প্রথমে ক্রিকেটার হিসেবে অস্ট্রেলিয়ার চোখে চোখ রেখে লড়াই করা। তার পরে কোচ হিসেবে দু’দু’বার ডনের দেশ থেকে টেস্ট সিরিজ় জিতে আসার বিরল কীর্তি। নতুন দ্বৈরথ শুরু আজ, বৃহস্পতিবার নাগপুরে। এ বার তিনি ধারাভাষ্যকার। বুধবার আনন্দবাজারের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় রবি শাস্ত্রী। পিচ বিতর্ক থেকে শুরু করে ভারতীয় প্রথম একাদশ— সব প্রসঙ্গেই সেই চিরাচরিত, সোজাসাপ্টা রবি।
প্রশ্ন: পিচ নিয়ে তো জোর বিতর্ক বেধেছে, শুনেছেন?
রবি শাস্ত্রী: আবার বিতর্ক কীসের?
প্র: পিচে নাকি বেছে বেছে বাঁ হাতি অস্ট্রেলীয় ব্যাটসম্যানদের গুডলেংথ স্পটে রোলার চালানো হচ্ছে না? যাতে প্রথম থেকেই ক্ষত তৈরি হয়।
শাস্ত্রী: এটা কোনও বিজ্ঞানীর মাথা থেকে বেরিয়েছে? নাকি নাগপুরে রহস্য-রোমাঞ্চ লিখছে কেউ?
প্র: না, না। এটা নিয়েই তো সকাল থেকে উত্তাল ক্রিকেট দুনিয়া। অস্ট্রেলীয় সংবাদমাধ্যম ঝড় তুলেছে। ওদের বক্তব্য, অস্ট্রেলিয়ার দলে বাঁ হাতি ব্যাটসম্যান বেশি। তাই বেছে বেছে বাঁ হাতি ব্যাটসম্যানের গুডলেংথ স্পটে রোলার না চালিয়ে শুকনো করে রাখছেন নাগপুরের পিচ প্রস্তুতকারক। যাতে প্রথম দিন থেকে বল ঘোরে আর অস্ট্রেলিয়াকে শেষ করে দেওয়া যায়।
শাস্ত্রী: আমি ওদের বলতে চাই, শুনুন ভাই, আপনাদের ভুল হচ্ছে। বল প্রথম দিন থেকে নয়, প্রথম ঘণ্টা থেকে ঘুরবে। কারণ এটা ভারত। এ নিয়ে নতুন কোনও গালগল্প লেখার দরকার নেই।
প্র: কিন্তু ওরা বলছে…
শাস্ত্রী (থামিয়ে দিয়ে): দাঁড়ান, দাঁড়ান। আমার বক্তব্য এখনও শেষ হয়নি। ওদের বলতে চাই, শুনুন ভাই— ব্রিসবেন বা মেলবোর্নে খেলতে নেমে তো আমরা প্রশ্ন তুলি না বাইশ গজে কতটা ঘাস? ১৫ মিলিমিটার না ১২ মিলিমিটার? তা হলে বাজে বকাবন্ধ করুন।
প্র: কিন্তু অস্ট্রেলিয়া অভিযোগ করছে, ভারতকে সুবিধা করে দেওয়ার জন্য পিচ বিকৃত করা হচ্ছে।
শাস্ত্রী: এই বক্তব্যটা কার? অস্ট্রেলিয়া দলের নাকি ওদের দেশের পণ্ডিতদের?
প্রশ্ন: না, দলের পক্ষ থেকে কেউ অভিযোগ করেননি। অধিনায়ক প্যাট কামিন্স বরং বলেছেন, পিচের চরিত্র বা পিচ-বিতর্ক নিয়ে মাথা ঘামাতে চান না। প্রশ্ন তুলেছে অস্ট্রেলীয় সংবাদমাধ্যমই।
শাস্ত্রী: তা হলে আমার একটাই জবাব। গালগল্প লেখা বন্ধ করে খেলা শুরু হতে দিন। অস্ট্রেলিয়া দলের পক্ষ থেকে যদি কোনও অভিযোগ না উঠে থাকে, তা হলে বাদ দিন। কেউ এক জন এই পিচে সেঞ্চুরি করলে? বা দারুণ একটা ৮০ রানের ইনিংস খেলে দিলে! তখন পিচ বোদ্ধারা কী বলবে? দু’টো দলই তো এই পিচে খেলবে। ভারতে খেলতে এসে কি কেউ বাউন্সে ভরা বাইশ গজ আশা করবে নাকি?
প্র: আপনি কোচ, বিরাট কোহলি অধিনায়ক থাকার সময় একটা শপথ নেওয়া হয়েছিল যে, বিদেশে গিয়ে পিচ নিয়ে অভিযোগ-অনুযোগ করবে না ভারতীয় দল।
শাস্ত্রী: আমরা করতামও না। কোথাও গিয়েই করিনি। দক্ষিণ আফ্রিকায় জোহানেসবার্গে বিপজ্জনক পিচ ছিল। কেউ কথা তো বলেইনি, উল্টে দক্ষিণ আফ্রিকাকে আমরা হারিয়েছিলাম। ওরাই বরং ভয় পেয়েছিল। পার্থের নতুন স্টেডিয়ামে দ্রততম পিচে গুডলেংথ থেকে বল লাফাচ্ছিল। অনেকেই বলেছিল, যে কারও আঘাত লেগে যেতে পারত। সেখানেও আমরা টেস্ট জিতি। দু’টো দলই তো একই পিচে খেলবে। একই পরিবেশে খেলবে। যারা ভাল খেলবে, জিতবে। স্কোরবোর্ড বলে দেবে, কারা পারল আর কারা পারল না। পিচ নিয়ে অভিযোগ করব কেন?
প্র: অস্ট্রেলিয়াকে দু’বার অস্ট্রেলিয়ায় টেস্ট সিরিজ়ে হারানোটাকেই নিশ্চয়ই কোচ হিসেবে সবচেয়ে উপরে রাখেন এখনও?
শাস্ত্রী: অবশ্যই। আর ওই কারণে অস্ট্রেলিয়াও এ বারে ক্ষুধার্ত থাকবে। ওরাও চাইবে দেশের মাঠে হারের পাল্টা জবাব দিতে। আর বাইরের সব দেশের জন্য ভারত সফরে এসে টেস্ট সিরিজ় জয় সবচেয়ে বড় পরীক্ষা।
প্র: এই অস্ট্রেলিয়া দলের যোগ্যতা, দক্ষতায় কতটা আস্থা রাখা যায়?
শাস্ত্রী: খুবই ভাল টিম। দলের প্রধান স্তম্ভরা বেশ কয়েক বছর ধরে একসঙ্গে খেলছে। বোলিং আক্রমণ সেই একই ধরে রেখেছে। স্টার্ক আর হেজ্লউডের চোট বড় ধাক্কা। কিন্তু সামলে নেওয়ার ক্ষমতা আছে ওদের।
প্র: ভারতীয় স্পিনারদের টেক্কা দেওয়ার মতো ব্যাটসম্যান আছে?
শাস্ত্রী: নিশ্চয়ই আছে। খুব অভিজ্ঞ ব্যাটিং বিভাগ নিয়ে খেলতে এসেছে। স্টিভ স্মিথ তো আছেই। গত সফরে এসে প্রথম টেস্টেই ঘূর্ণি পিচে সেঞ্চুরি করেছিল। লাবুশেন আর খোয়াজা দারুণ ব্যাট করছে। অনেকেই আইপিএল খেলে, তাই এখানকার পিচ, পরিবেশ সম্পর্কে জানে। তরুণ ছেলেরাও বেশ ভাল। ট্রাভিস হেড ভাল খেলছে। তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেব, ভাবতে না যাওয়াই ভাল।
প্র: আপনি তো বলেছেন, শুভমন গিলকে খেলানো উচিত। প্রশ্ন তুলেছেন, সহ-অধিনায়ক মানেই জায়গা পাকা এমন হবে কেন?
শাস্ত্রী: বলেছি তো। নেটে দেখে যে ভাল ছন্দে রয়েছে বলে মনে হয়েছে, তাকেই খেলাও। গিল এত রান করছে, কী সুন্দর ব্যাট করছে। অস্ট্রেলিয়াতে গিয়েও তো টেস্টে সফল হয়েছে। তাই সহ-অধিনায়কত্ব নয়, সাম্প্রতিক ফর্ম দেখে ঠিক করো, কে খেলবে।
প্র: মাঝের দিকে কি সূর্যকুমারকে নেওয়া উচিত?
শাস্ত্রী: একদমই তাই। সূর্যকেই খেলানো উচিত।
প্র: চার স্পিনার?
শাস্ত্রী: না, না। তিন স্পিনার যথেষ্ট। অশ্বিনের সঙ্গে কুলদীপ যাদবকে নাও কারণ চায়নাম্যান বোলার হিসেবে বৈচিত্র আনবে। জাডেজা আর অক্ষর একই ধরনের স্পিনার, তাই ওদের দু’জনের মধ্যে এক জনকে খেলাও। তবে জাডেজার অভিজ্ঞতা বেশি, ব্যাটের হাতও রয়েছে। তাই ওকেই হয়তো খেলানো হবে।
প্র: পেসার কারা?
শাস্ত্রী: এটা আকর্ষণীয় হতে যাচ্ছে। দুই পেসার খেলানো উচিত। সবাই তৈরি। শামি, উমেশ, সিরাজ। আমার মতে, উমরান মালিকও কিন্তু তৈরি। টেস্ট ক্রিকেটে ছাপ ফেলার মতো দ্রুতগতি রয়েছে ওর হাতে। মাথায় রাখতে হবে, পুরনো বলেও কে ভাল বল করতে পারবে। রিভার্স সুইংটাও যে লাগবে।
প্র: রোহিত শর্মার টেস্ট অধিনায়কত্বের কি বড় পরীক্ষা এই সিরিজ়?
শাস্ত্রী: পরীক্ষা নিশ্চয়ই। কিন্তু রোহিত ভালই করবে। নীরব আত্মবিশ্বাস রয়েছে ওর মধ্যে। ভাল অধিনায়ক।
প্র: অস্ট্রেলিয়া মানেই বিরাট কোহলি যেন আরও তেড়েফুঁড়ে ওঠেন। এ বারে কী প্রত্যাশা?
শাস্ত্রী: বিরাট বনাম অস্ট্রেলিয়া— আগামী দেড় মাস সারা ক্রিকেট দুনিয়া উপভোগ করবে সেরা দ্বৈরথ। এ বারও দারুণ কিছু দেখব বলেই আশা করছি।
প্র: পূর্বাভাস করতে বললে কাকে এগিয়ে রাখবেন?
শাস্ত্রী: ভারত নিশ্চয়ই হাল্কা ভাবে নেবে না এই অস্ট্রেলিয়া দলকে। তবে রোহিতরা নীরবে আত্মবিশ্বাসী থাকবে সিরিজ় জেতার ব্যাপারে। শুরুতে ছন্দ পাওয়া খুব গুরুত্বপূর্ণ যাতে প্রথম থেকে অস্ট্রেলিয়ার উপরে চাপ তৈরি করা যায়।