আজ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের বাংলাভাষার দাবী উত্থাপন দিবস । ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন শুরু হয়। এই অধিবেশনে পূর্ব বাংলা থেকে নির্বাচিত গণপরিষদ সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত উর্দু ও ইংরেজীর সাথে বাংলাকেও গণপরিষদের অন্যতম সরকারী ভাষা করার প্রস্তাব করেন। একাত্তরে পাকিস্তানি হানাদারদের হাতে শহীদ হওয়ার আগ পর্যন্ত যিনি স্বপ্নের বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করে গেছেন তিনি শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। মুখ্যত, ভাষা আন্দোলনের পথ বেয়ে দেশ স্বাধীন হয়। এটাই ইতিহাস। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দেন। ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত যে স্বপ্ন দেখেছিলেন বঙ্গবন্ধু এর বাস্তবায়ন করেন। সেই অর্থে শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা। বাংলাভাষার দাবী উত্থাপন দিবস
পাকিস্তান গণপরিষদের প্রথম অধিবেশনে তিনি বলেন, ‘‘গণপরিষদে যে কার্যবিবরণী লেখা হয় তা ইংরেজি ও উর্দু ভাষায় লিপিবদ্ধ হয়। গণপরিষদের স্পিকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে তিনি বলেন, ‘‘সমগ্র পাকিস্তানের ৫৬ শতাংশ লোক বাংলা ভাষায় কথা বলেন। ’’ প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান এই প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করেন।
প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান এই প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করে সাম্প্রদায়িক রং মাখিয়ে বলেন, প্রথমে এই প্রস্তাবের উদ্দেশ্য নির্দোষ বলিয়া আমি ভাবিয়াছিলাম। কিন্তু বর্তমানে মনে হয় পাকিস্তানের আধিবাসীদের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি করা এবং একটি সাধারণ ভাষার দ্বারা ঐক্যসূত্র স্থাপনের প্রচেষ্টা হইতে মুসলমানদের বিচ্ছিন্ন করাই এই প্রস্তাবের উদ্দেশ্য।
প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান আরও বলেন, পাকিস্তান একটি মুসলিম রাষ্ট্র এবং মুসলিম জাতির ভাষাই হইবে। ইহার রাষ্ট্রভাষা। উপমহাদেশের দশ কোটি মুসলমানের দাবির ফলে পাকিস্তানের সৃষ্টি হইয়াছে এবং এই দশ কোটি মুসলমানের ভাষা হইল উর্দু।
পূর্ববঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীনও এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করে বলেন, “পূর্ব পাকিস্তানের অধিকাংশ অধিবাসীরই এই মনোভাব যে একমাত্র উর্দুকেই রাষ্ট্রভাষা রূপে গ্রহণ করা যাইতে পারে।” ২৫ ফেব্রুয়ারি প্রস্তাবটি নিয়ে গণপরিষদে তুমুল বিতর্ক হয় এবং শেষ পর্যন্ত তা বাতিল হয়ে যায়।
পূর্ব বঙ্গের ছাত্র, শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সমাজ, বুদ্ধিজীবী আর রাজনীতিবিদরা বুঝেছিলেন যে, পাকিস্তানে উর্দুভাষীদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হলে বাঙালিরা সরকার ও সামরিক বাহিনীতে চাকরি-বাকরির সুযোগের ক্ষেত্রে উর্দু-জানা জনগোষ্ঠীর তুলনায় পিছিয়ে পড়বেন। “তখন চাকরির সুযোগ বলতে সরকারি চাকরিই ছিল। কিন্তু উর্দু রাষ্ট্রভাষা হলে সরকারি চাকরি বা সেনাবাহিনীতে চাকরি পেতে বাঙালিদের উর্দু শিখতে হবে, উর্দুভাষীদের সাথে প্রতিযোগিতা করতে হবে – ফলে তাদের ডিসএ্যাডভান্টেজ হয়ে যায়। ফলে ছাত্রদের জন্য এটা ছিল ভবিষ্যতের প্রশ্ন।” এটা পূর্ববঙ্গের ছাত্র ও শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রচণ্ড ক্ষোভ সৃষ্টি করেছিল।
বাংলাকে গণপরিষদের অন্যতম সরকারী ভাষার দাবি বাতিল হবার সংবাদ পূর্ব বাংলায় এসে পৌঁছলে প্রগতিবাদী ছাত্র, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী মহল ক্ষোভে ফেটে পড়ে। গণপরিষদের এই বাংলাভাষা বিরোধী সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ধর্মঘট আহ্বান করা হয়। ধর্মঘট চলাকালীন ঢাকার ছাত্র সমাজ বাংলা ভাষার দাবিতে বিভিন্ন স্লোগান দিতে দিতে শহর প্রদক্ষিণ করে। আর এই মিছিলের পুরো ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনায় বলিষ্ঠ নেতৃত্ব প্রদান করেন শেখ মুজিবুর রহমান। ধর্মঘট শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত ছাত্রসভায় পূর্ব বাংলার কংগ্রেস দলীয় সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে বাংলা ভাষার পক্ষে গণপরিষদে এমন শক্তিশালী ও সাহসী পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য অভিনন্দন জানিয়ে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়।
এখানে উল্লেখ করা দরকার যে, সেদিন গণপরিষদে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত কর্তৃক উত্থাপিত বাংলা ভাষার প্রস্তাবটি যারা সমর্থন করেছিলেন তাঁদের সকলেই ছিলেন হিন্দু এবং কংগ্রেস দলীয়। কোন বাঙালি মুসলমান সদস্য এই প্রস্তাব সমর্থন করেননি। এ প্রসঙ্গে বদরুদ্দীন উমর লিখেছেন,”…পরিষদে মুসলমান সদস্যের সকলেই ছিলেন সরকারী মুসলিম লীগ দলভূক্ত এবং তারা দলগতভাবে বাঙালি আবাঙালি নির্বিশেষে সমস্বরে প্রস্তাবটির নিন্দা এবং বিরোধিতা করেছিলেন। অন্যপক্ষে প্রস্তাবটি যাঁরা উত্থাপন করেন এবং তার সমর্থনে বক্তৃতা করেন তাঁরা সকলেই ছিলেন হিন্দু এবং কংগ্রেস দলভূক্ত।”
আমরা আগেই দেখেছি যে, নেতৃত্বের কোন্দল, মতাদর্শগত বিতর্ক, সাংগঠনিক দূর্বলতা, নেতাদের দূরদর্শিতার অভাবে প্রথম রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ যথার্থ ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হয়। এসময় পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ সরকার বিরোধী একমাত্র ছাত্র সংগঠন হওয়ার সুবাদে ভাষা আন্দোলনের সম্মুখ সারিতে চলে আসে। শেখ মুজিবসহ এই সংগঠনের অন্যান্য নেতারা ভাষা আন্দোলনকে আরও বেগবান করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। ফলশ্রুতিতে ১৯৪৮ সালের ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ফজলুল হক হলে সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কর্মীদের এক সভা আহ্বান করা হয় ।
কামরুদ্দীন আহমেদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই সভায় যারা উপস্থিত ছিলেন তাদের মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমান, শামসুল হক, অলি আহাদ, মোহাম্মদ তোয়াহা, রনেশ দাসগুপ্ত, অজিত গুহ, আবুল কাসেম, কাজী গোলাম মাহবুব, নঈমুদ্দীন আহমেদ, শহীদুল্লাহ কায়সার, তাজউদ্দিন আহমদ, শওকত আলী, সরদার ফজলুল করিম, শামসুদ্দীন আহমদ, তফাজ্জল আলী প্রমুখ।
এই সভায় পূর্ববর্তী সংগ্রাম পরিষদ বিলুপ্ত করে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ, গণ আজাদী লীগ, গণতান্ত্রিক যুবলীগ, তমদুন মজলিশ, বিভিন্ন হল সংসদের দু’জন করে প্রতিনিধি নিয়ে গঠন করা হয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ নামে একটি সর্বদলীয় পরিষদ। এই পরিষদের আহ্বায়ক মনোনীত হন শামসুল আলম। পরিষদ ১১ মার্চ সারা পূর্ব বাংলায় সাধারণ ধর্মঘট আহ্বান করে এবং তা সফল করার জন্য ব্যাপকভাবে পিকেটিং করার সিদ্ধান্ত নেয়।