প্রত্যন্ত জেলায় কলকাতা থেকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সম্প্রতি তা শুরুও হয়েছে। কিন্তু তার মধ্যেই খাস কলকাতায় জেলার পদ্ধতি চালু হল।
জেলার অধিকাংশ সরকারি হাসপাতালেই একাধিক বিভাগে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক থাকেন না। সেখানে মেডিসিন-এর ডাক্তারেরাই অন্য বিভাগের রোগী দেখেন। কলকাতার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি মেডিক্যাল কলেজেও সেই ব্যবস্থা চালু হলে ক্ষতি কী! অনেকটা এই যুক্তিতেই কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ‘ঠেকনা’ দিয়ে নেফ্রোলজির বহির্বিভাগ চালু করার সিদ্ধান্ত নিল স্বাস্থ্য দফতর! যে সিদ্ধান্তের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে শুরুতেই প্রশ্ন উঠেছে।
কোনও হাসপাতাল থেকে চিকিৎসককে তুলে অন্য হাসপাতালে পাঠানো হলে, দুই জায়গার তথ্যই স্বাস্থ্য ভবনের কাছে থাকা উচিত। প্রশ্ন, এ ক্ষেত্রে সেটা নেই কেন? আর যদি থেকেও থাকে, তবে কেন জেনেশুনে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকহীন করে দেওয়া হল কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের মতো ব্যস্ত হাসপাতালের একটি বিভাগকে?
কলেজ কর্তৃপক্ষের যুক্তি, ঠেকনা ব্যবস্থার মাধ্যমে চালু থাকছে নেফ্রোলজির বহির্বিভাগ। বুধবার থেকে নেফ্রোলজির বহির্বিভাগ বন্ধের খবরে রোগীদের হয়রানি দেখে হাসপাতালের রোগী কল্যাণ সমিতির চেয়ারম্যান তড়িঘড়ি মেডিক্যাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনায় বসেন। স্থির হয়, আপাতত নেফ্রোলজির রোগীদের দেখবেন মেডিসিনের চিকিৎসকেরা! কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের অধ্যক্ষ ইন্দ্রনীল বিশ্বাসের যুক্তি, ‘‘জেলা হাসপাতালে তো জেনারেল মেডিসিনের চিকিৎসকেরাই কিডনির অসুখের পরিষেবা দেন। তাই এখানেও সমস্যা হবে না।’’ পাশাপাশি কর্তৃপক্ষের দাবি, এক জন শিক্ষক-চিকিৎসক নেফ্রোলজি বিভাগে শীঘ্রই যোগ দেবেন।
এ দিন বেলা ১১টা নাগাদ মেডিসিনের প্রধান চিকিৎসক সৌমিত্র ঘোষের নেতৃত্বে ছ’জন চিকিৎসক গিয়ে বসেন সুপার স্পেশ্যালিটি ব্লকের (এসএসবি) নেফ্রোলজির বহির্বিভাগে। সমস্যা সেখানেও। ওই বিভাগে দেখানোর টিকিটে ছিল শিক্ষক-চিকিৎসক সঞ্জয় দাশগুপ্তের নাম। ইতিমধ্যেই যাঁকে এসএসকেএম হাসপাতালে বদলি করে দেওয়া হয়েছে। যে কারণে কলকাতা মেডিক্যালে নেফ্রোলজি বিভাগ শিক্ষক-চিকিৎসকশূন্য হয়ে গিয়েছে। চিকিৎসক মহলের প্রশ্ন, ‘‘বদলির নির্দেশিকা জারির সময়ে স্বাস্থ্য ভবন কি সংশ্লিষ্ট হাসপাতালের অবস্থার খবর নেয়নি? যদি তারা এই বিষয়ে অবগতই থাকে, তা হলে প্রশাসন কী ভাবে কোনও বিভাগকে চিকিৎসকশূন্য করতে পারে?’’
এ দিন সকালে বহির্বিভাগের টিকিটের লাইনে তখন ঠাসা ভিড়। হঠাৎই মাইকে ঘোষণা শুরু হল, ‘অনিবার্য কারণবশত আজ নেফ্রোলজির আউটডোর বন্ধ। টিকিটের জন্য কেউ লাইনে দাঁড়াবেন না।’ চাপা স্বরে হাসপাতালের কর্মীদের পরামর্শ, ‘অন্য হাসপাতালে চলে যান। এখানে তো ডাক্তারই নেই।’ যা শুনে অনেকের মতোই মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার অবস্থা বনগাঁর বাসিন্দা মুকুন্দ মল্লিকের। ভোরের প্রথম লোকাল ধরে এসেছিলেন। ক্যাথিটার পরানো অবস্থায় তাঁকে নিয়ে কোথায় যাবেন, তা ভেবেই দিশাহারা পরিজনেরা।
সুন্দরবনের জয়ন্ত নস্করের কথায়, ‘‘দীর্ঘ দিন ধরে কিডনির অসুখে ভুগছি। ডায়ালিসিস চলছে। শুনছি, আউটডোরই বন্ধ। এ বার কোথায় যাব?’’ সাতসকালেই অ্যাম্বুল্যান্সে চাপিয়ে হুগলির বেগমপুরের বাসিন্দা শেখ জসিম আলিকে এসএসবি-র সামনে এনেছিলেন পরিজনেরা। ঢুকতে গিয়ে শুনলেন, ‘ডাক্তারবাবু নেই। নেফ্রোলজি বিভাগ বন্ধ।’ ডায়ালিসিসের জন্য ওই প্রৌঢ়ের হাতে চ্যানেল করতে হবে। এ দিন তাঁকে নেফ্রোলজির বহির্বিভাগ থেকে প্রেসক্রিপশনে সেটাই লিখিয়ে আনতে বলেছিলেন চিকিৎসকেরা। বিভাগ বন্ধ শুনে কান্নায় ভেঙে পড়েন জসিমের স্ত্রী সুরাইয়া বেগম। বিষয়টি জানতে পেরে এক সহকারী সুপার ব্যবস্থা করেন।
বেলার দিকে নড়ে বসে স্বাস্থ্য ভবন। এসএসকেএম ও নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ থেকে এক জন করে সিনিয়র রেসিডেন্টকে (এসআর) কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের নেফ্রোলজি বিভাগে পোস্টিংয়ের নির্দেশিকা জারি করা হয়। কিন্তু এর ফলে ওই দুই জায়গায় কতটা শূন্যস্থান তৈরি হল, সেটা প্রশ্নও থেকে যাচ্ছে।
চিকিৎসকদের একটি সংগঠন ‘মেডিক্যাল সার্ভিস সেন্টার’-এর রাজ্য সম্পাদক বিপ্লব চন্দ্র বলেন, ‘‘কলকাতা মেডিক্যালের এমন শোচনীয় অবস্থা হলে রাজ্যের অন্যান্য মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের অবস্থা সহজেই অনুমেয়। সরকারের সমালোচনা করলেই চিকিৎসকদের দূরে বদলি করা হচ্ছে। এর ফল, কলকাতা মেডিক্যালের আজকের দুরবস্থা।’’