ছোটদের জ্বর, সর্দি-কাশিতে বাধ্যতামূলক করা হল আরটি পিসিআর পরীক্ষা

জ্বর ও শ্বাসযন্ত্রে সংক্রমণ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি শিশুদের ক্ষেত্রে এ বার করোনার পরীক্ষা (আরটি পিসিআর) বাধ্যতামূলক করল রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর।

ঘরে ঘরে জ্বর এবং সর্দি-কাশিতে আক্রান্ত শিশুদের অনেকেই সঙ্কটাপন্ন হয়ে পড়ছে। ইতিমধ্যেই সরকারি-বেসরকারি সব হাসপাতালে প্রায় ঠাঁই নেই অবস্থা। এমন অবস্থার নেপথ্যে কি শুধুই অ্যাডিনোভাইরাস? না কি, গোপনে করোনাও ছোবল মারছে? এই নিয়ে সংশয় দেখা দেওয়ায় করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে যে সব বিধি ছিল, সেগুলি ফের মেনে চলার কথা বলছেন স্বাস্থ্যকর্তারা। তবে প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে এখনই করোনা পরীক্ষা আলাদা ভাবে বাধ্যতামূলক না হলেও স্বাস্থ্যকর্তারা জানাচ্ছেন, সাধারণ ভাবে জ্বর-শ্বাসকষ্ট নিয়ে ভর্তি হলে তাঁদের আগের মতোই আরটি পিসিআর পরীক্ষা করা হয়।

ভাইরাসের সংক্রমণে শিশুদের অসুস্থ হওয়ার ঘটনা ক্রমশ বাড়ছে। তা যথেষ্ট উদ্বেগজনক বলেই জানিয়েছে স্বাস্থ্য দফতর। শ্বাসকষ্ট নিয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন শিশুদের ফুসফুসে দ্রুত সংক্রমণ ছড়াতে দেখা যাচ্ছে, জানাচ্ছেন চিকিৎসকেরা। বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করে স্বাস্থ্য দফতর নির্দেশিকায় জানিয়েছে, হাসপাতালে থাকা পেডিয়াট্রিক ভেন্টিলেটরগুলি সচল কি না, তা প্রতিনিয়ত পরীক্ষা করতে হবে। অক্সিজেন সরবরাহ, অক্সিজেন প্লান্ট-সহ আনুষঙ্গিক সরঞ্জাম ঠিক মতো রয়েছে কি না, তা নজরে রাখতে হবে। প্রতিটি হাসপাতালে পর্যাপ্ত শয্যা রাখতে হবে, পেডিয়াট্রিক ওয়ার্ড না থাকলে স্ত্রীরোগের মেডিসিন ওয়ার্ডে শিশুদের শয্যার ব্যবস্থা করতে হবে। এক স্বাস্থ্যকর্তার কথায় ‘‘ফুসফুসে দ্রুত সংক্রমণ ছড়াচ্ছে। সে ক্ষেত্রে অক্সিজেন ও ভেন্টিলেশন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’’

কী ভাবে শিশুরোগীদের চিকিৎসা করতে হবে, তার বিস্তারিত নির্দেশিকা জারি করা হয়েছে। সেখানে জানানো হয়েছে, ‘অ্যাকিউট রেসপিরেটরি ইনফেকশন’ (এআরআই), ‘ইনফ্লুয়েঞ্জা লাইক ইলনেস’ (আইএলআই) অর্থাৎ, ফ্লু-তে আক্রান্ত হওয়ার মতো উপসর্গ থাকলে এবং ‘সিভিয়র অ্যাকিউট রেসপিরেটরি ইনফেকশন’-এ (এসএআরআই) আক্রান্ত শিশুদের অবশ্যই আরটি পিসিআর পরীক্ষা করতে হবে। এই নির্দেশিকার সমর্থনে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের শিশুরোগ বিভাগের শিক্ষক-চিকিৎসক দিব্যেন্দু রায়চৌধুরীর ব্যাখ্যা, করোনার সঙ্গে অন্যান্য সংক্রমণও থাকতে পারে। এখন জ্বর, সর্দি, কাশি এবং শ্বাসকষ্টে ভুগছে যে শিশুরা, মনে করা হচ্ছে তারা অ্যাডিনো বা অন্য ভাইরাসে আক্রান্ত। সেই মতো চিকিৎসাও করা হচ্ছে। এমনও হতে পারে, তাদের কেউ আদতে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত। আবার অ্যাডিনো ও কোভিড-১৯, দু’টি ভাইরাসই একই সঙ্গে শিশুর শরীরে ঢুকে থাকতে পারে। দিব্যেন্দুর কথায়, “সবই অ্যাডিনোভাইরাস, এটা ভেবে নেওয়া উচিত নয়। রেসপিরেটরি প্যানেলে কোভিড-১৯ পরীক্ষা হয় না। তাই করোনা পরীক্ষার অবশ্যই প্রয়োজন।”

ফুসফুসে দ্রুত সংক্রমণ ছড়ানোর নেপথ্যে করোনাভাইরাসের ভূমিকা উড়িয়ে দেওয়া ঠিক নয় বলে মত শিশুরোগ চিকিৎসক দেবদীপ চৌধুরীরও। তাঁর কথায়, ‘‘খরচ অনেক বেশি হওয়ায় সকলের পক্ষে ভাইরাল প্যানেল পরীক্ষা করা সম্ভব নয়। তাই সকলেই অ্যাডিনোভাইরাসে আক্রান্ত, সেটা সম্পূর্ণ নিশ্চিত ভাবে বলা যায় না। এটাও দেখা প্রয়োজন যে, কোভিড কতটা প্রভাব ফেলছে।’’ ইমিউনোলজির চিকিৎসক ও গবেষক দীপ্যমান গঙ্গোপাধ্যায়ের মতে, ‘‘অ্যাডিনো ও কোভিড-১৯ একই সঙ্গে শরীরে থাকলেও দু’টি ভাইরাসই যে রোগ হিসাবে প্রকাশ ঘটাবে, তেমনটা নয়। তবে প্রথমেই বুঝে নেওয়া ভাল যে, কোভিড কি না। যদি আরটি পিসিআর পরীক্ষার ফল নেগেটিভ আসে, তখন অন্য পরীক্ষা করে দেখতে হবে। বিশ্বে সর্বত্রই অ্যাডিনো-৭ সেরোটাইপ যথেষ্ট চিন্তার।’’

অ্যাডিনোভাইরাসের সব চেয়ে ক্ষতিকর সেরোটাইপের (অ্যাডিনো-৭) সঙ্গে কোভিডের ভাইরাস সার্স কোভ-২ এর যথেষ্ট মিল রয়েছে, জানাচ্ছেন ভাইরোলজিস্ট সিদ্ধার্থ জোয়ারদার। তিনি বলেন, ‘‘অ্যাডিনো-৭ শ্বাসনালি ও ফুসফুসের কোষে কোভিডের মতোই প্রদাহ তৈরি করে। এই ধরনের ভাইরাসের উপস্থিতিতে কোষ থেকে সাইটোকাইন (আইএল-৬, টিএনএফ-আলফা, ইন্টারফেরন গামা) ও কেমোকাইন (আইএল- ৮) প্রোটিন নিঃসরণ মারাত্মক বেড়ে যায়। তাতে কোভিডের মতোই সাইটোকাইন ঝড় শুরু হতে পারে। ফলে নিউট্রোফিল, বেসোফিল, ম্যাক্রোফ্যাজের মতো প্রতিরোধী কোষগুলি এক জায়গায় জড়ো হয়ে শরীরে প্রদাহ তৈরি করে। তখনই রোগী সঙ্কটজনক হয়।’’

ফলে স্বাস্থ্য দফতরের তরফে আবারও মাস্ক পরা, ভিড় এড়িয়ে চলা, বার বার হাত ধোয়ার মতো বিধি মেনে চলায় জোর দেওয়া হয়েছে। এক চিকিৎসকের কথায়, ‘‘স্কুলে প্রায় সব বাচ্চাই এখন সর্দি-কাশিতে ভুগছে। বড়রা সংক্রমিত হওয়া সত্ত্বেও মাস্ক পরছেন না। তাঁদের থেকে শিশুরা আক্রান্ত হচ্ছে। বিধি না মানলে পরিস্থিতি আরও জটিল হতে পারে।’’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.