বৎসর বৎসর চলে গেল,

দিবসের শেষ সূর্য

শেষ প্রশ্ন উচ্চারিল পশ্চিম-সাগরতীরে,

নিস্তব্ধ সন্ধ্যায়–

কে তুমি…..

ইন্দ্র প্রজাপতির নির্দেশে আরও বত্রিশ বৎসর প্রজাপতি আশ্রমে কঠোর ব্রহ্মচর্য পালন করলেন। তারপর একদিন যজ্ঞ অন্তে প্রজাপতি ইন্দ্রকে ডেকে বললেন – 

 য এষ স্বপ্নে মহীয়মানশ্চরত্যেষ আত্মেতি হোবাচৈতদমৃতমভয়মেতদ্ ব্রহ্মেতি ….

অর্থাৎ, প্রজাপতি বললেন, এই যিনি স্বপ্নে পূজিত হয়ে বিচরণ করেন ইনিই আত্মা। ইনি অমর ও অভয়। ইনিই ব্রহ্ম। তুমি যখন ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখ , তখন তো তুমি নিজেকে দেখ চলে ফিরে বেড়াতে। সেই স্বপ্নে তুমিই প্রধান। তুমিই রাজা। তোমাকে ঘিরে ভালো ,মন্দ , অলৌকিক যতশত ঘটনা ঘটে। স্বপ্নে তুমি এই যাঁকে দেখ ইনিই আত্মা। ইনিই ব্রহ্ম। “

স হ শান্তহৃদয়ঃ প্রব্রাজ য হাপ্রাপ্যৈব দেবানেতদ্ভয়ং দদর্শ তদ্ যদ্যপীদং শরীরমন্ধং ভৰত্যনন্ধঃ স ভবতি যদি স্লামমশ্রামো নৈবৈষোঽস্য দোষেণ দুষ্যতি ৷৷

ইন্দ্র খুশি হয়ে পুনশ্চঃ রাজবেশে রাজ্যের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। কিন্তু বনের মধ্যে পথ। সেই পথ সর্পিল আঁকাবাঁকা হয়ে দিগন্তে মিশে গেছে। সঙ্গে রথ নেই, সারথী নেই, অশ্ব , গজ কিছুই নেই। যেতে হবে সেই ইলাবৃত্ত বর্ষ পেরিয়ে সুমেরু পর্বতের নিকট। দিকচক্রবালের দিকে তাকিয়ে দেখলেন সূর্যদেব তাঁর সিঁদুর আভা ছড়িয়ে পাটে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। ইন্দ্র দ্রুত পথ চলতে লাগলেন। তিনি এখন তাঁর সকল ঐশ্বরিক শক্তিকে ব্যবহার করতে দ্বিধাবোধ করনে। দীর্ঘ বৎসর ব্রহ্মচর্য পালনের ফলে বিলাসীতাকে তিনি ত্যাগ করেছেন। নিজেকে কেন যেন রাজা ভাবতে দ্বিধাবোধ হচ্ছে।

দ্রুত পথ চলতে চলতে তিনি একটি বাঘ দেখতে পেলেন। বাঘটি বৃদ্ধ এবং কোনো কারণে তার চোখ দুটি নেই, অন্ধ। দীর্ঘদিন হয়তো শিকার জোটেনি। শরীরটি ধুঁকছে এবং মৃত্যুর অপেক্ষা করছে। ইন্দ্র তখন প্রজাপতির বলা বাক্যগুলো ভাবতে লাগলেন। তিনি সেই অন্ধ বাঘটির দিকে তাকিয়ে আশঙ্কিত হৃদয়ে চিন্তা করলেন, ” যখন আমি জলে নিজের প্রতিবিম্ব দেখছি, সেটি অবিকল আমার ন্যায় দেখতে। আমি সুসজ্জিত হলে ছায়াও সুসজ্জিত। কিন্তু দেহ যখন তখন সেই ছায়াও অন্ধ। অন্ধ কি করে স্বপ্ন দেখবে? কিন্তু দেহ অন্ধ হলেও সেই অন্ধজন স্বপ্ন দেখেন।  সেই স্বপ্নে নানা জিনিস দেখেন তিনি। তাহলে একথা সত্য যে দেহ জনিত কোনো দোষ স্বপ্নে দৃষ্ট আত্মাকে স্পর্শ করতে পারে না। কারণ আত্মা থেকে স্বতন্ত্র। “

ন বধেনাস্য হন্যতে নাস্য স্রাম্যেণ স্রামো ঘ্নন্তি ত্বেবৈনং বিচ্ছাদয়ন্তীবাপ্রিয়বেত্তেব ভবত্যপি রোদিতীব নাহমাত্র ভোগ্যং পশ্যামীতি।।

ইন্দ্র চিন্তা করেই চললেন। পথ চলতে লাগলেন। দিগন্ত আবির রঙে রাঙিয়ে দিয়ে সূর্যদেব অস্ত গেলেন। সেই পথে সারাদিনের ব্যস্ত পাখির ঝাঁক কলরব করে বাসায় ফিরে গেল। আরণ্যক আঁধারে দাঁড়িয়ে ইন্দ্র চিন্তা করেই চললেন। যাঁদের বুদ্ধি জাগ্রত হয় তাঁদের এমনই হয়। চিন্তা, প্রশ্ন ও উত্তর অনুসন্ধান। প্রজাপতি ইন্দ্রের নিকট এমনই আশা করেছিলেন। ইন্দ্রের মনে যদি কোনো জিজ্ঞাসা উৎপন্ন না হতো তবে প্রজাপতি হতাশ হতেন। একজন প্রকৃত শিক্ষক ছাত্রের নিকট নিজের জ্ঞান ভাণ্ডার উজাড় করে দিতে চান। অবশ্য শিষ্যেরও যোগ্যতা থাকা আবশ্যক। তাকে সর্বদা সজাগ থাকতে হবে এবং গুরুকে প্রশ্ন করতে হবে। 

ইন্দ্র ভাবছিলেন , ” একথা সত্য যে স্বপ্নে দৃষ্ট আত্মা দেহ হতে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। কিন্তু স্বপ্নেও তো আমি কখনো সুখী, কখনো দুঃখী, কখনো ভয় পাই। কিন্তু প্রজাপতি বলেছেন আত্মা মুক্ত, আত্মা অভয়, আত্মার কোনো চাহিদা নেই। তাহলে দুঃখ ,ভয় কোথা থেকে আসছে?  এমন তো হওয়ার কথা নয়। আত্মারও অপূর্ণতা থাকে? এমন অপ্রিয় অভিজ্ঞতা হলে আত্মা কেমন করে মুক্ত স্বভাব হবে? নাঃ, আমি এমন উত্তর মেনে নিতে পারব না।

আরণ্যক অন্ধকারে সারারাত্রি দাঁড়িয়ে রইলেন। নিজেকে দূষতে লাগলেন ,” কেন কেন একবার আশ্রমেই আমার এই সৎ বুদ্ধি কেন উপস্থিত হল না ?” ভাবতে ভাবতে রাত্রি অতিক্রান্ত হয়ে পূর্ব দিগন্তে সূর্য রথের রক্তিম রেখা দেখা গেল।

স সমিৎপাণিঃ পুনরেয়ায় তং হ প্রজাপতিরুবাচ মঘবন্ যচ্ছান্তহৃদয়ঃ প্রাব্রাজীঃ কিমিচ্ছন্ পুণরাগম ইতি স হোবাচ তদ্ যদ্যপীদং ভগবঃ শরীরমন্ধং ভবত্যনন্ধঃ স ভবতি যদি স্রামমস্রামো নৈবৈষোহস্য  দোষণ দুষ্যতি।।

ইন্দ্র যজ্ঞের কাঠ নিয়ে পুনরায় প্রজাপতি আশ্রমে ফিরে এলেন। সমিৎপাণী প্রজাপতির যজ্ঞ স্থলে রেখে প্রজাপতিকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করলেন। প্রজাপতি পুনরায় স্মিত হেসে প্রশ্ন করলেন ” ইন্দ্র তুমি তো শান্ত চিত্তে চলে গিয়েছিলে। আবার কি মনে করে ফিরে এলে? ইন্দ্র আকুল হয়ে প্রশ্ন করলেন , ” হে ভগবান, যদি দেহ অন্ধ বা খঞ্জ হয় তবে স্বপ্নের আত্মা কিন্তু অন্ধ বা খঞ্জ হন না , অথবা দেহ জনিত কোনো দোষে তিনি দূষিত হন না। ” 

আমরা অধিকাংশ দেহকেই সব বলে মনে করি। কিন্তু বেদ ,উপনিষদ্ মতে আমি দেহমন থেকে স্বতন্ত্র। দেহ মন আমাদের সীমিত করে কিন্তু বাস্তবে আমরা অসীম। স্বরূপতঃ আমরা নিত্য, মুক্ত এবং ভয়হীন। ইন্দ্র যে একথা উপলব্ধি করতে পেরেছেন তা তা শুনে প্রজাপতি প্রসন্ন হলেন। 

ইন্দ্র প্রজাপতিকে বললেন – 

” ন বধেনাস্য হন্যতে নাস্য স্রাম্যেণ স্রামো ঘ্নন্তি ত্বৈবৈনং বিচ্ছাদয়ন্তীবাপ্রিয়বেত্তেব ভবত‍্যপি নাহমাত্র ভোগ্যং পশ্যামীত্যেবমেবৈষ মঘবন্নিতি ….

এই শরীরকে হত্যা করলে তো সে আর স্বপ্ন দেখবে না। তবে স্বপ্ন সে শরীরও নষ্ট হবে। কিন্তু শরীর যতক্ষণ জীবিত থাকে ততক্ষণ সে খোঁড়া, অন্ধ হলেও স্বপ্নে সুস্থ স্বাভাবিক থাকে। কিন্তু স্বপ্নে কেউ ভয় পান, কেউ প্রাণ বাঁচানোর জন্য দৌড়তে থাকেন, কেউ অনেক উপর থেকে পড়ে যেতে যেতে ভীষণ আতঙ্কিত হন , কেউ প্রিয় কারুর মৃতদেহ সামনে দেখে দুঃখিত হন, কেউ ভয়ঙ্কর কিছু দেখে আতঙ্কে চিৎকার করে ওঠেন, কাঁদেন। স্বপ্নে কত না জানি অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে। এরমধ্যে কোনো কিছুই শুভ দেখছি না। “

প্রজাপতি শুনে বললেন , ” ত্বেব তে ভূয়োহনুব্যাখ্যাস্যামি বসাপরাণি দ্বাত্রিংশতং বর্ষাণীতি স হাপরাণি দ্বাত্রিংশতং বর্ষাণু্্যবাস তস্মৈ হোবাচ…

ইন্দ্র তুমি সঠিক বলছ। পুনরায় আমি তোমাকে ব্রহ্মবিদ্যা ব্যাখ্যা করব। ইন্দ্র তুমি আরও বত্রিশ বৎসর আমার আশ্রমে বাস করো।”

ইন্দ্র বললেন, “আপনি বলেছিলেন , আত্মায় কোন অপূর্ণতা নেই এবং আত্মা অপরিবর্তিনীয়। আপনার বাক্য সত্য কারণ আপনি প্রজাপতি ,তাহলে আপনার দান করা জ্ঞান অনুসারে স্বপ্ন কখনো প্রকৃত আত্মা নয়। “

ঋগ্বেদ বলছেন – যদেমি প্রস্ফুরন্নিব দৃতি র্ন ধ্‌মাতো অদ্রিবঃ।

        মৃড়া সুক্ষত্র মৃড়য়॥

ক্রত্বঃ সমহ দীনতা প্রতীপং জগমা শুচে।

        মৃড়া সুক্ষত্র মৃড়য়॥

অপাং মধ্যে তস্থিবাংসং তৃষ্ণাবিদজ্জরিতারম্‌।

        মৃড়া সুক্ষত্র মৃড়য়॥

অর্থাৎ , যদি   ঝড়ের মেঘের মতো আমি ধাই

             চঞ্চল-অন্তর

তবে  দয়া কোরো হে, দয়া কোরো হে,

             দয়া কোরো ঈশ্বর।

ওহে  অপাপপুরুষ, দীনহীন আমি

             এসেছি পাপের কূলে–

প্রভু  দয়া কোরো হে, দয়া কোরো হে,

          দয়া করে লও তুলে।

আমি জলের মাঝারে বাস করি তবু

          তৃষায় শুকায়ে মরি–

প্রভু  দয়া কোরো হে, দয়া করে দাও

          হৃদয় সুধায় ভরি॥

প্রজাপতির মূল সূত্র ছিল “আত্মা অপহতপাপ্মা”  অর্থাৎ আত্মা ত্রুটিহীন। “পাপ” শব্দের অর্থ ব্যাপক। পাপ অর্থাৎ দুষ্কর্মই নয়। পাপ বলতে দুর্বলতা , রিপু দোষ, ত্রুটি বিচ্যুতি, এক কথায় যেকোনো সীমাবদ্ধতাকে বোঝায়।

কোনো বাধা নাহি মানে কোনো শক্তি হতে

আত্মা যেন দিবারাত্রি অবারিত স্রোতে

সকল উদ্যম লয়ে ধায় তোমা-পানে

সর্ব বন্ধ টুটি। সদা লেখা থাকে প্রাণে

“তুমি যা দিয়েছ মোরে অধিকারভার

তাহা কেড়ে নিতে দিলে অমান্য তোমার।’

তারপর কি হল? 

©দুর্গেশনন্দিনী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.