নির্ভয়পুরের কথা – প্রথম পর্ব

উপনিষদ বলছেন – সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম তজ্জলানিতি শান্ত উপাসীত। অথ খলু ক্রতুময়ঃ পুরুষো ভবতি তথেতঃ প্রেত্য ভবতি স ক্রতুং কুর্বীত।

যা কিছু এই পৃথিবীতে আছে সবই ব্রহ্ম। ব্রহ্ম হতে সব আসে ব্রহ্মেই সকল কিছু লীন হয়। সকল কিছু ব্রহ্মকে আশ্রয় করেই চলছে। অতএব , ব্রহ্মকে শান্তভাবে আরাধনা কর , ধ্যান কর। প্রতিটি মানুষের মন স্বতন্ত্র। একথা মনে রেখে তদানুযায়ী আরাধনা, ধ্যান করা উচিৎ।

বেদ , উপনিষদ্ উপাসনার কথা বলছেন। তাঁরা প্রতীক অবলম্বনে উপাসনার কথা বলছেন। যেমন -পৃথিবী, আকাশ, অগ্নি, বায়ু, আদিত্য ( ব্রহ্মতেজ) , অন্নাদ্য ( শক্তি), উদক, যে বা যিনি খাদ্য – বস্ত্র – জল- বাসস্থান প্রদান করে মানবকূলকে রক্ষা করছেন ( বৃক্ষ, নদী, পাহাড়, পশু, পক্ষী)। উপনিষদ্ প্রাণকে আদিত্য ও অন্নদা রূপে ধ্যান করতে বলেছেন। কর্ণকে চন্দ্র, শ্রী রূপে , বাককে অগ্নি বা ব্রহ্মতেজ এবং অন্নরূপে উপাসনা করতে বলছেন। হৃদয়ে যে জ্যোতি আছে তাঁকে আমরা দেখতে পাই না। কিন্তু যখন আমরা ব্রহ্ম ও ব্রহ্মময়ীকে নানারূপে উপাসনা করি তখনই তাঁকে উপলব্ধি করি। সেই উপলব্ধিই ব্রহ্ম ও ব্রহ্মময়ীর অস্তিত্বের প্রমাণ করে। নিরাকার থেকে তখন তাঁরা সাকার হয়ে ওঠেন। তাঁরা অবস্থান করেন প্রতি জীবে , যাঁরা আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে উপকার করেন। 

বিষ্ণু রূপে শালগ্রাম শিলা, শিব রূপে লিঙ্গ , ধর্ম রূপে কুর্ম , দেবী রূপে বিবিধ যন্ত্র এবং ঘট পবিত্র বস্তু এবং গরু পবিত্র পশু। এগুলিই শূন্য ও শক্তি স্বরূপ। তুলসী সহ দেবতার পূজা প্রকৃতি , শূন্য অর্থাৎ পরম ব্রহ্মের পূজার নামান্তর।  সকল দেবদেবীর জর উপাসনা করা হয় তা সবই ব্রহ্মের উপাসনা। বিষ্ণু , শিব,  দুর্গা , কালী, শ্ৰী, সরস্বতী প্রমুখেরা ব্রহ্ম স্বরূপ। আমরা পরম ব্রহ্মকে যে ভাবে দেখি সেভাবেই তিনি দেখা দেন। সুরেশচন্দ্র বিদ্যানিধি বলেছেন – ” অতএব বিষ্ণু, দুর্গা, কালী প্রভৃতি সমস্ত দেবতাই তাঁদের উপাসকের  মধ্যেও উচ্চ নীচ নিরূপন হতে পারে না। “

সেই কারণেই সুপ্রাচীন কাল থেকে প্রকৃতির নানা বস্তুকে নানা ভাবে পূজা উপাসনা করা হয়ে আসছে। ভালো ফসলের আশায়, রোগ শোক হতে মুক্তি পেতে, পঞ্চভূতকে তুষ্ট করতে সেই উপাসনা আজও আমরা করে থাকি। 

আজ তেমনই এক উপাসনার কথা ও এক ইতিহাস বলব। পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্গত পুরুলিয়া জেলার পুঞ্চা থানার নপাড়া অঞ্চলের কৈড়া মৌজার নির্ভয়পুর গাঁয়ের উত্তরে কংসবতী নদী। কংসার তীরে এক কিনারে অবস্থান করছেন দুই সুপ্রাচীন দেব দেবী – ব্যাঁইড়া ও কিয়াসিনী।

ব্যাঁইড়া দেবতা নির্ভয়পুর গাঁয়ের কুলদেবতা। দেবতা মুণ্ডা জাতির দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হন প্রায় হাজার বৎসর পূর্বে। দেব আলোচনার পূর্বে উক্ত মুণ্ডাদের বংশ সম্পর্কে ইতিহাস আলোচনা করা বিশেষ প্ৰয়োজন। 

বহুকাল পূর্বে বিহারে অনাদিনারায়ণ সিংহ নামে এক রাজা ছিলেন। তাঁর পুত্র দেবনারায়ণ সিংহ একদা জগন্নাথ দর্শনের মনস্কামনা নিয়ে সৈন্য সামন্ত , লোক লস্কর নিয়ে রওনা দিলেন। সে সময়ে দেবনারায়ণের একমাত্র রাণী , অনাদিনারায়ণের পুত্রবধূ অন্তঃস্বত্ত্বা ছিলেন। রাজাবধূ এরূপ শারীরিক অবস্থায় এত পথ চলে নীলাচলে যাবেন এ ঠিক নয়। তাছাড়া আরণ্যক পথ কেবলমাত্র শ্বাপদ সঙ্কুল নয় বরং দস্যু উৎপাতও কিছু আছে বটে। তবে জঙ্গলের মধ্যের এক রাজার প্রকোপে তারা মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে না , তা বলে ভয় কিছু কমে যায় না। তবুও রাণী জেদ ধরলেন। জেদের কাছে হেরে গিয়ে দেবনারায়ণ স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে যাত্রা আরম্ভ করলেন। ওদিকে বিধি মুচকি হাসলেন। মালভূমির বন্ধুর পথ পালকি, দোলে , হাতিতে চলেও রাণী পথের ধকল নিতে পারলেন না। এক প্রবল বর্ষার রাত্রে তাঁর প্রসব বেদনা উঠল। রাজা তখন আর রাণীকে সঙ্গে নিয়ে যেতে পারলেন না। কিছু সৈন্য, কিছু লোক, কিছু দাস দাসী, দাই মোতায়েন করে এবং রাজার অতি বৃদ্ধ পরামর্শদাতা ব্রাহ্মণকে সেই জঙ্গলের মধ্যে রেখে চলে গেলেন। প্রায় বহুক্ষণ প্রচণ্ড প্রসব যন্ত্রণা সহ্য করে রাণীর কোল আলো করে একটি পুত্র সন্তান ভূমিষ্ঠ হল। 

দেবনারায়ণ কিছুদিনের খাদ্য দিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়ে গিয়েছিলেন যে কিছুদিনের মধ্যেই ফিরে এসে সকলকে নিয়ে মহাধুমধামের সঙ্গে রাজ্যে ফিরে যাবেন। কিন্তু দিন গেল , মাস গেল দেবনারায়ণ ফিরলেন না। এদিকে খাদ্য প্রায় ফুরিয়ে এল। রাণী সকল দাসদাসী, লোকজন, সৈন্যদের আপন আপন গাঁয়ে ফিরে যেতে হুকুম দিলেন। তাঁর অভিমান ও অপমান চূড়ান্তভাবে হয়েছিল। তাই অতিঅনুরোধ স্বত্তেও আর শ্বশুড়ভিটার পথের দিকে যাত্রা করতে চাইলেন না। মালভূমির ঘনজঙ্গলের বেষ্টনে তিনি আপন শিশুপুত্রকে বুকে আগলে বসে রইলেন। পিতা সমান রাজপরামর্শদাতা ব্রাহ্মণ কিন্তু দুঃখিনী রাণীকে ত্যাগ করলেন না। নিজ ক্ষমতা বলে সেই জঙ্গলে রানী ও সিংহ রাজবংশের বংশধরটিকে রক্ষা করতে লাগলেন। 

যেখানে রাণী বাস করছিলেন, সেই জঙ্গল মহাবীর সিংহ মুণ্ডা নামে এক প্রতাপশালী মুণ্ডারাজার রাজত্বের মধ্যে ছিল। এই রাজ্যটি ছোটনাগপুর মালভূমির অন্তর্গত ছিল। মুণ্ডা রাজা যে গ্রামে বাস করতেন তার নাম ছিল উলিডি। রাজা একদিন রাজ্যে ভ্রমণে বেরিয়ে জঙ্গলের মধ্যে সেই রাণী, তাঁর সন্তান ও ব্রাহ্মণকে দেখতে পেলেন। রাণীর পুত্রটি তখন বছর চারেক। দেবশিশুর মতো সুন্দর পুত্রটিকে দেখে রাজার বড় মায়া হল। তিনি ব্রাহ্মণকে প্রণাম করে কুশলাদি জিজ্ঞাসা করলেন। তাতে জানতে পারলেন , রাণীর অতীত ইতিহাস। রাণী বেশ কিছু বৎসর এই জঙ্গলে কুটির বেঁধে সন্ন্যাসিনীর ন্যায় জীবন কাটাচ্ছেন। পুত্রটির নামকরণ হয়েছে নিরঞ্জন সিংহ। সৎ পরিবারজাত শুনে মুণ্ডা রাজা তিনজনকে সসম্মানে তাঁর গ্রামে আশ্রয় দিলেন। পুত্রটি ব্রাহ্মণের নিকট সর্ববিদ্যায় পারদর্শী হতে লাগলেন।

মুণ্ডারাজার কুলদেবী ছিলেন মহামায়া দুর্গা। তাঁর কৃপায় রাজার একটি কন্যা সন্তান জন্ম নেয়। ব্রাহ্মণ তাঁর নামকরণ করেন শক্তিশ্বরী। দিন যায়, নিরঞ্জন ও শক্তি উভয়েরই বিবাহের বয়স হয়। রাজা ও ব্রাহ্মণের মতামতে উভয়ের বিবাহ হয়। বিবাহের পর মহাবীর সিং মুণ্ডা তাঁর রাজত্বভার নিরঞ্জন সিংহের হাতে দিলেন। নিরঞ্জন সিংহের পুরো নাম হল নিরঞ্জন সিংহ মুণ্ডা। মহাবীরের একটি পুত্র জন্মে পরে। শক্তির বিবাহকালে পুত্রটি নিতান্ত কোলের ছিল। তাই মহাবীর জামাতার হস্তে রাজ্যভার অর্পণ করেন। প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি, নিরঞ্জনকে মুণ্ডা উপাধি প্রজারা দিয়েছিলেন।

ক্রমে নিরঞ্জনের সাতটি পুত্র জন্মায়। 

প্রথম পুত্র – সরযূ সিংহ মুণ্ডা

দ্বিতীয় পুত্র – দ্বারিকানাথ মুণ্ডা

তৃতীয় পুত্র – কম্পাট মুণ্ডা

চতুর্থ পুত্র – দামোদর মুণ্ডা

পঞ্চম পুত্র – সাবাস মুণ্ডা

ষষ্ঠ পুত্র – নানুরাম মুণ্ডা

সপ্তম পুত্র -ঠুনুক মুণ্ডা

মহাবীর সিংহ মুণ্ডার কনিষ্ঠ ও একমাত্র পুত্র বড় হয়। ক্রমশ তার মনে হতে থাকে এই রাজ্য তাঁর এবং কোনোভাবে পিতার জামাইবাবুকে সেই অধিকার দেওয়াটি অন্যায় । একদা কোনো কারণে,  রাজ্য,খাজনা ইত্যাদি নিয়ে মামা ও ভাগ্নেদের মধ্যে ঝামেলা হয়। অহংকারী ও লোভে অন্ধ মামা বললেন , ” এই সুবিশাল মুণ্ডা রাজত্ব তো আমার প্রাপ্য বংশ পরম্পরায়। তোমাদের কোনো অধিকার নেই। এখন থেকে ভালোয় ভালোয় অন্যত্র চলে যাও। নাহলে মান , প্রাণ সব যাবে।” সিংহাসনের অধিকার ইতিহাসে কত জ্ঞাতি শত্রু, কত জ্ঞাতি যুদ্ধ হয়েছে, এ তারই পুনরাবৃত্তি হল। 

সপ্ত সহোদর চাইলেই অনেক কিছু করতে পারতেন। কিন্তু মাতা শক্তিশ্বরী আদেশে কিছু করলেন না। মাতাকে নিয়ে তাঁরা ছোটনাগপুর বিভাগের উলিডি গ্রাম ছেড়ে পূর্বদিকে যাত্রা করলেন। মুণ্ডা রাজ্য ত্যাগ করে চলে আসার সময় মাতা শক্তিশ্বরী কুলদেবতা ও দেবীকে সঙ্গে করে যাত্রা করেছিলেন। তিনি অতি কষ্ট যন্ত্রণাতেও ধর্মকে ত্যাগ করেন নি। তাই ধর্মও তাঁকে ত্যাগ করলেন না। দিবারাত্র চলার পরে একটি জংলা ছোট্ট গাঁয়ে এসে তাঁরা থামলেন। সেখানে ক্লান্তিতে তাঁদের চোখে নিদ্রা নেমে এল। জনশ্রুতি আছে, উপাস্য ব্যাঁইড়া স্বপ্ন দিয়ে বললেন, “এই আরণ্যক অঞ্চল ভয়হীন , নিরাপদ। তোমরা নির্ভয়ে এখানে বসবাস শুরু কর। ” সেই থেকে এই গ্রামের নাম হল নির্ভয়পুর। 

তারপর কি হল? 

ক্রমশঃ

©দুর্গেশনন্দিনী

তথ্যসূত্র – শ্রী মোহন সিং পাতর , কৈড়া – পুঞ্চা এবং ব্যাঁড়ার থান ও কিয়াসিনী পূজারী বংশধরগণ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.