মহামৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র ও স্তোত্রং —
মহামৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র ভগবান শিবের একটি সর্বরোগ হরণকারী মন্ত্র। ঋক্ বেদ এ এটির উল্লেখ পাওয়া যায়। এই মন্ত্র বলে দেহের মধ্যে দৈবিক শক্তি এতটাই বেড়ে যায় যে মৃত্যু ধারে কাছেও যেতে পারে না।
চার লাইনে ভাঙা এই মন্ত্রটির প্রতিটি লাইনে আটটা চিহ্ন রয়েছে, যা উচ্চারণ করার সময় সারা শরীরজুড়ে একটা কম্পন ছড়িয়ে পরে। এই কম্পনই শরীরে ভেতরে থাকা হাজারো ক্ষতকে নিমেষে সারিয়ে তোলে। শুধু তাই নয়, ব্রেন পাওয়ার বৃদ্ধিতেও বিশেষ ভূমিকা পালন করে এই মন্ত্রটি। আধুনিক কালে এই মন্ত্রটিকে নিয়ে একাধিক গবেষণা হয়েছে। তাতে দেখা গেছে মন্ত্রটি পাঠ করার সময় মস্তিষ্কের মধ্যে থাকা নিউরনগুলি এতটাই অ্যাক্টিভ হয়ে যায় যে ধীরে ধীরে মনোযোগ বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। সেই সঙ্গে বুদ্ধি এবং স্মৃতিশক্তিরও উন্নতি ঘটে।
মহামৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র —
ॐ ত্র্যম্বকম যজামহে
সুগন্ধিম পুষ্টিবর্ধনম্ ।
উর্বারুকমিব বন্ধনান্
মৃত্যৌর্মুক্ষীয় মামৃতাত্ ॥
হে ত্রিনেত্রধারী মহারুদ্রসরূপ পরমব্রহ্ম, তোমার বন্দনা করি। তুমি আমাদের বেঁচে থাকার জন্য সুগন্ধিযুক্ত ও পুষ্টিকর খাদ্যের যোগানদাতা। সকল রোগব্যাধি বিনাশ করে আমার জীবনী শক্তি বৃদ্ধি কর। অজ্ঞানতারূপ মৃত্যু থেকে আমাকে আত্মজ্ঞান স্বরূপ অমৃতত্ত্ব তথা মোক্ষ প্রদান কর।
— ঋগ্বেদ (৭.৫৯.১২)।
মহামৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র বিশ্লেষণ —
ॐ :—
হিন্দু সংস্কৃতির প্রায় কোনও মন্ত্রই ॐ ছাড়া শুরু হয় না ! বিশেষ করে, শিবমন্ত্র। তাই, মহামৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র জপের শুরুতেই ॐ উচ্চারণ করে শুদ্ধ করে নিতে হয় আত্মাকে। আর, ॐ উচ্চারণেরও রয়েছে এক বিশেষ পদ্ধতি। নাভি থেকে উপরের দিকে নিঃশ্বাসের সঙ্গে বের করতে হয় ওম শব্দের ধ্বনি। অর্থাৎ, প্রাণায়াম শুরু হল এই ধ্বনি উচ্চারণ দিয়েই।
ত্র্যম্বকম :—
শিবের একটি নাম ত্র্যম্বক। যাঁর তিনটি চোখের মধ্যে একটি সূর্য, একটি চন্দ্র এবং অপরটি অগ্নি। বেঁচে থাকার জন্য মানুষের এই তিনটিরই তেজ প্রয়োজন। তাই যে মন্ত্র উদ্ধার করতে পারে মৃত্যু থেকে, তার অধিকর্তা ঈশ্বরকে সম্বোধন করা হয়েছে ত্র্যম্বক নামে।
যজামহে :—
যজামহে মানে ত্র্যম্বককে যজন বা উপাসনা করি। তাঁকে শ্রদ্ধা জানাই।
সুগন্ধিম :—
যে ঈশ্বরকে এই মন্ত্রে বর্ণনা করা হয়েছে, তিনি সুগন্ধিযুক্ত। এখানে শিবের সর্বাঙ্গে যে ভস্মের অনুলেপন, তাকেই ব্যাখ্যা করা হয়েছে সুগন্ধি হিসেবে। মানে স্পষ্ট — এই নশ্বর জীবন একদিন ভস্মেই পরিণত হয়। কিন্তু, মোক্ষ লাভ করতে পারলে, মৃত্যুভয় কেটে গেলে ওই ভস্মই হয়ে ওঠে সুগন্ধির সমতুল্য।
পুষ্টিবর্ধনম :—
শিব, যিনি আমাদের মৃত্যু থেকে রক্ষা করেন, তিনি আমাদের পুষ্টিবর্ধনেরও সহায়ক। লক্ষ্য করার মতো বিষয় — পুষ্টি হলেই শরীর নীরোগ হয়। তাই, মহামৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র শিবকে বর্ণনা করেছে পুষ্টিবর্ধন রূপে।
উর্বারূকমিব :—
সংস্কৃতে উর্ব শব্দটিকে নানা ভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। কেউ বলেন উর্ব শব্দের অর্থ বিশাল, কেউ বা বলেন মৃত্যুর মতোই ভয়ানক। আর, আরূকম মানে যা আমাদের রক্ষা করে এই ভয় থেকে।
বন্ধনান :—
বন্ধনান শব্দের মধ্যে বন্ধন শব্দটির উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো। বিশাল, মৃত্যুর মতো ভয়ানক ভয় আসলে বন্ধনেরই নামান্তর। সেই বন্ধন থেকে আমাদের মুক্ত করেন মহামৃত্যুঞ্জয় শিব।
মৃত্যুর্মুক্ষীয় :—
মৃত্যু থেকে উদ্ধার করা !
মামৃতাম :—
মা শব্দটির অর্থ সংস্কৃতে না ! তাহলে নয় অমৃতাম — শব্দবন্ধে বলতে চাওয়া হয়েছে, শিব আমাদের মৃত্যু থেকে উদ্ধার করুন, কিন্তু অমৃত থেকে নয়। অমৃত এখানে জীবনের আনন্দের কথাই বোঝাচ্ছে।
মহামত্যুঞ্জয় মন্ত্র প্রসঙ্গে —
শিবপুরাণ বলে, এই মন্ত্রের আবিষ্কর্তা ঋষি মার্কণ্ডেয়। মহামৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র পাঠ করে তিনি উদ্ধার পান মৃত্যুর হাত থেকে। তার পরে এই মন্ত্র পৃথিবীতে জনপ্রিয় হয়।
বেশ কিছু পুরাণ জানায়, প্রজাপতি দক্ষ চন্দ্রকে ক্ষয়রোগের অভিশাপ দিলে শিব-পত্নী সতী এই মন্ত্র দান করেন চন্দ্রকে। সোমনাথ-তীর্থে এই মন্ত্র পাঠ করে ক্ষয়রোগ থেকে মুক্তি পান চন্দ্র।
আবার, স্বয়ং শিব এই মন্ত্র দান করেছিলেন দৈত্যগুরু শুক্রাচার্যকে। এই মন্ত্র পাঠ করেই দেবতাদের সঙ্গে যুদ্ধে মৃত অসুরদের বাঁচিয়ে তুলতেন শুক্রাচার্য। তাই, একে মৃতসঞ্জীবনী মন্ত্রও বলা হয়।
ভগবান মহাদেবকে স্মরণ করে রচিত এই মন্ত্রটি ঋগ্বেদেও দৃষ্ট হয় — আবার এই মন্ত্রটি মার্কণ্ডেয় পুরাণেও দৃষ্ট হয়। এই মন্ত্রটির সাথে একটি কাহিনী প্রচলিত আছে।
শিবের পরম ভক্ত ছিলেন ঋষি ভৃগুর বংশে জাত ঋষি মৃকাণ্ডু। ঋষি মৃকাণ্ডু পুত্রহীন ছিলেন। সন্তান না থাকার কারণে তিনি এবং তাঁর পত্নী মরুদ্বতী মনোকষ্ট থাকতেন। সন্তানলাভের উদ্দেশ্য ঋষি মৃকাণ্ডু মহাদেবের আরাধনা শুরু করেন। ঋষি মৃকাণ্ডুর প্রচণ্ড তপস্যায় খুশি হয়ে তাঁকে দেখা দেন মহাদেব। তিনি বলেন মৃকাণ্ডুর ভাগ্য পরিবর্তন করে তিনি তাঁকে সন্তানসুখ দান করবেন। কিন্তু এই আনন্দের সঙ্গে তাঁর জীবনে শোকও আসবে বলে জানান শিব। এরপর মার্কণ্ডেয় নামে ঋষি মৃকাণ্ডুর একটি পুত্রসন্তান হয়। কিন্তু তাঁর ভাগ্য গণনা করে ঋষি দেখেন যে অসাধারণ প্রতিভাধর এই সন্তানের আয়ু মাত্র বারো বছর পর্যন্ত।
ঋষি মৃকাণ্ডু তাঁর স্ত্রীকে এই বলে সান্ত্বনা দেন যে ভগবান মার্কণ্ডেয়কে তাঁদের কোলে দিয়েছেন, তিনিই তাঁকে রক্ষা করবেন। মার্কণ্ডেয় ধীরে ধীরে বড় হতে লাগল। তাঁর মা ছেলের মৃত্যুর সময় এগিয়ে আসছে এই ভেবে সব সময় শোকে কাতর হয়ে থাকতেন। মাকে খুশি করার জন্য মার্কণ্ডেয় ঠিক করলেন যে মহাদেবের কাছ থেকে তাঁকে দীর্ঘ জীবনের বর লাভ করতে হবে। শিবের আরাধনার জন্য মহামৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র রচনা করলেন মার্কণ্ডেয়। শিব মন্দিরে এই মন্ত্র পাঠ করতে লাগলেন তিনি।
মহামৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র —
ॐ ত্র্যম্বকম যজামহে
সুগন্ধিম পুষ্টিবর্ধনম্ ।
উর্বারুকমিব বন্ধনান্
মৃত্যৌর্মুক্ষীয় মামৃতাত্ ॥
বারো বছর সম্পূর্ণ হলে যমদূতেরা তাঁকে নিতে এল। মার্কণ্ডেয়কে মহাকালের আরাধনা করতে দেখে তারা তাঁর ধ্যান ভঙ্গ করার সাহস পায় না এবং যমরাজের কাছে ফিরে যায়। তখন যমরাজ নিজে মার্কণ্ডেয়কে নিতে আসেন। যম মার্কণ্ডেয় টানতে টানতে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে তিনি শিবলিঙ্গকে জড়িয়ে ধরেন। তখন প্রচণ্ড আওয়াজ ও আলোর ছটায় কেঁপে ওঠে মন্দির। শিবলিঙ্গ থেকে আত্মপ্রকাশ করেন স্বয়ং মহাদেব।
যমের দিকে ত্রিশুল উঁচিয়ে মহাদেব জিজ্ঞেস করেন যে তাঁর ধ্যানে মগ্ন ভক্তকে তিনি টেনে নিয়ে যাওয়ার সাহস কোথা থেকে পান ? মার্কণ্ডেয়কে এরপর দীর্ঘ জীবনের আশীর্বাদ দেন শিব।
মার্কণ্ডেয় ঋষির মহাদেবের স্তুতি মহামৃত্যুঞ্জয় স্তোত্রের মাধ্যমে মার্কণ্ডেয় পুরাণে পাওয়া যায়।
মহামৃত্যুঞ্জয় স্তোত্রং —
চন্দ্রার্কাগ্নিবিলোচনং স্মিতমুখং পদ্মদ্বয়ান্তস্থিতং
মুদ্রাপাশমৃগাক্ষসত্রবিলসত্পাণিং হিমাংশুপ্রভম্ ।
কোটীন্দুপ্রগলত্সুধাপ্লুততমুং হারাদিভূষোজ্জ্বলং
কান্তং বিশ্ববিমোহনং পশুপতিং মৃত্যুঞ্জযং ভাবয়েত্ ॥
রুদ্রং পশুপতিং স্থাণুং নীলকণ্ঠম উমাপতিম্ ।
নমামি শিরসা দেবং কিং নো মৃত্যুঃ করিষ্যতি ॥১॥
নীলকন্ঠং কালমূর্ত্তিং কালজ্ঞং কালনাশনম্ ।
নমামি শিরসা দেবং কিং নো মৃত্যুঃ করিষ্যতি ॥২॥
নীলকণ্ঠং বিরূপাক্ষং নির্মলং নিলয়প্রদম্ ।
নমামি শিরসা দেবং কিং নো মৃত্যুঃ করিষ্যতি ॥৩॥
বামদেবং মহাদেবং লোকনাথং জগদ্গুরুম্ ।
নমামি শিরসা দেবং কিং নো মৃত্যুঃ করিষ্যতি ॥৪॥
দেবদেবং জগন্নাথং দেবেশং বৃষভধ্বজম্ ।
নমামি শিরসা দেবং কিং নো মৃত্যুঃ করিষ্যতি ॥৫॥
ত্র্যক্ষং চতুর্ভুজং শান্তং জটামকুটধারিণম্ ।
নমামি শিরসা দেবং কিং নো মৃত্যুঃ করিষ্যতি ॥৬॥
গঙ্গাধরং মহাদেবং সর্বাভরণভূষিতম্ ।
নমামি শিরসা দেবং কিং নো মৃত্যুঃ করিষ্যতি ॥৭॥
ভস্মোদ্ধূলিতসর্বাঙ্গং নাগাভরণভূষিতম্ ।
নমামি শিরসা দেবং কিং নো মৃত্যুঃ করিষ্যতি ॥৮॥
অনন্তমব্যযং শান্তং অক্ষমালাধরং হরম্ ।
নমামি শিরসা দেবং কিং নো মৃত্যুঃ করিষ্যতি ॥৯॥
আনন্দং পরমং নিত্যং কৈবল্যপদদায়িনম্ ।
নমামি শিরসা দেবং কিং নো মৃত্যুঃ করিষ্যতি ॥১০॥
অর্দ্ধনারীশ্বরং দেবং পার্বতীপ্রাণনায়কম্ ।
নমামি শিরসা দেবং কিং নো মৃত্যুঃ করিষ্যতি ॥১১॥
প্রলয়স্থিতিকর্ত্তারমাদিকর্ত্তারমীশ্বরম্ ।
নমামি শিরসা দেবং কিং নো মৃত্যুঃ করিষ্যতি ॥১২॥
ব্যোমকেশং বিরূপাক্ষং চন্দ্রার্দ্ধকৃতশেখরম্ ।
নমামি শিরসা দেবং কিং নো মৃত্যুঃ করিষ্যতি ॥১৩॥
গঙ্গাধরং শশিধরং শঙ্করং শূলপাণিনম্ ।
নমামি শিরসা দেবং কিং নো মৃত্যুঃ করিষ্যতি ॥১৪॥
অনাথঃ পরমানন্তং কৈবল্যপদগামিনি ।
নমামি শিরসা দেবং কিং নো মৃত্যুঃ করিষ্যতি ॥১৫॥
স্বর্গাপবর্গদাতারং সৃষ্টিস্থিত্যন্তকারণম্ ।
নমামি শিরসা দেবং কিং নো মৃত্যুঃ করিষ্যতি ॥১৬॥
কল্পায়ুর্দ্দেহি মে পুণ্যং যাবদায়ুররোগতাম্ ।
নমামি শিরসা দেবং কিং নো মৃত্যুঃ করিষ্যতি ॥১৭॥
শিবেশানাং মহাদেবং বামদেবং সদাশিবম্ ।
নমামি শিরসা দেবং কিং নো মৃত্যুঃ করিষ্যতি ॥১৮॥
উত্পত্তিস্থিতিসংহারকর্তারমীশ্বরং গুরুম্ ।
নমামি শিরসা দেবং কিং নো মৃত্যুঃ করিষ্যতি ॥১৯॥
ফলশ্রুতি —
মার্কণ্ডেয়কৃতং স্তোত্রং যঃ পঠেচ্ছিবসন্নিধৌ ।
তস্য মৃত্যুভয়ং নাস্তি নাগ্নিচৌরভযং ক্বচিত্ ॥২০॥
শতাবর্ত্তং প্রকর্তব্যং সংকটে কষ্টনাশনম্ ।
শুচির্ভূত্বা পথেত্স্তোত্রং সর্বসিদ্ধিপ্রদায়কম্ ॥২১॥
মৃত্যুঞ্জয় মহাদেব ত্রাহি মাং শরণাগতম্ ।
জন্মমৃত্যুজরারোগৈঃ পীডিতং কর্মবন্ধনৈঃ ॥২২॥
তাবকস্ত্বদ্গতঃ প্রাণস্ত্বচ্চিত্তোঽহং সদা মৃড ।
ইতি বিজ্ঞাপ্য দেবেশং ত্র্যম্বকাখ্যমনুং জপেত্ ॥২৩॥
নমঃ শিবায় সাম্বায় হরয়ে পরমাত্মনে ।
প্রণতক্লেশনাশায় যোগিনাং পতয়ে নমঃ ॥২৪॥
॥ শ্রীমার্কণ্ডেয়পুরাণে মার্কণ্ডেয়কৃত মহামৃত্যুঞ্জয়স্তোত্রং সম্পূর্ণম্ ॥
.
ॐ নমঃ শিবায়
হর হর মহাদেব
.
(সংগৃহীত)