২৭২৪ থেকে একলাফে প্রায় ৮০০০! তুরস্ক ও সিরিয়ার গত কালের ভূমিকম্পে এক দিনে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দ্বিগুণেরও বেশি হল। খুব একটা অপ্রত্যাশিত ছিল না বিষয়টা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) জানিয়েছে, এই সংখ্যা কিছুই নয়। প্রাথমিক ভাবে যা মনে করা হয়েছিল, তার আট গুণ বাড়তে পারে প্রাণহানি। আহতের সংখ্যার কোনও হিসেব নেই। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, আমেরিকা-সহ প্রায় সমস্ত দেশ তুরস্ক-সিরিয়ার পাশে দাঁড়িয়েছে। আজ তুরস্কের আদানা শহরে পৌঁছেছে ভারতের পাঠানো প্রথম দফার ত্রাণসাহায্য। সেই সঙ্গে পৌঁছেছে ভারতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীর উদ্ধারকারী দল, বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কুকুর, চিকিৎসা সামগ্রী, ড্রিলিং মেশিন ইত্যাদি। সিরিয়াতেও গিয়েছে ভারতের ত্রাণসাহায্য। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে ধন্যবাদ জানিয়ে ভারতে নিযুক্ত তুরস্কের রাষ্ট্রদূত ফিরাত সুনেল সোশ্যাল মিডিয়ায় লিখেছেন, ‘‘তুর্কি ও হিন্দি… দুই ভাষাতেই ‘দোস্ত’ শব্দটি রয়েছে। তুর্কিতে একটা কথা আছে: বিপদের বন্ধুই প্রকৃত বন্ধু।’’
গত কাল তুরস্কের দক্ষিণ প্রান্তে সিরিয়া সীমান্তের কাছে হওয়া পরপর তিনটি ভূমিকম্প কার্যত ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছে এই অঞ্চলকে। ৭.৮, ৭.৬ এবং ৬.০— রিখটারে স্কেলে কম্পনের তীব্রতা ছিল এ রকম। আজ সকালে ফের একবার জোরে কেঁপে উঠেছিল মাটি। রিখটার স্কেলে তার তীব্রতা ছিল ৫.৬। এ ছাড়াও আরও বেশ কিছু ছোটবড় ভূমিকম্প পরবর্তী কম্পন অনুভূত হয়েছে এই অঞ্চলে। হু-র ইউরোপ শাখার জরুরি বিভাগের শীর্ষস্থানীয় আধিকারিক ক্যাথরিন স্মলউডের কথায়, ‘‘আরও ধ্বংসের আশঙ্কা এখন থাকবেই। প্রাথমিক ভাবে যা জানা গিয়েছিল, তার আট গুণ বাড়তে পারে মৃতের সংখ্যা। ভূমিকম্পের পরে সব সময়েই এটা ঘটে থাকে। আর ঠিক তা-ই বিপর্যয়ের কয়েক সপ্তাহ পরে মৃত বা জখমের সংখ্যা অনেকটা বেড়ে যায়।’’ উল্লেখ্য, ভূ-বিশেষজ্ঞদের ধারণা, গত কালের ভূমিকম্পটির কারণ পূর্ব আনাতোলিয়া চ্যুতি। ১৯৯৯ সালে উত্তর আনাতোলিয়া চ্যুতিতে এমনই এক ভূমিকম্পে ১৭ হাজারের বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছিলেন। আনাতোলিয়া চ্যুতি একটি স্ট্রাইক স্লিপ ফল্ট বা আয়াম স্খলন চ্যুতি। এ ধরনের চ্যুতিতে চ্যুতিতল বরাবর (যে তল বা পৃষ্ঠ বরাবর শিলার খণ্ডিত অংশ একে অপরের থেকে দূরে সরে যায়) শিলাস্তূপ অনুভূমিক ভাবে পরস্পরের থেকে সরে যায়। এক দিকের শিলাস্তূপ থেকে অন্য দিকের শিলাস্তূপ গা ঘেঁষে অনুভূমিক ভাবে সরে যাওয়ার ফলে পৃথিবীর অভ্যন্তরের স্থিতিশীলতা নষ্ট হয়। তার জেরে হয় ভূমিকম্প।
তুরস্কে এখন শীতের মাঝামাঝি। হাড়কাঁপানো ঠান্ডায় খোলা আকাশের নীচে অসংখ্য মানুষ। আবহাওয়া দফতর সতর্ক করেছে, তাপমাত্রা আরও নামতে পারে। এর মধ্যে তুষারঝড়ের আশঙ্কাও রয়েছে। স্মলউড বলেন, ‘‘ভূমিকম্পের পরে যাঁদের আর ঘরবাড়ি নেই কিংবা ঘরে ফেরার অবস্থা নেই, তাঁরা এক জায়গায় জড়ো হচ্ছেন। এতেও বিপদ বাড়ছে। একটা ছোট আশ্রয়শিবিরে ঠাসাঠাসি ভিড়, তার উপরে ঘর গরম রাখার ব্যবস্থা নেই, শ্বাসজনিত রোগ ছড়ানোর আশঙ্কা প্রবল।’’ অচেনা মুখের ভিড়েই আশ্রয় খুঁজছেন পরিবার-হারিয়ে রাতারাতি একা হয়ে যাওয়া বহু মানুষ। আর অনেকে রাতের অন্ধকারেও ভগ্নস্তূপে হাতড়ে বেরাচ্ছেন প্রিয়জনকে।
ভূমিকম্পে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তুরস্কের হাতায় প্রদেশ। একটি ভিডিয়ো ফুটেজে দেখা গিয়েছে, অন্ধকারে এক বাসিন্দা ধ্বংসস্তূপের মধ্যে কী যেন খুঁজে চলেছেন। জিজ্ঞাসা করতে জানালেন, তিনি কারও গলা শুনতে পেয়েছেন। তাঁর বিশ্বাস ভগ্নস্তূপের নীচেকেউ চাপা পড়ে আছেন। ‘‘আরও জোরে বলো তুমি কোথায়,’’ চেঁচাতে শুরু করেন লোকটি। সামনে এক যুবকের মৃতদেহ পড়ে। কেউ তাঁকে সরিয়ে নিয়ে যায়নি। আরও নীচ থকে ভেসে আসে এক মহিলার কণ্ঠস্বর। ধাতব কিছুতে আঘাত করছেন তিনি। কিন্তু অসহায় লোকটি কী করবেন বুঝতে পারছেন না। একটা গোটা বাড়ি ভেঙে পড়েছে। একা কীভাবে সরাবেন! এমন আরও কত কান্না চাপা পড়ে রয়েছে ধ্বংসাবশেষের নীচে। তুরস্কের এক সাংবাদিক জানিয়েছেন, তাঁর কাছে, তাঁর সহকর্মীদের কাছে সাহায্য চেয়ে অসংখ্য ভয়েস নোট আসছে। ভিডিয়ো পাঠাচ্ছেন অনেকে। ইব্রাহিম হাসকোলোগলু বলেন, ‘‘ওঁরা বলছেন কোথায় আটকে রয়েছেন। লোকেশন পাঠাচ্ছেন। কিন্তু আমরা কিচ্ছু করতে পারছি না!’’
তুরস্ক ও সিরিয়ার বেশ কিছু অঞ্চলের খবর এখনও জানাই যায়নি। হু-এর ডিরেক্টর জেনারেল টেড্রোস অ্যাডানম গেব্রিয়েসাস বলেন, ‘‘সময়ের সঙ্গে প্রতিযোগিতা এখন। এক মিনিট সময় নষ্টের অর্থ একটা প্রাণকে হারিয়ে ফেলা।’’ ইস্তানবুল বিমানবন্দরে ভিড় করেছেন অসংখ্য মানুষ। তাঁরা উদ্ধারকাজে সাহায্য করতে বিপর্যয়স্থলে যেতে চান। অনেকে আবার বিদেশ থেকে তুরস্কে ফিরছেন। বিপদে দেশের পাশে দাঁড়াতে চান তাঁরা। সাত দিন জাতীয় শোক পালন করা হবে বলে ঘোষণা করেছেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিচেপ তায়িপ এর্ডোয়ান। জানিয়েছেন, ১০টি শহরকে বিপর্যস্ত ঘোষণা করা হয়েছে। এই সব অঞ্চলে আগামী তিন মাস জরুরী অবস্থা জারি থাকবে। এ পর্যন্ত ৭০টি দেশ তুরস্কের পাশে দাঁড়িয়েছে। সকলকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন এর্ডোয়ান।
ও দিকে, গাজ়িয়ানটেপের দক্ষিণ-পশ্চিমে ইসকেনদেরুন সমুদ্রবন্দর কাল থেকে দাউদাউ করে জ্বলছে। ঘন কালো ধোঁয়ায় ঢেকেছে আকাশ। পেট্রোলের গন্ধে বাতাস ভারী হয়ে। এক কর্তা জানিয়েছেন, গত কাল ভূমিকম্পের সময়ে বন্দরে থাকা শিপিং কন্টেনারগুলি একে অন্যের গায়ে গিয়ে পড়ে। এ সময়ে প্রবল ঝাঁকুনি ও ঘর্ষণে আগুন ধরে যায় কন্টেনারগুলিতে। সমুদ্রের জলস্তরও বেড়েছে বলে শোনা গিয়েছে। বন্দর অঞ্চলগুলি থেকে বিপদবার্তা এসেছে।
সিরিয়ার অবস্থাও ভয়াবহ। হু-এর আধিকারিক অ্যাডেলেড মার্শাংয়ের বক্তব্য, এই বিপর্যয় সামলানোর জন্য তুরস্কের তা-ও কিছু সামর্থ্য আছে। কিন্তু বছরের পর বছর ধরে গৃহযুদ্ধে এমনিতেই বিপর্যস্ত সিরিয়া। অর্থনৈতিক অবস্থা তলানিতে। কলেরার সংক্রমণ ছড়িয়েছে এ দেশে। খাদ্যাভাব, অপুষ্টি তো রয়েইছে। এই অঞ্চলে অসংখ্য সমস্যা রয়েছে। তার উপরে যোগ হল আরও একটি। অ্যাডেলেড জানান, দু’দেশ মিলিয়ে কমপক্ষে ২ কোটি ৩০ লক্ষ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত এই প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে। যার মধ্যে রয়েছে অন্তত ১৪ লক্ষ শিশু।