোগাড় করতেন। মাতিয়ে রাখতেন। এখন অনেকেই দূরে চলে গেছেন। কেউবা বিদেশে। এখানে এলে একবার ঘুরে যান। আর ওই যে বললাম চার বছর শরিকদের মধ্যে পালা করে পুজোর ব্যাপারটি তো আছেই। সেখানে অনেকে অংশগ্রহণ করেন। আর একটা জিনিস, রাতে যে অতিথি অভ্যাগত ভোজন হয় তা কিন্তু একেবারে আধুনিক রীতিতে ক্যাটারার দিয়ে করানো হয়। তবে আমাদের পরিবারের সঙ্গে যুক্ত কর্মীরা যেমন গাড়ির চালক, রান্নার ঠাকুর, নিত্যদিনের গৃহ পরিচর্যার লোকজন, হিসাবপত্র রাখার সহযোগী, গেটের প্রহরী এঁদের অনেকেই অন্য প্রদেশের। পুজোর সময় সচরাচর দেখা যায়। যে এরা নিজের পরিবারের কাছে ফিরে যান, এখানে হয় উল্টো। এঁদের গোটা পরিবার উঠে আসেন এই বাড়িতে। এখানে থেকে তারাও পুজোর আনন্দের সমান অংশীদার হয়ে ওঠেন।
প্রতিমা নিরঞ্জনের কোনো বিশেষ প্রথা?
নীলাঞ্জনা :না, সেরকম কিছু নয়। তবে আমাদের দেবী গঙ্গায় ভাসান হয় না। বাড়ির পিছনেই আমাদের নিজেদের পুষ্করণীতেই বিসর্জন দেওয়া হয়। মা সারা বছর তার অবিনশ্বর মৃন্ময়ী রূপ নিয়ে আমাদের পরিবার সংলগ্ন হয়েই থাকেন।

হঠাৎ একটানা সুরেলা ঘণ্টাধ্বনিতে বারোটা বাজল। বিশাল গ্র্যান্ডফাদার ক্লকটি বাড়ির সদর ঘরের কাছেই বেজে চলেছে। জানলাম বাড়িতে ‘সাহেব বিবি গোলাম’-এর মতো ঘড়িবাবু এসে এমন বহু প্রাচীন সব ঘড়িতে সপ্তাহান্তে দম দিয়ে যান। পাশের ঘরে তখন পুজো সংক্রান্ত কয়েকটি ছবি কম্পিউটারে স্ক্যান করা হচ্ছে। অতীত ও বর্তমান দুটি টাইম জোনের প্রতীককে সংঘাতহীন ভাবে অনায়াসে অনুসরণ করে চলাই ৪/১ রায় বাহাদুর রোডের সন্ত্রান্ত বাসিন্দাদের অসামান্য বাহাদুরি।

সুব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.