বর্তমানে নতুন একটা হুজুগ শুরু হয়েছে। যে বাঙ্গালা ভাষায় কথা বললেই সে বাঙ্গালী!

যদিও হুজুগ বললে এটাকে যথেষ্ট কম বলা হয়। এটা একটা দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক প্রোপাগান্ডা! সেই প্রাক ‘৪৭ দেশভাগের প্রস্তুতির সময় থেকেই নেকড়েরা শ্যেনদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো পুরো বাঙ্গালা দখল করার জন্য। যদিও শ্যামাপ্রসাদ‚ গোপাল মুখোপাধ্যায়‚ মেঘনাদ সাহা সহ বাঙ্গালী মনীষীর চেষ্টায় বহু কষ্টে বাঙ্গালার এক তৃতীয়াংশ ভূখণ্ড কোনোক্রমে বাঁচানো গিয়েছিলো নেকড়েদের কবল থেকে‚ তবে তারা যে পুরো বাঙ্গালা দখলের আশা কখনোই ছাড়েনি তা ভালোভাবেই বোঝা যায় খোদ মুজিবের আত্মজীবনী পড়লেই।

এখন আবার সেই নেকড়েরা সক্রিয় হয়ে উঠেছে। কাজে লাগিয়েছে হিন্দুদের ঘরে জন্মানো কিছু যোগেন মন্ডলকে। যারা বাঙ্গালাদেশীদের সাথে এক সুরে চেঁচিয়ে যাচ্ছে জাতি গঠনে ধর্ম কোনো ফ্যাক্টরই নয়। জাতি গঠনে ধর্ম একটি অপ্রয়োজনীয় ইস্যু। ভাষাই আসল। ভাষা এক হলেই তারা এক জাতি ইত্যাদি ইত্যাদি! জাতির সংজ্ঞা থেকে ধর্মকে বাদ দেওয়াই নাকি আধুনিকতা।

মূল টপিকে আসার আগে একটা বিষয় ছুঁয়ে যাই। অনেকের মনে প্রশ্ন আসতেই পারে যে মু*লমানরা বাঙ্গালী হলে আমাদের সমস্যাটা কি? হোকনা ওরাও বাঙ্গালী! এতে বাঙ্গালী জনসংখ্যা বাড়বে‚ বাঙ্গালা ভাষা শক্তিশালী হবে ব্লা ব্লা ব্লা।

সমস্যাটা আমি বলছি।

কাশ্মীরি আইডেন্টিটি একসময় হিন্দুদের ছিলো। তারপর একদিন ওরা আসল। বলল আমরা তোমরা ভাই ভাই। ধর্ম যার যার‚ ভাষা সবার!

তারপর শুরু হলো কাশ্মীরী ভাষাকে বিকৃত করা। উর্দু-আরবী ঢুকিয়ে। আর সাথে চলল ব্যাপক হারে ডেমোগ্রাফির পরিবর্তন। কাশ্মীরি পন্ডিতরা চোখ বুজে ছিলো।

আর তারপর একদিন? কাশ্মীর জুড়ে আওয়াজ উঠল – রালিভ‚ গালিভ ইয়া চালিভ। হয় আমাদের সাথে এসো (ধর্মান্তরিত হও) নয় মরো আর নয়তো চলে যাও ( কাশ্মীর ছেড়ে )!

শুরু হল কাশ্মীর জুড়ে গণহত্যা!

কাদের গণহত্যা? কাশ্মীরিদের? আজ্ঞে না। একদমই না। কাশ্মীরি পন্ডিতদের গনহত্যা।

কাশ্মীরিদের মূল আইডেন্টিটি‚ কাশ্মীরিয়ৎ তখন দখল হয়ে গেছে “তাদের” দ্বারা! আর হিন্দুরা? তারা কাশ্মীরি পন্ডিত। অর্থাৎ মূল কাশ্মীরি না। কাশ্মীরি পরিচয়ের উপর টিউমার যেন একটা। বা ছত্রাক বিশেষ। কিংবা ফুসকুরি। আছে‚ কিন্তু না থাকলেও চলে। এমনই যেন।

পরবর্তী টার্গেট বাঙ্গালীরা।

আগেরবার কিন্তু আপনারা পালিয়ে পূর্ববঙ্গ থেকে পশ্চিমবঙ্গে এসেছিলেন। এবার যাবেন কোথায়?

যাকগে আসল কথায় আসি। এই নব্য যোগেন মন্ডলদের দুটো তথাকথিত যুক্তিকে সরাসরি তথ্য দিয়ে খন্ডন করি।

১- ভাষা এক হলেই তারা এক জাতি।

সঠিক তথ্য – একেবারে ফালতু কথা। পৃথিবীর বহু জাতি আছে যেখানে ভাষা এক। এমনকি তাদের পূর্বপুরুষও এক‚ সংস্কৃতির শিকড়ও প্রায় এক। তাও তারা আলাদা জাতি।

ব্রিটিশ – আমেরিকান – অস্ট্রেলিয়ান – নিউজিল্যান্ড বাসী এদের সবার ভাষা এক। সিংহভাগেরই পূর্বপুরুষ এক। সংস্কৃতির শিকড়ও এক। তাও কিন্তু তারা আলাদা জাতি।

আবার‚ আলজেরিয়া‚ মিশর‚ সৌদি আরব‚ সেনেগাল সহ ২৮ (আঠাশ) টি দেশের ভাষা আরবী। তবুও কিন্তু তারা আলাদা জাতি। এক জাতি নয়।

তাহলে একই ভাষা বলেই সব বাঙ্গালাভাষীই বাঙ্গালী হবে কোন যুক্তিতে? তাও তো হতভাগাগুলো কথা বলে বিকৃত বাঙ্গালায়‚ শুদ্ধ বাঙ্গালায় না।

এছাড়া ভাষা দিয়ে জাতি তৈরি হয় না – এই বিষয়ে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের বক্তব্য অবশ্যই প্রণিধানযোগ্য।
তাঁর কথায় –

//ভাষার ঐক্যে ন্যাশনাল ঐক্যবন্ধনের সহায়তা করে, সন্দেহ নাই; কিন্তু তাহাতে এক করিবেই, এমন কোনো জবরদস্তি নাই। য়ুনাইটেড স্টেটস ও ইংলণ্ডের ভাষা এক, স্পেন ও ম্পানীয় আমেরিকার ভাষা এক, কিন্তু তাহারা এক নেশন নহে। তাহা ছাড়া, ভাষায় জাতির পরিচয় পাওয়া যায়, এ-কথাও ঠিক নয়। প্রুসিয়া আজ জর্মান বলে, কয়েক শতাব্দী পূর্বে স্লাভোনিক বলিত, ওয়েল্‌স্‌ ইংরেজি ব্যবহার করে, ইজিপ্ট আরবি ভাষায় কথা কহিয়া থাকে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘নেশন কী’, রবীন্দ্র-রচনাবলী, ৩য় খণ্ড, বিশ্বভারতী, ১৯৫০, পৃ. ৫১৭//

এবার আসি দ্বিতীয় (তথাকথিত ) যুক্তিতে।

২ – জাতি গঠনে ধর্ম কোনো নিয়ন্ত্রক শক্তি হতে পারে না। আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গিতে (অর্থাৎ ইউরোপীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে) ধর্ম গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর নয়।

সঠিক তথ্য – এবার আমি উদাহরণ দেব খোদ ইউরোপ থেকেই। পূর্বতন যুগোস্লাভিয়ার তিনটি বড় বড় জাতিগোষ্ঠী ছিলো সার্ব – ক্রোট ও বসনিয়াক।

এদের মধ্যে সার্ব ও ক্রোটদের ভাষা একই – সার্ব। কিন্তু তাদের ধর্ম আলাদা। সার্বরা অর্ডোডক্স খ্রিস্টান। আর ক্রোটরা রোমান ক্যাথলিক। যদিও একই ভাষায় কথা বলে তবুও সার্বরা লেখে কিরিলিক অ্যালফাবেটে আর ক্রোটরা লেখে রোমান অ্যালফাবেট।

আর এই ধর্মের পার্থক্যই তাদের পরিণত করেছে সম্পূর্ণ দুটো আলাদা জাতিতে।

আর উল্টোদিকে বসনিয়াকরাও মোটামুটিভাবে একই পূর্বপুরুষ থেকে আসলেও ( প্রচুর আরবি – তুর্কি ঔপনিবেশিকের রক্ত মিশে আছে) ওদের ধর্ম ইসলাম। তারা কথা বলে আরবি, উসমানীয় তুর্কি এবং ফার্সিতে ভর্তি বসনীয় ভাষায়। আর সার্ব ভাষা থেকে মোটেও তা খুব একটা আলাদাও নয়। ( স্নান করা – নেমন্তন্ন করার বাঙ্গালা ভাষার সাথে গোসল করা – দাওয়াত দেওয়ার বাঙ্গালাদেশী ভাষার পার্থক্যটা আরেকটু বিস্তৃতরূপে ধরলে যেমন হবে। )

অর্থাৎ স্রেফ ধর্মের পার্থক্যের জন্যই আস্ত তিনটি জাতি তৈরী হয়েছে খোদ ইউরোপের মাটিতে।

সোজা ভাষায় ভাষায় জাতি সম্পূর্ণ আলাদা জিনিস। ভাষা এক হলেই জাতি এক হয় না। আর জাতি গঠনে ধর্ম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর।

এবং অবশ্যই অবশ্যই – বাঙ্গালী ও বাঙ্গালাদেশী দুটো পৃথক জাতি। বাঙ্গালীদের জাতিসত্তা যাতে বাঙ্গালাদেশীদের দখলে না চলে যায় তার জন্য আমাদের সবসময় সতর্ক থাকতে হবে।

সৌভিক দত্ত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.