তৃণমূল কংগ্রেস দলটি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের একক প্রচেষ্টায় গঠিত হয়েছিল –– এমন যদি বলা হয়, তাহলে তা শতকরা একশো শতাংশ সত্যকথন হল না। তৃণমূল কংগ্রেস গঠনের পিছনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অবদান যদি সত্তর শতাংশ থাকে, মানতেই হবে অন্তত তিরিশ শতাংশ অবদান আর এক ব্যক্তির ছিল। তিনি মুকুল রায়। তৃণমূল কংগ্রেস গঠনের প্রায় দু দশক পরে মুকুল রায় এখন বিজেপিতে। শুধু বিজেপিতে বললে ভুল হবে বরং বলা ভালো এবারের লোকসভা নির্বাচনের যুদ্ধে তিনি বঙ্গ বিজেপি’র এক অন্যতম সেনাপতি। একদা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সর্বাধিক বিশ্বস্ত এই সেনাপতিটির ওপর নির্ভর করেন বিজেপি’র সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শাহ। পেশাগত কারণে দীর্ঘ প্রায় তিন দশক মুকুল রায়কে খুব কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ হয়েছে আমার। তাতে এইটুকু বুঝতে পেরেছি, মঞ্চে উঠে ভাষণ দেওয়ার বদলে অন্তরালে ঘর গুছিয়ে তোলার কাজটি অত্যন্ত সুচারুভাবে এবং সুকৌশলে করতে জানেন মুকুল। মমতার তৃণমূলে মুকুল এই কাজটি অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে করতেন। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ঘর ভেঙে তৃণমূলের সংসারের যে বাড়বাড়ন্ত –– তার মুখ্য কারিগর ছিলেন মুকুলই। অন্তরালে থেকে তাঁর এই ঘর গুছিয়ে তোলার দক্ষতা তীক্ষ্ণ রাজনৈতিক মেধাসম্পন্ন সভাপতি অমিত শাহের দৃষ্টি এড়ায়নি। ফলে মুকুলের সঙ্গে মমতার মনোমালিন্য যখন তুঙ্গে, তখন তিনি মুকুলকে টেনে নিতে দ্বিধা করেননি। একথাও মানতেই হবে, শত্রু শিবির ছত্রখান করে দিতে মুকুলের যে দক্ষতা তা আপাতত রাজ্য বিজেপি’র অন্য কোনও নেতার ভিতরে নেই। এই বিচারে বলতে গেলে মুকুল রাজ্য বিজেপিতে অদ্বিতীয়।

মুকুলকে বিজেপিতে নেওয়ার পিছনে অমিত শাহের মূল লক্ষ্য ছিল, ২০১৯–এর ভোটের আগে তৃণমূল কংগ্রেসের ঘর ভাঙানো। দীর্ঘদিন মমতার সঙ্গে ঘর করে মুকুল যখন বিজেপিতে প্রবেশ করেন, তখন তাঁর সঙ্গে সে অর্থে তৃণমূল কংগ্রেসের প্রথম কেন, দ্বিতীয়, তৃতীয় সারির কোনও নেতাও আসেননি। কিছুটা একা এবং নিঃসঙ্গ অবস্থাতেই মুকুলের বিজেপিতে প্রবেশ। এবং বলতে গেলে, বিজেপিতে প্রবেশের প্রথম দিন থেকেই মুকুলের লড়াই মূলত দুটি স্রোতের বিরুদ্ধে। একটি অবশ্যই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তাঁর তৃণমূল কংগ্রেস। এবং অপরটি, যাঁরা বিজেপিতে মুকুলের আগমনটি খোলা মনে মেনে নিতে পারেননি, এখনও পারেন না –– শুধুমাত্র অমিত শাহের ভয়ে প্রকাশ্যে মুকুল বিরোধিতা করতে পারেন না। বিজেপিতে প্রবেশের প্রথম দিন থেকেই তাই মুকুলের সামনে পরীক্ষাটি ছিল কঠিন। ঘরে এবং ঘরের বাইরে নিজেকে প্রমাণ করা। মুকুল বিজেপিতে প্রবেশের পর এমন প্রশ্নও বিজেপির অন্দরে উঠেছিল–– আদৌ কি মুকুল দল ভাঙতে পারবেন? এমন সন্দেহও কেউ কেউ প্রকাশ করে ফেলেছিলেন যে, মুকুল তৃণমূলের ট্রয়ের ঘোড়া নন তো? বিজেপিতে প্রতিষ্ঠা পেতে হলে এসবের সঠিক উত্তর যে তাঁকে দিতেই হবে তা জানতেন মুকুল।

২০১৯–এর লোকসভা নির্বাচনের নির্ঘণ্ট যখন প্রকাশ হয়ে গিয়েছে, সবাই যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছেন, তখন বলতেই হচ্ছে, মুকুল অমিত শাহদের নিরাশ করেননি। যে কাজের দায়িত্ব তাঁরা মুকুলকে দিয়েছিলেন, তা তিনি পালন করেছেন, ভবিষ্যতেও করবেন। এবং তিনি যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ট্রয়ের ঘোড়া নন– তাও তিনি নিজের কার্যকলাপেই প্রমাণ করে দিয়েছেন। তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গ ত্যাগ করে মুকুল যখন বিজেপিতে প্রবেশ করেন, তখন একান্ত আলাপচারিতায় মুকুল আমাকে বলেন, ”দল ছেড়ে অনেক ছেলেরাই আসতে চাইছে। আমি তাদের বলেছি এখন আসতে হবে না। এখন দলে থাক। সময় হলে আমি ডেকে নেব।” আসলে মুকুলের হিসাবটি ছিল নিখুঁত। মুকুল জানতেন দল ছেড়ে আসা’দের তিনি তখন নিরাপত্তা দিতে পারবেন না। বরং ভিতরে থেকে তারাই যদি উইপোকার মতো কুড়ে খায় তৃণমূলকে সেটাই বরং বেশি কার্যকরী হবে। অর্জুন সিং, সৌমিত্র খাঁ প্রমুখকে ভাঙিয়ে এনেছেন মুকুল। বেশ বোঝা যাচ্ছে, আরও অনেকেই ডাক পেলে দল ভেঙে বেরিয়ে আসার অপেক্ষায়। দল ভাঙানোর রাজনীতিটা এমন বুমেরাং হয়ে ফিরে আসায় তৃণমূল কংগ্রেস সভানেত্রী নিশ্চয়ই বিস্তর অস্বস্তিতে আছেন।

দল ভাঙার পাশাপাশি সুকৌশলে মুকুল আরও একটি কাজও করেছেন। তা হল, তৃণমূল কংগ্রেস দলটির ভিতর পারস্পরিক সন্দেহ এবং অবিশ্বাসের বীজ রোপন করে দেওয়া। এই অবিশ্বাসের রাজনীতি তৃণমূল কংগ্রেসের ভিতর কেমন ছড়িয়ে গেছে, তার প্রমাণ ওই দলের সর্বময় নেত্রীর কথায়। নেত্রী স্বয়ং বলেছেন আরও অনেকেই দল ছেড়ে চলে যেতে চাইছেন, তা তার জানা আছে। দলের অন্দরে একবার অবিশ্বাসের বীজ রোপন হয়ে গেলে সংঘবদ্ধ ভাবে নির্বাচনী যুদ্ধ লড়াটা যে কঠিন হয়ে পড়ে– তা নির্বাচনী কৌশলে পটু মুকুল রায় জানেন।

ঠিক এই কাজগুলি বিজেপি’র আর কোনও নেতাকে দিয়ে এই রাজ্যে সম্পন্ন করা যেত না–– তা অমিত শাহরা জানেন। কাজেই আজ যদি তৃণমূল কংগ্রেসের ঘর ভেঙে বিজেপির পায়ের নীচে জমি শক্ত হয়–– তাহলে তার কৃতিত্বের সিংহভাগটাই মুকুলের প্রাপ্য। এ নিয়ে মতান্তর বা মনান্তরের কোনও জায়গা নেই। এই সত্যটাও স্বীকার করতে হবে–– এতবছর ধরে বিজেপি’র আর্দশের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে দলে দলে মানুষ যে এ দেশে এসেছেন ব্যাপারটা এমনও নয়। কাজেই নির্বাচনের ময়দানে যদি বিজেপিকে দল ভারী করতে হয়, তাহলে অন্য দল থেকে তাকে রাজনৈতিক নেতা কর্মীদের আনতেই হবে। অযথা ছুঁৎমার্গ রেখে বিজেপির অন্তত কোনও লাভ হবে না। আর এবারের লোকসভায় বিজেপির কাছে সংখ্যাটা অত্যন্ত জরুরি। অমিত শাহ সেটা বুঝছেন এবং বলছেনও। এই সংখ্যা বাড়ানোর খেলায় মুকুল রায়ই যে কার্যকরী অস্ত্র তা প্রমাণ করে দিয়েছেন অমিত শাহরাই।

বাকি রইল একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। মুকুল রায় কি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ট্রয়ের ঘোড়া? তৃণমূল দলটির অস্তিত্ব নিয়ে ক্রমেই যখন সংশয় জাগছে, তখন মুকুল বুঝিয়ে দিয়েছেন ট্রয়ের ঘোড়া নয়–– নিজেকে প্রমাণের তাগিদেই তিনি বিজেপিতে এসেছিলেন। সেটা ছিল তাঁর একার লড়াই। আর সেই লড়াইয়ে তিনি জিতে গিয়েছেন।

রন্তিদেব সেনগুপ্ত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.